শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

মালয়েশিয়ায় মাসুদের সফল কৃষি উদ্যোগ

শাইখ সিরাজ

মালয়েশিয়ায় মাসুদের সফল কৃষি উদ্যোগ

চলতি অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর কাতারে রয়েছে মালয়েশিয়া। সে দেশে বহু বাংলাদেশি আছেন, যারা নিজের ভাগ্য অন্বেষণে গিয়েছেন। কোনো দেশে গেলে আমার চেষ্টা থাকে সে দেশের কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে জানা-বোঝার। এর আগেও একাধিকবার আমার মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সে সময় দেখেছি দেশটির ক্যামেরুন হাইল্যান্ডসহ বহু এলাকায় বাংলাদেশিদের কৃষি উদ্যোগ। চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে সেসব প্রতিবেদন আমি তুলে ধরেছি। এবার যাওয়ার আগে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত কৃষি ও গবাদি পশুর খামার সংখ্যা ভালোই বেড়েছে। যদিও এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কেউ দিতে পারেনি। অনেক খামারির সঙ্গেই ফোনে যোগাযোগ হলো তাদের খামার দেখার জন্য। তাদেরই একজন কুষ্টিয়ার মাসুদ, যিনি বিদেশের মাটিতে সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক বাংলাদেশির কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছেন। পাঠক, আজ আপনাদের তাঁর গল্পই বলব।

অক্টোবরের এক সকালে রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে রওনা হলাম শিলংকান জেলার দিকে। প্রায় মিনিট পঞ্চাশের সড়কপথ শেষে পৌঁছালাম শিলংকানের কেলাং থানার জোহানসিটি গ্রামে। এখানেই মাসুদ আহমেদ গড়ে তুলেছেন তাঁর কৃষি খামার। মূলত বছরব্যাপী নানারকম সবজি উৎপাদন করেন। আমাকে দেখে মাসুদ এগিয়ে এলেন। বিশাল এলাকা নিয়ে তাঁর কৃষি কার্যক্রম। ঘুরে দেখতে দেখতে কথা হচ্ছিল মাসুদের সঙ্গে। একে একে বলে যাচ্ছিলেন তাঁর প্রবাসজীবনের গল্প।

২০০৭ সালে ভাগ্যের সন্ধানে একটা কোম্পানির কর্মী হিসেবে মালয়েশিয়ায় আসেন মাসুদ। কিন্তু বছরখানেকের মধ্যেই কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়। সঙ্গের সহকর্মী অনেকেই ফিরে যান দেশে। কিন্তু মাসুদের ফিরে যাওয়ার পথ নেই। টিকে থাকার তাগিদে কিছু একটা করতেই হবে তাঁকে। হাতে সম্বল ছিল বাংলাদেশি টাকায় লাখ তিনেকের মতো। সে টাকায় তিনি জোহানসিটি গ্রামে অল্প জমি নিয়ে শুরু করেন সবজি চাষ। সেখান থেকে লাভের অংশে বাড়তে থাকে তাঁর কৃষি কার্যক্রম। সঙ্গে সঙ্গে দেশের অনেকের কর্মসংস্থানের খাতটিও প্রসারিত হতে থাকে তাঁর হাত ধরে। এখন সব মিলে প্রায় ৯ একর জমিতে তিনি চাষ করছেন নানারকমের শাকসবজি। একেক দিকে চলছে একেক ফসলের উৎপাদন। মাসুদের কৃষি খামারে পরিকল্পিতভাবে উৎপাদনব্যবস্থা সাজানো হয়েছে যেন বছরব্যাপী উৎপাদন নিশ্চিত থাকে সব ধরনের সবজি ফসলের। মাসুদের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে আছেন তাঁর ছোট ভাই রঞ্জু। তাঁদের শাকসবজি চাষের কৌশল দেখে মনে হলো ঈশ্বরদীর কালিকাপুর মডেল অনুসরণ করে একেক বেডে চাষ করছেন একেক সবজি ও শাকের। কলমি শাক, পুঁইশাক, লালশাক, সবুজ শাক, লাউ, কুমড়া থেকে শুরু করে কচুও চাষ করছেন তাঁরা। প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে দৈনিক একটি বেড থেকে শাক উত্তোলন (হার্ভেস্ট) করেন, আবার একটি বেডে নতুন করে শাকের বীজ বপন করেন। এভাবে একই শাক তিনি অনেক বেডে চাষ করছেন। আর প্রতিদিনই উৎপাদিত শাকসবজি বাজারে পাঠাচ্ছেন। মাসুদ বললেন, বেশির ভাগ উৎপাদিত ফসলের বীজ আনা হয় দেশ থেকে। এখানে নিয়োজিত কর্মীরাও প্রায় সবাই বাংলাদেশি। কর্মরত মানুষ আর ফসলি মাঠ দেখে মনেই হয় না এটি মালয়েশিয়া। মনে হয় বাংলাদেশের কোনো এক গ্রামে আছি। কথা হয় খামারের কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে। তাঁরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন। তবে কুষ্টিয়া থেকে আগতের সংখ্যাই বেশি। আবদুল কাইয়ুম দেশ থেকে এসেছেন পাঁচ বছর হয়েছে। প্রতি মাসে বাংলাদেশি টাকায় ৫০ হাজার টাকার মতো আয় তাঁর। খাবার খরচ তেমন নেই বললেই চলে, খামারে উৎপাদিত ফসল বিনামূল্যেই পাচ্ছেন তিনি। সব খরচ বাদে ৪০ হাজার টাকার মতো দেশে পাঠাতে পারছেন। শুধু কাইয়ুম নন, আক্কাস, নবী, মাহমুদসহ ৫০ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন মাসুদ।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বাংলাদেশিদের হাতে রচিত হচ্ছে অন্যরকম কৃষি ক্ষেত্র। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সবজি আবাদে বাংলাদেশিদের সাফল্যের চিত্র আমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি বিভিন্ন সময়। দেখেছি নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাঁরা একেক দেশে ঘটিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন কৃষিবিপ্লব। মালয়েশিয়ায়ও পরিত্যক্ত জমি ভাড়া নিয়ে চাষাবাদ করছেন বাংলাদেশিরা। একেকজন বাংলাদেশিই যেখানে একেকজন সংগ্রামী কৃষিসৈনিক; রেমিট্যান্স যোদ্ধা। যাদের হাতে ফলছে সোনার ফসল। নিজের জন্মস্থান, বসতভিটা, সংসার, পরিবার-সন্তানের মায়া ত্যাগ করে বিদেশের মাটিতে হাড়ভাঙা খাটুনির বিনিময়ে দেশের মানুষের জন্য পাঠাচ্ছেন অর্থ।

আগেই বলেছি মাসুদ আহমেদও একসময় অর্থকষ্টে ভুগেছেন। তারপর কৃষি খামারই বদলে দিয়েছে তাঁর ভাগ্য। এখন তাঁর কৃষি খামারের বাইরে আছে দোকান। আরও আছে নিজস্ব কোম্পানি। কৃষি খামার থেকেই মাসুদের প্রতি মাসে গড় আয় ৩ লক্ষাধিক টাকা। মাসুদ শুধু নিজেই ভালো থাকতে চান না। অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থান সৃষ্টির তাগিদে গড়েছেন দোকান ও বেস্টুরেন্টের ব্যবসা। আগামীতে বাড়াতে চান খামারের আয়তনও। নিয়মিত ভোগ্যপণ্য বা কৃষিপণ্য যা-ই বলা হোক এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছেন এই বাংলাদেশিরা।

মধ্যপ্রাচ্যেও দেখেছি বাংলাদেশিদের বিশাল সবজি বাজার। সেখানে কৃষিপণ্যের বাজার নিশ্চয়তা তৈরি করেই কৃষি আবাদে নেমেছেন বাঙালিরা। এখানেও সেই পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন মাসুদের মতো আরও অনেক বাংলাদেশি উদ্যোক্তা। সবজি, মাছ, মাংস বা ফল সব পণ্যেরই বাজার রয়েছে এখানে। বাংলাদেশিদের কাজের সম্ভাবনাও এখানে অনেক। তবে এ ক্ষেত্রে দরকার পর্যাপ্ত শ্রমিক। তবে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক আনার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশের এজেন্সি ও ব্যবস্থাপনার সংকটে লোকবল আনা কঠিন বলছিলেন মাসুদ।

আমরাও জানি, দীর্ঘ বিরতির পর মালয়েশিয়া শ্রমবাজার খুলে দিয়েছে। যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে প্রায় ১০ লাখ শ্রমিকের। মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমবাজার নিশ্চিত করা, কৃষি উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশিদের সম্ভাবনা এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, এজেন্সি জটিলতার কারণে কার্যক্রমের গতি কিছুটা শ্লথ ছিল। তবে তাঁর দল কাজ করে যাচ্ছে। জানতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের একটা বাজার ছিল মালয়েশিয়ায়, সেটাকে উন্নত করতে কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশিদের কৃষিপণ্যের বাজারের অনেকটা চাহিদা এখানেই বাংলাদেশিরা উৎপাদন করছেন। তবে তিনি বাংলাদেশি কৃষিপণ্যের বাজার আরও বড় করার লক্ষ্যে আরও বেশি পণ্য যেন দেশ থেকে রপ্তানি করা যায় সে পদক্ষেপ ইতোমধ্যে নিয়েছেন। হালাল পণ্য রপ্তানির বিষয়ে কাজ করছেন। কাজ করছেন মালয়েশিয়ানদের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের বিষয়াদি নিয়েও। প্রবাসীদের পাসপোর্ট সমস্যা সমাধান ও সহজীকরণের চেষ্টার কথাও জানালেন গোলাম সারওয়ার।

উন্নত কাজের সন্ধানে কিংবা আর্থিক সচ্ছলতা আনার তাগিদে বিদেশ পাড়ি দিয়ে সত্যিকার অর্থেই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়। মাসুদ নিজের জীবনের অভাব দূরীকরণে বিদেশ পাড়ি দিয়েও পড়েছেন নানারকম প্রতিকূলতায়। তার পরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কৃষি খামারে এনেছেন সফলতা, সৃষ্টি করেছেন বহু মানুষের কর্মসংস্থান। দেশে থাকা বাবা-মা, ভাই-বোনদের জন্যও গড়েছেন বাড়ি, দিয়েছেন আর্থিক সচ্ছলতা। মালয়েশিয়ায় ১০ লাখ প্রবাসী এবং গোটা পৃথিবীতে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশির উন্নয়নের চিত্র এটি। যাদের হাতে আয় করা টাকায় সমৃদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশ। মাসুদের মতো কোটি কোটি মানুষের শ্রমঘামেই নির্মাণ হয়েছে আমাদের উন্নয়নের চিত্র। অথচ বছরের পর বছর তাঁরা প্রবাসজীবনে কত প্রতিকূল পরিবেশে দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন। কিংবা ফসল আর মাটির সঙ্গে জীবন কাটিয়ে বহু বঞ্চনা, অপ্রাপ্তির বিপরীতে শক্ত হাতে হাল ধরে রেখেছেন আমাদের রেমিট্যান্স সমৃদ্ধির। কিন্তু এ রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের এখনো বহু প্রতিকূলতার শিকার হতে হয় শুধু সুপরিকল্পিত নীতিনির্ধারণী না থাকায়। বছরের পর বছর ধরে যেন অনিয়মই কোথাও কোথাও নিয়ম হয়ে আছে। আমার বিশ্বাস, লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের সুবিধা-অসুবিধাগুলো সরকার সুবিবেচনায় নিয়ে খুব দ্রুতই সমাধান দেবে। আরও বিশ্বাস করি, আমাদের অর্থনীতি সচল রাখতে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য স্বচ্ছ ও সহজ নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে গড়ে উঠবে বিদেশি সুষ্ঠু ও বৈধ শ্রমবাজার।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর