শিরোনাম
শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

পাকিস্তানিদের সারেন্ডারের পরও দেড় মাস বিহারিদের দখলে ছিল মিরপুর

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অব.)

পাকিস্তানিদের সারেন্ডারের পরও দেড় মাস বিহারিদের দখলে ছিল মিরপুর

উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মেট্রোরেলে আগারগাঁওয়ের পথে চলেছি। উত্তরার বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তর, শস্য খেত, লেক, মিরপুর ডিওএইচএস ও সেনানিবাস হয়ে মিরপুরের বুক চিরে চলেছে সিলভার রঙের বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল। মিরপুর ১২ ও ১১ নম্বর সেকশন অতিক্রমকালে মনে পড়ল ৫১ বছর আগে এখানে ঘটে যাওয়া বিভীষিকাময় এক ঘটনার কথা। বিজয়ের প্রায় দেড় মাস পর ১৯৭২-এর ৩১ জানুয়ারি মুক্ত হয়েছিল এই অবরুদ্ধ উপশহর। অস্ত্রধারী অবাঙালিদের এই শক্ত ঘাঁটি মুক্ত করতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর শতাধিক সদস্য।

মিরপুর ও মোহাম্মদপুর ছিল মূলত বিহারি ও উর্দুভাষী (সাধারণভাবে বিহারি বলে পরিচিত) অধ্যুষিত এলাকা। বেশির ভাগ শ্রমিক শ্রেণি ও ছোট ব্যবসায়ীরা মিরপুরে থাকত। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে অনেক বিহারি বা উর্দুভাষী পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগীরূপে বাঙালির ওপর ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। ১৬ ডিসেম্বরই ভারতীয় বাহিনী (১০ বিহার রেজিমেন্ট) মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে পাহারা বসায়, যাতে বিহারিদের জানমাল রক্ষা পায়।

ঢাকার বাসিন্দারা তখন বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হলেও শহরের উপকণ্ঠ মিরপুর তখনো ‘স্বাধীন’ হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পর ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের অনেক বিহারি সদস্য, দলছুট পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও বিহারি মিলিশিয়া অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিরপুরে আশ্রয় নেয়। ফলে মিরপুরে সশস্ত্র অবাঙালিদের শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে ওঠে।

বাংলাদেশের সর্বত্র পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করলেও মিরপুরের বিহারিরা তখনো অস্ত্র সমর্পণ করেনি। বিভিন্নভাবে বারবার আহ্বানের পরও আত্মগোপনকারী সশস্ত্র বিহারিরা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনী ও পুলিশের মাধ্যমে মিরপুরে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের নির্দেশ দেন।

ঢাকা সেনানিবাসে তখন ভারতীয় বাহিনী অবস্থান করছিল। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় প্রবেশকারী নিয়মিত বাহিনীর প্রথম ব্যাটালিয়ন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ১৯৪৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যবাহী ও মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ভূমিকা পালনকারী এই পদাতিক ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী বীরবিক্রম (পরে মেজর জেনারেল)। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বেঙ্গল ছিল এস ফোর্সের (যা ৪৬ পদাতিক ব্রিগেড রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় ছিল) নিয়ন্ত্রণাধীন, যার অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল কে এম শফিউল্লাহ (পরে মেজর জেনারেল বীরউত্তম ও প্রথম সেনাবাহিনী প্রধান)।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়ে ‘বাংলাদেশ বাহিনী’র প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী দ্বিতীয় বেঙ্গলের অধিনায়ককে এক কোম্পানি সেনা মিরপুর পাঠাতে বলেন। জেনারেল ওসমানীর আদেশ পেয়ে ২৯ জানুয়ারি বিকালে তৎকালীন ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান বীরবিক্রমের (পরে মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে ডি কোম্পানির প্রায় ৭৫ জন সেনা মিরপুর ২ নম্বর সেকশনে পৌঁছায় ও ১০ বিহার রেজিমেন্ট থেকে দায়িত্বভার গ্রহণ করে। ভারতীয় মেজর বাংলাদেশের ক্যাপ্টেন মোর্শেদকে বলেন, ‘এভরিথিং ইজ ফাইন হিয়ার অ্যান্ড উইশ ইউ গুড লাক’ (এখানে সবকিছু ঠিক আছে এবং তোমার জন্য শুভেচ্ছা)। আশ্চর্যজনক হলো, ওই মেজর বিহারিদের অস্ত্র সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য দেননি। এদিকে পুলিশ ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকেও সুনির্দিষ্টভাবে বিহারিদের অস্ত্র, গোলাবারুদ সম্পর্কে তেমন উল্লেখযোগ্য তথ্য পাননি ক্যাপ্টেন মোর্শেদ। এ তথ্য ঘাটতিই পরে সবার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। যা হোক, ৩০ জানুয়ারি সকালে কোম্পানির সদর দফতরে অ্যাডিশনাল এসপি জিয়াউল হক খান লোদির নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আসেন এবং অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের কার্যপ্রণালি নিয়ে আলোচনা করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, সেনাবাহিনী এলাকার নিরাপত্তা বিধান করবে এবং পুলিশ সদস্যরা বিহারিদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধীদের গ্রেফতার করবে। সেদিন মিরপুরে কারফিউ জারি করা হয়। এখানে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ছিল মূলত ইন এইড অব সিভিল পাওয়ার বা অসামরিক প্রশাসনের সাহায্যে অপারেশনের মতো।

পরিকল্পনামতো সকাল প্রায় ১০টায় পুলিশ বাহিনীর প্রায় ১০০ ও সেনাবাহিনীর প্রায় ৭৫ জন সদস্য অস্ত্র উদ্ধারের জন্য ১১ ও ১২ নম্বর সেকশন এলাকায় পৌঁছায়। এরই মধ্যে মেজর মইন একটি জিপে করে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসানকে ১২ নম্বর সেকশন এলাকায় পৌঁছে দেন। উল্লেখ্য, লে. সেলিম তখন প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর নিরাপত্তা অফিসার হিসেবে বঙ্গভবনে কর্মরত ছিলেন। প্রায় একই সময় ১২ নম্বর সেকশনে এসে পৌঁছান বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা-সাহিত্যিক জহির রায়হান। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন তাঁর বড় ভাই বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের সন্ধানে।

উদ্ধার অভিযানের বড় একটা অংশ তখন ১২ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকের পানির ট্যাংকির কাছে অবস্থান করছিল। বেলা প্রায় ১১টার দিকে ১২ নম্বর এলাকায় পুলিশ ও সেনা সদস্যরা যখন অস্ত্র উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেন, ঠিক এর কিছুক্ষণ পর অপ্রত্যাশিত ও অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে। ঢং ঢং করে কয়েকটি পাগলাঘণ্টি বেজে ওঠে ও হইহই আওয়াজ হয়। চারদিকের বিভিন্ন বাড়িঘর থেকে অতর্কিতে একযোগে ক্যাপ্টেন মোর্শেদের নেতৃত্বাধীন সেনা ও পুলিশের ওপর বিহারিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি দিয়ে প্রচ- আক্রমণ চালায়। লুকিয়ে থাকা বিহারিদের এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ফলে চারদিকের প্রচ- আক্রমণের মাঝে পড়ে পুলিশ ও সেনারা ব্যাপকভাবে হতাহত হন। তারা পাল্টা আক্রমণের তেমন সুযোগই পাননি। এটি ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত আক্রমণ।

কোম্পানি কমান্ডার ক্যা. মোর্শেদ ও লে. সেলিম আহত হন। আহত হয়েও তারা কয়েকজন সৈনিক নিয়ে দল গঠন করে পাল্টা আক্রমণের আপ্রাণ চেষ্টা চালান। বিহারিদের মধ্যে কয়েক হাজার প্রশিক্ষিত অস্ত্রধারী থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১২ নম্বর সেকশনের প্রতিটি লেনের বাড়ির জানালা ও ছাদে বিহারি অস্ত্রধারীরা পজিশন নিয়ে টার্গেট করে বসে ছিল। এদিকে ১১ নম্বর সেকশনে অবস্থানকারী সেনাদের ওপরও আক্রমণ আসে। তবে তারা সে আক্রমণ প্রতিহত করে।

আক্রমণের খবর শুনে মেজর মইন বি কোম্পানিকে নিয়ে ১২ নম্বর সেকশনের উল্টো দিকে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কাছে অবস্থান নেন। ৬ নম্বর সেকশনে দুপুরের দিকে কর্নেল শফিউল্লাহর গাড়িও বিহারিদের গুলিতে আক্রান্ত হয়।

বিকালে দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকরা ভারী অস্ত্র নিয়ে ১২ নম্বর সেকশনে আক্রমণ চালায়। রাতে মর্টার নিক্ষেপ করা হয়। তবে তারা ১২ নম্বর সেকশনে যেখানে মূল যুদ্ধ চলছিল সেখানে পৌঁছাতে পারেনি। সেখানে বিহারিরা প্রচ- প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আহত ক্যাপ্টেন মোর্শেদ তার ক্ষুদ্র দল নিয়ে কালাপানির বিল অতিক্রম করে সন্ধ্যার দিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দিকে (বালুরঘাট) চলে আসতে সক্ষম হন। রাতে মিরপুর যুদ্ধের দায়িত্ব মেজর মইন গ্রহণ করেন। পরদিন অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি রমনা রেসকোর্স থেকে সমগ্র ব্যাটালিয়নকে মিরপুরে নিয়োজিত করা হয়।

৩১ জানুয়ারি ১২ নম্বর সেকশনে সকাল ১০টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলে। সেনাদের চারদিকে সতর্কতার সঙ্গে মোতায়েনের পর দ্বিতীয় বেঙ্গলের সেনা কর্মকর্তারা ১২ নম্বর সেকশনে আসেন। সেখানে বিহারিদের বেশ কিছু মৃতদেহ পাওয়া যায়। ওইদিন সেই এলাকায় কোনো পুরুষ ছিল না। তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। দুপুরে বেশ কিছু অস্ত্রধারী বিহারি ও অবাঙালি সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই ৩১ জানুয়ারি অবরুদ্ধ মিরপুর ওইদিন সেনাবাহিনী তথা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে ও মুক্ত হয়।

৩১ জানুয়ারি সকালে ঊর্ধ্বতন সেনা কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে উপলব্ধি করেন যে, পুরো মিরপুর অস্ত্রমুক্ত করতে, অস্ত্রধারী ও অপরাধীদের গ্রেফতার করতে হলে আরও সেনা প্রয়োজন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪ ইস্ট বেঙ্গল ও ৯ ইস্ট বেঙ্গল মিরপুরে মোতায়েন করা হয়। তিনটি ব্যাটালিয়ন প্রায় এক মাসের অভিযানের পর মিরপুরে বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে সেনাবাহিনী। এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।

৩০ জানুয়ারির অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানটি একপর্যায়ে রক্তাক্ত যুদ্ধে পরিণত হয়। এ যুদ্ধে দ্বিতীয় বেঙ্গলের লে. সেলিম, সুবেদার আবদুল মোমিন ও ৪০ জন অন্য পদবির সৈনিক অর্থাৎ মোট ৪২ জন সেনা সদস্য শহীদ হন। বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী, মিরপুরে পুলিশ বাহিনীর ৫৩ জন সদস্য শহীদ হয়েছিলেন। তবে অন্য একটি সূত্রমতে, এ সংখ্যা ৮২। শহীদ হন দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তা অ্যাডিশনাল এসপি জিয়াউল হক খান লোদি ও সার্কেল ইন্সপেক্টর এস এম এ ওয়াহিদ। এখানেই জহির রায়হান প্রাণ হারান, শহীদ হন। এখানে বেশ কয়েকজন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন। দুঃখজনকভাবে কোনো শহীদের লাশ পাওয়া যায়নি। বিহারিরা রাতেই সব লাশ সরিয়ে ফেলে। তবে ৪ ফেব্রুয়ারি একটি ঝিলের পাড়ে পাওয়া একটি মৃতদেহের ক্ষুদ্র অবশিষ্টাংশকে লে. সেলিমের মৃতদেহ বলে শনাক্ত করা হয়। পরে এই শহীদের দেহাবশেষ বনানী সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ছাড়া উভয় বাহিনীর জীবিত সদস্যদের প্রায় অর্ধেকই আহত হয়েছিলেন। এতই ছিল এই যুদ্ধের ব্যাপ্তি ও কঠিনতা।

লে. সেলিমের ছোট ভাই লে. মো. আনিসুল হাসান বর্তমানে ডা. এম এ হাসান নামে পরিচিত। ঢাকায় ১৯৭১ -এর ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকেই দুই ভাইয়ের এক ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়। এরপর দুই ভাই ৩১ মার্চ ভৈরবে দ্বিতীয় বেঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৩ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লালপুরের যুদ্ধে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে দুজন নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। এরপর পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে শাহবাজপুর, শাহজীবাজার, নাসিরনগর, হরষপুর, মনতলা, তেলিয়াপাড়াসহ অসংখ্য যুদ্ধ করেন সেলিম ও হাসান ভ্রাতৃদ্বয়। ভারতের মূর্তিতে ট্রেনিং সম্পন্ন করে দুজন প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের সঙ্গে সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। দুজনই আবার দ্বিতীয় বেঙ্গলে ফিরে আসেন। এদিকে লে. সেলিম ফেনীর বিখ্যাত বিলোনিয়া যুদ্ধে শরিক হন। এরপর আসে বিখ্যাত আখাউড়ার যুদ্ধ।

৩০ জানুয়ারি বেলা ১১টায় মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের পানির ট্যাংকির কাছে অবস্থান ছিল লে. সেলিমের। বিহারিরা ফায়ারিং শুরু করলে প্রথম দিকেই মারাত্মকভাবে তিনি আহত হন। সেলিম সেখানে লুটিয়ে পড়লে তাঁকে একটি ঘরে নিয়ে যান হেলাল মোর্শেদ। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে উঠে দাঁড়ান সেলিম। নিজের শার্ট দিয়ে বেঁধে ফেলেন তাঁর বুক। অলৌকিক শক্তি যেন ভর করে তাঁর দেহে।

প্রথম কয়েক ঘণ্টা মোর্শেদ ও সেলিম প্রায় কাছাকাছি ছিলেন। তাঁরা চরম বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতেও পাঁচ-ছয় জন সৈনিক নিয়ে গ্রুপ করে প্রতিরোধ তৈরি করেছিলেন। জানা যায়, দিনের শেষে কয়েকজন সৈনিক নিয়ে কালাপানির ঢালের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন লে. সেলিম। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ফ্যাকাসে ও ক্লান্ত। কভার ফায়ার দিয়ে সহযোদ্ধাদের বিল পার হয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দিকে যেতে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। নিজে পানিতে নামেননি। বুকের ক্ষত পানিতে ডুবে যাবে এ কারণে। হয়তো এখানেই কোনো একসময় বিহারিদের গুলিতে শহীদ হন সাহসী বীর লে. সেলিম।

মিরপুরে বিহারিদের হত্যা, নির্যাতন ও মিরপুর যুদ্ধের বিষয়টি পুনরায় ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে ১৯৯৯ সালে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এ সময় বধ্যভূমি খনন, শহীদদের দেহাবশেষ ও অন্যান্য নিদর্শন উদ্ধারের কাজে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী (৪২ ইস্ট বেঙ্গল) মোতায়েন করে। এ সময় ভোরের কাগজের তরুণ মেধাবী অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক মিরপুর রণাঙ্গনের ইতিহাস বিশেষত জহির রায়হানের অন্তর্ধান রহস্য অনুসন্ধান শুরু করেন। এই সাংবাদিক পরে ‘মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন মিরপুর : জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্যভেদ’ শীর্ষক অসাধারণ একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ৩০ জানুয়ারি আনুমানিক রাত ৮টায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিরপুরের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছিলেন কর্নেল শফিউল্লাহ। বঙ্গবন্ধু খুব চিন্তিত হয়ে জানতে চেয়েছিলেন অপারেশনের অবস্থা। রাতে বঙ্গবন্ধু একবার মিরপুর পুলিশ ফাঁড়িতে টেলিফোন করে সেখানে দায়িত্বরত দ্বিতীয় বেঙ্গলের হাবিলদার ওয়াজেদ আলী বার্কির (পরে অনারারি ক্যাপ্টেন) সঙ্গে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু একপর্যায়ে বলেন, ‘ইনশা আল্লাহ কোনো অসুবিধা হবে না, কাল আমি চারদিক দিয়ে সৈন্যবাহিনী আনাচ্ছি।’ ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লে. সেলিমের পিতা দেখা করলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সেলিম আমার সন্তানের মতো। আমি তাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেব।’ বনানী সামরিক কবরস্থানে লে. সেলিমের কবরে লেখা আছে ‘মিরপুর মুক্তিদাতা শহীদ লে. সেলিম’।

মিরপুরের মুক্তির জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশের যেসব সদস্য নিজের দেহের রক্ত ঝরিয়ে যুদ্ধ বিজয়ের পথ খুলে দিলেন তাদের যেন আমরা না ভুলে যাই। মিরপুরের এসব শহীদের আমরা কীভাবে সম্মানিত করব, কীভাবে স্মরণ রাখব? যাঁরা দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করেন তাঁদের সম্মান করলে ভবিষ্যতের বীরেরা উৎসাহিত হবেন। লে. সেলিমসহ সব শহীদকে সম্মান জানানো ও তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি।

লে. সেলিমের অপেক্ষায় থেকে অবশেষে ওপারে চলে গেছেন তাঁর বাবা-মা। শুধু রয়ে গেছেন অনুজ লে. আনিস (ডা. এম এ হাসান)। ভাই হারানোর শোক, সহযোদ্ধা ও লাখ লাখ স্বদেশবাসী হারানোর বেদনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাকে তিনি ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছেন। ৫১ বছর পর এই আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা কী? ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে সংঘটিত বিপর্যয়মূলক ঘটনাটি সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর শোকের দিন। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষারও দিন। এটি স্মরণ করিয়ে দেয়, এ ধরনের জটিল অভিযানের আগে ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ (তথ্য সংগ্রহ), সতর্কতা, প্রয়োজনীয় রিকনিশন্স, এলাকা পরিচিতি, সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সময় নিয়ে প্রস্তুতি (তাড়াহুড়া না করা) ইত্যাদি কত গুরুত্বপূর্ণ। এটিই ছিল সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের সময় শহরাঞ্চলে সংঘটিত একমাত্র ক্ল্যাসিক ‘বসতি এলাকায় যুদ্ধ’ বা ফাইটিং ইন বিল্ডআপ এরিয়া। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল মূলত গ্রামাঞ্চলে। তবে প্রতিরোধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইপিআর বাহিনী চট্টগ্রাম নগরীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বসতি এলাকায় কয়েকটি খন্ডযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, যা ছিল বীরত্বপূর্ণ।

উল্লেখ্য, বসতি এলাকায় যুদ্ধ হলো বৃহত্তর আরবান ওয়ারফেয়ারের (নগরাঞ্চলে যুদ্ধ) অন্তর্ভুক্ত। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যদি কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে বসতি এলাকা যুদ্ধ হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর তাই সেনাবাহিনীর জন্য মিরপুরের যুদ্ধ ‘বসতি এলাকা যুদ্ধের’ কেস স্টাডির অনন্য উদাহরণ হতে পারে।

উর্দুভাষী ও বিহারিদের একটা অংশ ’৭১ সালে জেনোসাইডাল পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হয়ে গণহত্যা চালিয়েছে। তাদের হত্যা ও নির্যাতনের ধরন ছিল চরম নিষ্ঠুর, বীভৎস। একইভাবে এ কথাও সত্য, তাদের উত্তর প্রজন্ম কোনো দোষ করেনি। তাদের বড় অংশই বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া নারী-পুরুষ। এরা কেউ একাত্তর দেখেনি।

দেশের আদালত ক্যাম্পবাসী কয়েকজন বিহারির আবেদন মীমাংসা করে মত দেন, ‘এই ক্যাম্পবাসী উর্দুভাষী বাংলাদেশি’ এবং ‘তাদের ভোটার হতে ও জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে বাধা নেই।’ বাংলাদেশের মহত্তম এক ঘটনা হলো, বাংলাদেশ তার পুরনো উর্দুভাষীদের পরবর্তী প্রজন্মকে এভাবে মৌলিক অধিকার চর্চার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

মিরপুরসহ অন্যান্য স্থানের বিহারিদের অধিকাংশই এখন ‘উর্দুভাষী বাংলাদেশি’। ক্যাম্পের অমানবিক পরিবেশে কয়েক লাখ বিহারি বেঁচে থাকার লড়াই করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় বিহারিদের উপযুক্ত পুনর্বাসনের কথা বলেছেন। বাংলাদেশে থাকতে ইচ্ছুক উর্দুভাষীদের অন্য বাংলাদেশির মতো বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এটাই সংগ্রামী বাঙালির সৌন্দর্য ও মানবিকতা।

৫১ বছর পর পেরিয়ে গেছে। অনেক জল বয়ে গেছে তুরাগের স্রোত বেয়ে বুড়িগঙ্গায়। বাঙালি, অবাঙালি, পাহাড়ি, মুসলমান, অমুসলমান সবাইকে নিয়ে সব বিভাজন বাদ দিয়ে এখন এগিয়ে যাওয়ার সময়। বাংলাদেশ হয়ে উঠুক ৫০ রকম (জাতিসত্তা) বর্ণিল ফুলের সুরভিত বাগান। সবচেয়ে পরে মুক্ত হওয়া মিরপুর যেন উন্নয়নে সবচেয়ে পিছিয়ে না থাকে। ব্যাপক উন্নয়ন শুরু হোক অবহেলিত ও অনুন্নত এই জনপদে। মিরপুর যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা- আমাদের সব শহীদকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা, অভিবাদন। পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁদের জান্নাতবাসী করুন।

 

লেখক : গবেষক, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের সাবেক অধিনায়ক

সর্বশেষ খবর