বুধবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

অনন্য আলহাজ জহুরুল ইসলাম

ডা. খন্দকার মাইনুল হাসান

অনন্য আলহাজ জহুরুল ইসলাম

আমরা যারা ছাত্রছাত্রী ছিলাম কিংবা আছি, জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ আমাদের কাছে অনেক আবেগজড়িত একটি নাম। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এ ক্যাম্পাসের পরতে পরতে। এজন্যই আমরা অনেকে এ ক্যাম্পাসকে আমাদের সেকেন্ড হোম বলি। শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাদের কাছে পিতৃ-মাতৃতুল্য। আমাদের প্রিয় এ প্রতিষ্ঠান দেশের অন্যতম সেরা মেডিকেল কলেজ হিসেবে সুনাম অর্জন করছে বহু বছর ধরে। এখন আমি সেই মানুষটি সম্পর্কে বলব, যিনি এই অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠানটির শুধু একজন স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, ছিলেন স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়ার সফল কারিগর। তিনি হলেন আলহাজ জহুরুল ইসলাম। তাঁর জন্ম কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার ভাগলপুরে। তাঁর বাবা আফতাব উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন জেলার পরিচিত ব্যক্তিত্ব। ১৯৫৮ সাল থেকে টানা ১০ বছর বাজিতপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। আলহাজ জহুরুল ইসলাম জীবন শুরু করেছিলেন একজন ঠিকাদার হিসেবে। এ জীবনেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এ জনপদের সবচেয়ে বড় শিল্পপতি হিসেবে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সম্ভবত তিনিই প্রথম ও প্রধান বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তা, যিনি পশ্চিমা শিল্পপতিদের সমান্তরালে হেঁটেছেন।

তাঁর সৃষ্টির পরিধি বিশাল। শিল্পকারখানার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন বিদ্যাপীঠ, কৃষি খামার, ওষুধ তৈরির কারখানা, আধুনিক হাসপাতাল, ব্যাংকসহ কত কিছু। এ দেশে অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসার পথিকৃৎ তিনি। দেশের সীমানা পেরিয়ে আরব দুনিয়ায় গড়ে তুলেছেন নতুন নতুন জনপদ, শহর আর উপশহর। তাঁর এ বিশাল কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে অর্জিত আয়ের সিংহভাগই ব্যয় করেছেন গণমানুষের কল্যাণে।

অপরিকল্পিত, দূষণযুক্ত, রাস্তাবিহীন শহরের বিপরীতে তিনি প্রথম গড়ে তুলেছেন বেশ কিছু আবাসিক প্রকল্প, অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড, ইস্টার্ন টাওয়ার, ইস্টার্ন ভিউ, ইস্টার্ন পয়েন্ট, ইস্টার্ন ভ্যালি, ইস্টার্ন নিকুঞ্জ প্রভৃতির মাধ্যমে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছেন লাখ লাখ পরিবারকে। ঢাকা শহরের আশপাশে গড়ে তুলেছেন পল্লবী ইস্টার্ন মল্লিকা, আফতাবনগর আবাসিক প্রকল্প, রূপনগর আবাসিক, গোড়ান, বনশ্রী, নিকেতন, মহানগর, গারাডোগা, মাদারটেক, মায়াকুঞ্জ নামে আবাসিক প্রকল্প। এসব প্রকল্পে ছোট-বড়-মাঝারি আকারের কয়েক হাজার প্লট আছে। এসব প্রকল্পে একাধিক মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, শিশু পার্ক, সুপার মার্কেটসহ নানা নাগরিক সুবিধা রাখা হয়েছে। বলা যায়, ঢাকার নগরায়ণে একটি বড় অংশের উন্নয়ন জহুরুল ইসলামের অবদান। তিনি প্লট-ফ্ল্যাটের পাশাপাশি ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে তোলেন ইস্টার্ন প্লাজা, ইস্টার্ন মল্লিকা, ইস্টার্ন প্লাসের মতো অত্যাধুনিক শপিং মল।

তিনি দেশের পাশাপাশি আবুধাবিতে ৫ হাজার বাড়ি নির্মাণ, ইরাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অত্যাধুনিক ইট নির্মাণ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। ইরাকে বিখ্যাত সিটি সেন্টার ও আবদুল কাদির জিলানি (রহ.)-এর মাজার কমপ্লেক্সের পাশে একটি আধুনিক মানের গেস্টহাউসসহ অনেক স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। আলহাজ জহুরুল ইসলাম বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের শ্রমিক নেওয়ার পথ উন্মুক্ত ও সুগম করেন। মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার বাংলাদেশির কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেন। তাঁর জন্মস্থান বাজিতপুর হয়ে উঠেছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাঝারি শিল্পের নগরী, কৃষি খাতে এনেছেন আমূল পরিবর্তন। ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড ছাড়াও তিনি নাভানা গ্রুপ লিমিটেড, আফতাব অটোমোবাইলস, নাভানা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ঢাকা ফাইবারস লিমিটেড, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড, দি মিলনার্স ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, ইস্টার্ন এস্টেটস লিমিটেড, ভাগলপুর ফার্মস লিমিটেড, এসেনশিয়াল প্রোডাক্টস লিমিটেড, ইসলাম ব্রাদার্স প্রপার্টিজ লিমিটেড, জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড, আফতাব ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড, আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড, উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড গড়ে তুলেছেন তিনি। বাজিতপুরের মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য বাজিতপুরে গড়ে তুলেছেন অর্ধশতাধিক ফার্ম।

আলহাজ জহুরুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকারের জেলে আটক বাঙালি নেতা-কর্মীদের মামলা, আহতদের চিকিৎসা ও পারিবারিক খরচ নিভৃতে বহন করেছেন। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মিথ্যা মামলার খরচও তিনি ব্যক্তিগতভাবে বহন করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধে তিনি পালন করেছেন অবিস্মরণীয় ভূমিকা। আত্মপ্রচারে বরাবরই বিমুখ ছিলেন তিনি। এ দেশের মানুষ হয়তো এ কারণেই তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু জ্ঞাত নয়। এই মানুষটিকে নিয়ে গবেষণা জরুরি। রাষ্ট্র, সমাজ আর মানুষের কল্যাণে তাঁর অবদান প্রচারিত হতে হবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে দিতে নয়, বরং মানুষকে উজ্জীবিত করতে; জন্মের যে ঋণ তা শোধ করতে হয় কীভাবে তা জানাতে। এ জনপদে নানান সময়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন-সংগ্রামে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁরাই ভালো করে বলতে পারবেন রাজনীতির অঙ্গন থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করে কীভাবে তিনি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন প্রতিটি কর্মযজ্ঞে। বাঙালির সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসরদের হিংস্র থাবায় রক্তাক্ত হয়েছে এ জনপদ। শহীদ হয়েছেন ৩০ লাখ নিরপরাধ মানুষ। সম্ভ্রম হারিয়েছেন ২ লাখের অধিক নারী।

জাতির জীবনের এ দুর্বিষহ দিনে জহুরুল ইসলাম পালন করেছেন তাঁর পবিত্র ও সঠিক দায়িত্ব। এ জনপদে গড়ে তোলা তাঁর শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য; তাঁর সব মায়া ত্যাগ করে তিনি চরম ঝুঁকি নিয়ে দেশান্তরী হয়েছিলেন হায়েনাদের থাবা থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করার কর্মযজ্ঞে শামিল হতে। তিনি ১৯৭১ সালের ৩ জুন পাক বাহিনীর হাতে আটক হন এবং মুক্তি পাওয়ার পর ১০ জুন লন্ডন চলে যান এবং সেখানে ‘সুবেদ আলী’ ছদ্মনাম ধারণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনার সিংহভাগ অর্থই তিনি প্রদান করেন।

লেখক : সাবেক ছাত্র, জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর