প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে উপস্থিত থেকে মেট্রোরেল উদ্বোধন করবেন। একই সঙ্গে তিনি ভ্রমণ করবেন মেট্রোরেলে। মেট্রোরেল যাতায়াত ব্যবস্থায় এক নতুন যুগের সূচনা করবে। দেশের পরিবহন খাতের জন্য এটা বড় ঘটনা। সেবাটি এখন উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু করা হবে। পরে তা বিস্তৃত হবে মতিঝিল পর্যন্ত। যানজটের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট কর্মঘণ্টার মূল্য বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।
মেট্রোরেল সম্প্রসারণের মূল লক্ষ্য ঢাকা মহানগরীতে যানজটের পরিমাণ কমিয়ে আনা। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোর বিভিন্ন এলাকা মেট্রোরেলের আওতায় আনা হবে। এর ফলে ঢাকা শহরের ওপর জনচাপ কমে আসবে। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা এখন বিভিন্ন এলাকার জনগণকে ঢাকা শহরের দিকে টানছে। আশপাশের জেলার মানুষ সেখান থেকেই প্রতিদিন ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন। মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকার যানজট যেমন কমবে, তেমনি জিডিপিও ১ শতাংশ বাড়বে।
যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর একটি দেশের অগ্রগতি বহুলাংশে নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে আরও বেশ কিছু সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। মহাসড়কগুলো চার লেন, আট লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি একসঙ্গে ১০০টি সেতু ও ১০০টি রাস্তা উদ্বোধন করেছেন। সেতুগুলো নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭৯ কোটি ৬১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। আশা করা হচ্ছে, এ সেতুগুলোর মাধ্যমে উন্নয়নের ছোঁয়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে যাবে।১০০টি মহাসড়কের মধ্যে ৯৯টি সরকারি তহবিল থেকে সম্পন্ন হয়েছে, বাকি একটি গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা মহাসড়ক পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার সড়ক ৬ হাজার ১৬৮ দশমিক ৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এডিবি, ওপেক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (আবুধাবি) তহবিলের আওতায়। শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বা অবকাঠামোগত যেসব উন্নয়ন হয়েছে, তার ফলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। পদ্মা সেতুর কারণে মোংলা ও পায়রা বন্দরের কার্যক্রম দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের শিল্পায়নে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এটি সম্পন্ন হলে বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে ঢাকায় পণ্য পৌঁছাতে সময় অর্ধেকেরও কম লাগবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক উন্নয়নের ফলে চটগ্রাম বন্দরে পণ্য পৌঁছানোর সময় অনেক কমে গেছে।
উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের মানুষও মেট্রোরেলে চড়বে। কিছু দিন আগেও এটি ছিল স্বপ্ন। কিন্তু সরকার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছে। মেট্রোরেল রুট-৬ এর পাশাপাশি আরও দুটি রুট নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে মেট্রোরেল রুট-১ এয়ারপোর্ট থেকে বাড্ডা-রামপুরা হয়ে কমলাপুর এবং দ্বিতীয় অংশ খিলক্ষেত থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরীর পূর্ব-পশ্চিমে সংযোগ বাড়াতে চূড়ান্ত করা হয়েছে মেট্রোরেল-৫ এর রুট। এ রুটের দুটি অংশ। নর্দার্ন অংশ গাবতলী হতে হেমায়েতপুর হয়ে ভাটারা পর্যন্ত এবং সাউদার্ন অংশ গাবতলী থেকে হাতিরঝিল হয়ে আফতাবনগর বালুরপার পর্যন্ত। এসব মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শেষ হলে ঢাকা মহানগরীতে দূর হবে যানজট, যাত্রাপথ হবে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময়।
দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর যাত্রী ও কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতার মান ও পরিধি বৃদ্ধির অংশ হিসেবে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ চলছে। কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে সমুদ্রছোঁয়া বিশ্বমানের বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। প্রথমবারের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে জলভাগের ওপর দিয়ে রানওয়ে নির্মিত হতে যাচ্ছে, পৃথিবীর খুব কম সংখ্যক বিমানবন্দরে এ ধরনের রানওয়ে আছে।
সিঙ্গাপুর-ব্যাংককের আদলে সাজানো হচ্ছে কক্সবাজারকে। সমুদ্রের জলে রানওয়ে নির্মাণের গ্রাউন্ড-ব্রেকিংয়ের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের আরেক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। বিশ্বের উপকূলীয় শহরে অবস্থিত সেরা বিমানবন্দরের মধ্যে অন্যতম হবে কক্সবাজার বিমানবন্দর। এ ছাড়া সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীতকরণের কাজ শুরু হয়েছে। নেপাল, ভুটানসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এ বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারবে। যার ফলে পুরো উত্তরবঙ্গেই উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে। বাগেরহাট জেলায় খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণসহ যশোর, সৈয়দপুর ও বরিশাল বিমানবন্দর এবং রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। রাজধানীতে পাতালরেল এবং পুরো দেশে বুলেট ট্রেন চালুর পরিকল্পনাও সরকারের মাথায় রয়েছে। অবকাঠামো খাতের এ বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে যাত্রীরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সহজভাবে যাতায়াত করতে পারবে।
উন্নয়নের সাফল্য ধারায় বাংলাদেশ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরকে অনুসরণ করছে। এ দুটো দেশ দীর্ঘদিন একটা শক্তিশালী উন্নয়ন কাঠামোর ভিতর দিয়ে গেছে। সরকারের দূরদর্শিতা ও দক্ষ নেতৃত্বে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ এখন সত্যিকার অর্থেই উন্নয়নের একটি পরিষ্কার ও স্থিতিশীল পথে আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অবকাঠামোর যে উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে তা সত্যিই অভাবনীয়। এতে দেশের উন্নতিও ত্বরান্বিত হবে। যোগাযোগ খাতের বিস্ময়কর উন্নতি দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনসহ সামগ্রিক অর্থনীতির ভিত্তিকে আরও মজবুত ও অকম্পিত রাখবে।
লেখক : পরিচালক, বিজিএমইএ