মঙ্গলবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বিশ্বাসী বান্দারা রাগ-অভিমানে সীমালঙ্ঘন করে না

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

বিশ্বাসী বান্দারা রাগ-অভিমানে সীমালঙ্ঘন করে না

ষষ্ঠ হিজরি। নবীজি (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.) দীর্ঘ সময় পর মক্কার পথে। হুদায়বিয়া নামক জায়গায় এসে অপেক্ষা করছেন মক্কায় ঢোকার অনুমতির জন্য। উদ্দেশ্য ওমরাহ আদায়। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর জন্মভূমির মাটিতে পা রাখার আনন্দে উৎফুল্ল সবাই। আরব ঐতিহ্য অনুসারে পবিত্র চার মাসে যুদ্ধবিগ্রহ ও রক্তপাত নিষেধ। এ সময়ে শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবাই সর্বত্র অবাধে ও নিঃশঙ্কচিত্তে গমনাগমনের অধিকার রাখে। আরব-ঐতিহ্য অনুসারে হজ ও ওমরাহর উদ্দেশ্যে আগমনকারীদের যথাযোগ্য সম্মান রক্ষা করাও আবশ্যক। এমনকি কোরবানির উদ্দেশ্যে হজ ও ওমরাহকারীরা সঙ্গে করে যে পশু নিয়ে আসেন সেগুলোর সম্মান করাও অনিবার্য। কিন্তু রসুল (সা.) ও সাহাবিদের প্রশ্নে আরবরা নিজেদের জাতীয় স্বকীয়তা হারাল। মুসলিম-বিদ্বেষে পরাভূত হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লালন করে আসা জাতীয় ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে দিল। মক্কায় প্রবেশ নিষেধ করা হলো সাহাবিদের দল। মদিনা থেকে নবীজি (সা.) কেন মক্কায় ওমরাহ করতে এসেছেন তা জানা যাক। কিছুদিন আগে এক রাতে নবীজি (সা.) স্বপ্নে দেখেন, তিনি সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে নিরাপদে মসজিদে হারামে প্রবেশ করছেন। এ স্বপ্নের কথা শুনে সাহাবায়ে কেরামের বিষণ্ণ মনে আশার সঞ্চার হয়- এবার বোধহয় প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হবে! আবার হয়তো বায়তুল্লাহ জিয়ারতের সৌভাগ্য হবে! ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে নবীজি প্রায় দেড় হাজার সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে ওমরাহর উদ্দেশ্যে মক্কাভিমুখে রওনা করে হুদায়বিয়াহ নামক স্থানে এসে পৌঁছান। কিন্তু সংবাদ পেয়ে কাফের বাহিনী পথ রোধ করে দাঁড়ায়। নবীজি তাদের জানান, আমরা যুদ্ধের জন্য আসিনি। কেবল বায়তুল্লাহ জিয়ারতের নিয়তে এসেছি। ওমরাহ করে আবার মদিনায় ফিরে যাব। কিন্তু কাফেররা মক্কায় প্রবেশের অনুমতি দিতে নারাজ। কয়েক দফা বৈঠক ও আলোচনার পর কয়েকটি শর্তারোপের ভিত্তিতে ১০ বছরের জন্য একটি সন্ধিচুক্তি করতে সম্মত হয় তারা। চুক্তির একটি অন্যায় শর্ত ছিল- মুসলিমদের এ বছর ওমরাহ না করেই মদিনায় ফিরে যেতে হবে, আগামী বছর ওমরাহ করার অনুমতি পাবে। তবে আসার সময় নিজস্ব তরবারি ছাড়া আর কোনো যুদ্ধাস্ত্র তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারবে না এবং তিন দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না। অবশেষে নবী (সা.) তাদের এ অন্যায় দাবিও মেনে নেন এবং এ বছর ওমরাহ না করেই ফিরে যাওয়ার মনস্থ করেন। কিন্তু কাফেরদের এ অন্যায় হঠকারিতায় সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত মর্মাহত। তারা এসেছিলেন ওমরাহর নিয়তে, গায়ে ইহরামের শুভ্র পোশাক, সঙ্গে কোরবানির পশুর বহর। ইহরামের লেবাসে থাকা আল্লাহর ঘরের মেহমানদের এরূপ অসম্মান কীভাবে বরদাশত করা যায়?

শেষ পর্যন্ত তাঁরা এ অনাচার মেনে নিতে বাধ্য হন এবং মদিনায় ফিরে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হন। কিন্তু আশাভঙ্গের বেদনা তাদের পীড়া দিয়ে যাচ্ছিল। সম্ভাবনা ছিল মনের দুঃখে তাঁদের কেউ হয়তো কাফেরদের সঙ্গে এমন কোনো আচরণ করে বসবেন, যা শরিয়ত সমর্থন করে না। কিন্তু তাঁরা তো ছিলেন সেই মহান কাফেলা, নবীজির সান্নিধ্যধন্য হওয়ার জন্য যাদের নির্বাচন করা হয়েছিল। আসমান থেকে তাঁদের তারবিয়াতের ব্যবস্থা করা হলো। আল্লাহতায়ালা মোমিনদের সম্বোধন করে ইরশাদ করলেন, ‘তোমাদের মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছিল, এ কারণে কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি অসন্তোষ ও ক্ষোভ যেন তোমাদের তাদের প্রতি সীমালঙ্ঘন করতে প্ররোচিত না করে।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত ২)

এ ছিল ইসলামের এক মহান শিক্ষা। অন্যায়ের বিপরীতে অন্যায় নয়, ইনসাফই অবলম্বন করা। মাসজিদুল হারামে যেতে বাধা দান করে মুসলিমদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছিল, তাই কাফেরদের প্রতি জন্মানো ক্ষোভ ছিল খুবই স্বাভাবিক এবং স্বীকৃতও বটে।

 

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর