রবিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

পড়ন্ত বিকালের গল্প

হোসেন আবদুল মান্নান

১৯৯০ সালটা আমার জীবনের এক টার্নিং পয়েন্টের মতো। বছর দুই আগেই প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার যবনিকাপাত ঘটেছে। হাতে ‘শিক্ষাই আলো’ জলছাপসংবলিত দু-তিনটি সার্টিফিকেট। আত্মীয়-অনাত্মীয়, গ্রামপ্রতিবেশীসহ চারদিকে তুমুল কানাঘুষা হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি লাভ করলে কী হবে- চাকরিবাকরি পাবে বলে মনে হয় না। যা সহজেই আমি ঠাওর করতে পারছিলাম। কদিন গ্রামে গিয়ে কাটাই আবার কদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফিরে আসি। হলে অনুজ সতীর্থদের সঙ্গে নিদ্রাসন ভাগাভাগি করি। বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েও চাকরির জন্য অপেক্ষমাণ বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলি, চাকরির আবেদন করি, গ্রেড বা শ্রেণি বিশ্লেষণ করি, বেতন স্কেল পরিমাপ করি। তখন এসব করেই সময় কাটাই। ব্যক্তিগত হতাশা ভিতর থেকে চেপে ধরলেও এর বহিঃপ্রকাশ ছিল কম। এতকাল পরে এসে মনে মনে ভাবী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাসের অন্তরজুড়ে যুগে যুগে কত জানা-অজানা, চেনা-অচেনা জীবনের গল্পের পাণ্ডুলিপি তৈরি হয় এবং একই সঙ্গে অদ্ভুত এক অদৃশ্য তিমিরে মিলিয়ে যায় এর হিসাব কে রাখে?

২. আজও দিব্যি মনে করতে পারি, আমার সে সময়কার নিভৃতচারী বিকালগুলো শুধু শুধু অকাজে বা অকর্মণ্যতায় কাটেনি। একেবারে অনর্থক যায়নি জীবনের এমন উদ্দেশ্যবিহীন প্রহরগুলো। কখনো একা একা হেঁটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাজির হই। আরও অনেক শিষ্যত্ব-গ্রহণকারী নীরব শ্রোতার মতন ঘাসের কার্পেটে আসন নিই। জানি বিজ্ঞ বক্তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত হবেন। তাঁদের শারীরিক কসরত ও বৈকালিক ভ্রমণ শেষে এখানেই গোল হয়ে উপবিষ্ট হবেন। ঘামে-সিক্ত শরীর মুছতে মুছতেই আজকের আলোচ্য বিষয় নির্ধারিত হয়ে যাবে। প্রধান আলোচক প্রফেসর ড. আহমদ শরীফ, সহযোগী আলোচক প্রফেসর ড. আবদুল্লাহ ফারুক ও প্রফেসর মমতাজুর রহমান তরফদার। সামনের ঘাসের শ্রোতাদের মধ্যে প্রয়াত কবি ও লেখক হুমায়ুন আজাদকেও একাধিকবার আমাদের সারিতে পেয়েছিলাম। এমন অনির্ধারিত মুক্তধারার আলোচনার অমূল্য স্বাদের কথা জীবদ্দশায় ভুলে যাওয়া সত্যিই কঠিন। কত বিচিত্র ভাবনায়, কত সমসাময়িক ইস্যুতে, কত নিঃসংকোচ বয়ানে ভরপুর ছিল সেসব আড্ডার বিরতিহীন কথোপকথন।

কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা একসময়ের আলোড়ন সৃষ্টিকারী রাজনীতিক, সংসদ কাঁপানো নেতা, সুপ্রিম কোর্টে ঝড় তোলা আইনজীবী, বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, এমনকি আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী,  রাজনীতির পরম্পরাহীন মানুষটি কী বিস্ময়কর নিঃসঙ্গতায় এবং অসহায়ত্বের ভিতর দিয়ে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তা ভাবতে গেলেও শিহরিত হতে হয়
৩. ১৯৮৯ সালের প্রথম দিকের এক বিকালের ঘটনা। একটা বেসরকারি ব্যাংকের চাকরির খোঁজে সেগুনবাগিচার বহুলপরিচিত বাড়িতে যাই। তখন দেশে জনশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী মানুষের বাড়ি সেটা। মূলত একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার লক্ষ্যে সেখানে যাওয়া। তবে সেদিন ভদ্রলোককে পাইনি। বহিরাঙ্গনে অপেক্ষমাণ থাকার সময় দেখতে পাই একজন প্রায়-অশীতিপর বৃদ্ধ চেয়ারে বসে কাকে যেন চিৎকার করে গালাগাল করছেন। কিন্তু তাঁর ভরাট কণ্ঠস্বর বেশ উচ্চশিক্ষিত মানুষের মতন মনে হলো। কৌতূহল নিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, উনি কে? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, উনি আসাদুজ্জামান খান। একসময়ের প্রখ্যাত আইনজীবী, সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। তাঁর বাড়ি কিশোরগঞ্জ। বিলম্ব না করে আমি মনে মনে স্থির করে নিলাম, লোকটার মেজাজ কিছুটা শীতল হলেই কাছে গিয়ে সালাম বিনিময় করব। জানি, এতে আমার বিপদও হতে পারে। তবু নিজ জেলার মানুষ, তা ছাড়া বাবা-চাচাদের কাছ থেকেও বহুবার তাঁর নাম শুনেছি। যা হওয়ার হবে।

৪. আধা ঘণ্টা পরে কাছে গিয়ে সালাম দিতেই,

তুমি কে? কী চাই এখানে?

আমি বললাম,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র,

বাড়ি কিশোরগঞ্জে। এখানে মিস্টার করিমের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম।

কিশোরগঞ্জে কোথায়? ওর কাছে কেন?

তিনি আসতে বলেছিলেন, তাই।

ও তো একটা খারাপ লোক, তার কাছে আর এসো না।

বললাম, জি।

এবার ঈশারায় আমাকে বসতে বললেন, ধীরে ধীরে আমার সবকিছু জানতে চাইলেন।

প্রথম দিন বলে আমিও ভয়ে ভয়ে ছিলাম।

তিনি বললেন, ‘আচ্ছা তুমি মাঝেমধ্যে এসো।’

কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে না পড়ে সেদিন খুব ভালোভাবে ফিরে এসেছিলাম।

তারপর কখনো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিস করলে সেগুনবাগিচায় তাঁর কাছে হাজির হই। ক্রমে ঘনিষ্ঠতা হয়, তিনিও কথা বলতে চান। তাঁরও জীবন নিঃসঙ্গ, একা। ক্ষমতাহীন বৃদ্ধ বাঘের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করতে কে আসে? সূর্যাস্ত হলে নিজের ছায়াও সঙ্গ দেয় না।

একদিন সন্ধ্যায় গিয়ে দেখি উনি ভীষণ একাকিত্বের মধ্যে চেয়ারে হেলান দিয়ে বাঁকা হয়ে পড়ে আছেন। বাড়িতে আশপাশেই বেশ কটা কাজের লোক আছে। জিজ্ঞাসা করে জানি, ডাক দিলে বকাবকি করবেন, তাই কেউ কাছে যেতে নারাজ।

আমি কাছে যেতেই চোখ মেললেন, বললেন,

‘আরে তোমার কথা ভাবছিলাম। বোসো।’

সেদিন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনেক স্মৃতি রোমন্থন করলেন। কিশোরগঞ্জের শৈশব, কৈশোর, স্কুলজীবন, আখড়াবাজার ব্রিজ পার হওয়ার সময় হিন্দু ছাত্ররা সাঁকোয় একসঙ্গে উঠতে বারণ করত, কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, ইতিহাস নিয়ে পড়া, জুডিশিয়াল সার্ভিসে যোগদান, বিয়ে, স্ত্রীর মৃত্যু এবং নিঃসন্তান জীবন ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ তিনিই, কী অসাধারণ বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন।

কথায় কথায় হঠাৎ আমাকে বললেন, ‘শোনো, মা-বাবার অমতে বিয়ে করবা না, অমঙ্গল হয়, আমি নিজেই এর প্রমাণ। আমার কোনো সন্তান হয়নি। অভিশাপ ছিল।’ আমি তাঁর মুখমণ্ডল ও চোখের পাতায় সজল বিষণ্নতার ছাপ দেখতে পাই।

আরেকদিন অপরাহ্ণে তাঁর কাছে গিয়ে বসতেই কাকে যেন বলছেন রেস্তোরাঁ থেকে দুটো জালি কাবাব নিয়ে আসতে। কিন্তু কেউ যেতে চাচ্ছে না, উনি ধমকাচ্ছেন। কিন্তু একজনও এগিয়ে আসছে না।

কারণ জানতে চাইলাম।

ওরা বলল, ‘আমরা নাকি টাকা মেরে দিই।’ বলেন তো, পাঁচ টাকা থেকে কি মারা যায়? উনি সারাক্ষণ আমাদের চোর আর শয়তান ডাকেন।

আসলে মানুষটি নাকি খুবই কৃপণ ও সন্দেহপ্রবণ চরিত্রের ছিলেন। আর শেষ বয়সে এসে এটা প্রবল মাত্রায় উপনীত হয়েছিল। তখন তিনি কাউকে বিশ্বাসই করতেন না। সবাইকে দুষ্কৃতকারী জ্ঞান করতেন।

প্রসঙ্গত একবার আমি জানতে চাইলাম, আপনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের কারও কথা হয় না?

তিনি বললেন, ‘না। তবে তোফায়েল ছেলেটা মাঝেমধ্যে খোঁজখবর নেয়। কিন্তু অনেক দিন কথা হয় না।’

৫. আরও একদিনের ঘটনা। আমি উনার পাশে বসে আছি। বাড়িওয়ালাদের একজন জামাল সাহেব ছুটে এলেন। তাঁর খোঁজখবর এবং সেবাযত্নের দেখভাল করাই মূল উদ্দেশ্য। আমাকে দেখে অনেকটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, এ ছেলে কে? উনি বললেন, ও আমাকে দেখতে আসে। কিশোরগঞ্জের ছেলে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, ভালো ছেলে।

যদিও এতে তিনি পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছিলেন না।

এখানে বলে রাখা যায়, শেষ জীবনে এসে এই কিংবদন্তি তাঁর তোপখানা রোডের বিরাট বাড়ি, বিরল পুস্তকসমৃদ্ধ লাইব্রেরিসহ স্থাবর-অস্থাবর সবকিছু আত্মীয়দের হাতে তুলে দিয়ে বিনিময়ে দু-তিন জন অলস, অর্বাচীন কেয়ারটেকার পেয়েছিলেন মাত্র।

৬. ১৯৯২ সালে মৃত্যুকালে তাঁর পাশে উল্লেখ করার মতো কেউ ছিলেন বলে আমার মনে পড়ে না। আমিও তখন ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পেয়ে উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জে বসবাস করি। ১৯১৬ সালে কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা একসময়ের আলোড়ন সৃষ্টিকারী রাজনীতিক, সংসদ কাঁপানো নেতা, সুপ্রিম কোর্টে ঝড় তোলা আইনজীবী, বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, এমনকি আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী, রাজনীতির পরম্পরাহীন মানুষটি কী বিস্ময়কর নিঃসঙ্গতায় এবং অসহায়ত্বের ভিতর দিয়ে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তা ভাবতে গেলেও শিহরিত হতে হয়। অবাক হতে হয় মানুষের জীবৎকালের অবশ্যম্ভাবী পরিণতির কথা ভেবে। তাহলে জীবন কি খুব ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ!

লেখক : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর