শনিবার, ৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্মার্ট কৃষির যুগে

শাইখ সিরাজ

স্মার্ট কৃষির যুগে

বৈশ্বিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ১০০০ কোটি এবং বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে প্রায় ২২-২৫ কোটি; কাজেই এই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার বিষয়টি মাথায় রেখে, এসডিজিকে সামনে নিয়ে আমাদের কৃষি ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে হবে। আশার কথা দিন দিন বাংলাদেশের কৃষি হয়ে উঠছে বৈচিত্র্যপূর্ণ। ধান-পাটের বাইরে এসে দেশের চাষের জমিগুলো ভরে উঠেছে নানারকম ফল ফসলে। ফলে বহুমুখী কৃষিপণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য একটি বৈচিত্র্যময় কৃষিপণ্যেরও হাব হয়ে উঠতে পারে। আর তার জন্য দরকার স্মার্ট কৃষি ও তার সফল বাস্তবায়ন।

বর্তমানে আমরা এক যুগসন্ধিক্ষণে অবস্থান করছি। বলা যায় পুরো পৃথিবী ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’ বা ‘ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুল্যুশন’-এর যুগে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। নানা খাতেই এই প্রযুক্তি যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছে। ফলে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে দুর্দান্ত গতিতে। কৃষি খাতের আঙ্গিকে বলা যায়, এ প্রযুক্তি পরিবেশের ওপর ন্যূনতম প্রভাব ফেলে কম খরচে অধিক ফলন ও পুষ্টি নিশ্চিত করা যায়। সে বিবেচনায় উন্নত বিশ্বের কৃষিব্যবস্থা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে।

গত সপ্তাহে কৃষি তথ্য সার্ভিস আয়োজিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট কৃষির ভূমিকা’ শীর্ষক একটি সেমিনারে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

আমি দেশ-বিদেশের কৃষিতে রোবটিকস, ইন্টারনেট অব থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কিছু উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করি।

গত বছর নেদারল্যান্ডসের রয়্যাল আইকোলকাম্প নামে কৃষি গবেষণা ও পরামর্শ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেখানকার গবেষক ফোন্স আমাদের রেইনফল ডিটেক্টর দেখিয়েছিলেন। সেটি সোলার এনার্জিতে চলে। বৃষ্টির পরিমাণ ও বাতাসের গতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় সেখান থেকে। আইকোলকাম্পের বিজনেস ইনোভেশন স্ট্র্যাটেজি বিভাগের ড. ইয়োখেন ফরুবিখ বলছিলেন, মাঠে যে ইভাপোরিমিটার রয়েছে তার তথ্য অনুযায়ী ৬৫% বৃষ্টির পানিই বাষ্পীকরণ হয়ে যায়। মাটিতে কী পরিমাণ পানি আছে, কী পরিমাণ পানি প্রয়োজন, বৃষ্টির পানি কতটা মাটি ধরে রাখতে পারছে এসব তথ্য কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফোন্স বলেছিলেন, ‘ছয় বছর আগে ইভাপোরিমিটার আবিষ্কার না হলে জানতেই পারতাম না যে নেদারল্যান্ডসের ৬৫% পানি বাষ্পীকরণ হয়।’ বিগডেটা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাদের কাছে ধরা পড়ছে প্রকৃতির সব বিস্ময় যা পরিবেশের জন্য মঙ্গলজনক। সেন্সরের সাহায্যে সব রিয়েল-টাইম ডেটা চলে যায় তাদের কন্ট্রোল সেন্টারে। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাটি ও পানির ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। মাটিতে কী পরিমাণ পানি আছে তা তারা সব সময়ই পরিমাপ করতে থাকে সেন্সরের সাহায্যে। ফলে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না, থাকলেও কতটুকু সেচ দিতে হবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে যন্ত্র। অফিসে বসে থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ জন্য তরুণদের কাছে এ ধরনের কৃষি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তরুণরা কৃষিতে অংশ নিচ্ছে। কৃষি তাদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় একটা পেশা। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তির কল্যাণে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে সমস্যাগুলো বিশ্ব মোকাবিলা করছে তার কিছুটা সমাধান পাওয়া যাচ্ছে প্রযুক্তির ব্যবহারে।

২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার সুযোগ হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় তখন হাড়কাঁপানো শীত। ভরদুপুরেই তাপমাত্রা মাইনাস ১। সেই কনকনে ঠান্ডার দিনে সিউল থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চুংনাম প্রদেশে কিম নামের এক কৃষকের দুগ্ধ খামারে পৌঁছলাম। কিমের খামারটিকে খামার না বলে একটা দুগ্ধশিল্প প্রতিষ্ঠান বলাই ভালো। দক্ষিণ কোরিয়ায় এ ধরনের দুগ্ধ খামার পরিচালনায় স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে বড় বড় কোম্পানির সক্রিয় সহায়তা রয়েছে। উদ্যোক্তা কিমের খামারটি বেশ বড়। সে তুলনায় কর্মী খুব একটা চোখে পড়ল না। প্রযুক্তির এই সুবিধা, যন্ত্রই সামলে নিচ্ছে সব। এমনকি খামারের পরিবেশ, আলো-হাওয়াও নিয়ন্ত্রণ করছে বেশ সূক্ষ্মভাবে। আবহাওয়া ও পরিবেশ যে কোনো প্রাণীর সুস্বাস্থ্যের জন্য অনুকূলে থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো যেখানে প্রচণ্ড শীত ও প্রচণ্ড গরম থাকে সেখানে এসব তথ্য সম্পর্কে সব সময়ই আপডেট থাকতে হয়। আর এ ক্ষেত্রে স্মার্ট প্রযুক্তি খুবই কার্যকর। কিম বলেছিলেন, কোরিয়ার আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন। তাই খামারের তাপমাত্রা নিয়ে সব সময় সচেতন থাকতে হয়। ভালো উৎপাদন পেতে হলে প্রাণীগুলোকে পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি দিতে হয় ভালো পরিবেশ। আমাদের দেশের খামারিরা এগুলো নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করেন। শীতে যেমন গরুর জন্য তৈরি করেন চটের জামা। গরমে থাকে ফ্যানের বাতাস। আমাদের দেশীয় পদ্ধতি থেকে ভিন্নতাটা হচ্ছে স্মার্ট খামারে এটা একেবারে হিসাব করা। ঠিক কখন কতটুকু আলো-বাতাস প্রয়োজন সবটুকুই নিয়ন্ত্রণ করছে প্রযুক্তি। খামারে অনেক ফ্যান। সেগুলো অটোমেটিক। যন্ত্র যখন বুঝবে অতিরিক্ত বাতাস প্রয়োজন তখন আপনাআপনি সেগুলো চালু হয়ে যায়। কিমের খামারটির বয়স চার বছর হলেও স্মার্ট প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে এসেছেন দুই বছর হয়েছে। স্মার্ট প্রযুক্তির কৃষির প্রধান প্রশ্নই বিনিয়োগে।

হার্ডওয়্যারের পাশাপাশি একটা বড় বিনিয়োগ রয়েছে সফটওয়্যারেও। কিম জানান, স্মার্ট খামার তৈরির খরচটা একটু বেশিই। তবে খরচের তুলনায় লাভ বেশ ভালোই। কিম আরও তিন খামারির সঙ্গে যুক্ত হয়ে একসঙ্গে চারটি খামারের জন্য এই প্রযুক্তি নিয়েছেন। হার্ডওয়্যারে খরচ হয়েছে প্রায় ১২ কোটি ইয়োন আর সফটওয়্যারে ১৫ কোটির মতো। প্রযুক্তির ব্যবহারে লাভও পাচ্ছেন কিম। ১২০টি গাভীর মধ্যে দুধ পান ৮০টি থেকে। প্রতিটি গরু প্রতিদিন প্রায় ৩৪ লিটার করে দুধ দেয়। সব মিলে প্রতিদিন পাচ্ছেন প্রায় ২ হাজার ৫০০ লিটার দুধ। প্রযুক্তি ব্যবহারের পর আগের থেকে প্রতিটি গরু থেকে প্রায় ৭ লিটার দুধ বেশি পাচ্ছেন। কিমের খামারের দুধ দোহানোর সিস্টেমটি নেদারল্যান্ডসের ডো মার্কের মতো ততটা আধুনিক না হলেও যান্ত্রিক ও স্বয়ংক্রিয়। দুধের গুণগতমান, পরিমাণ থেকে শুরু করে গাভীর শারীরিক অবস্থার একটা রিডিং পাওয়া যায় কম্পিউটারে। সেখান থেকে সরাসরি দুধ চলে যায় চিলিং কক্ষে। কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সেখান থেকেই দুধ প্যাকেটজাত হয়ে চলে যায় বাজারে, গ্রাহকের কাছে। কিমের পুরো খামারের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় একটা কক্ষ থেকে। ওটাই কিমের অফিস, যেখানে রাখা হয়েছে মূল কম্পিউটার ও রাউটার। এটাকে বলা হচ্ছে বেজস্টেশন। প্রতিটি গরুর কলারে থাকা চিপটির সঙ্গে বেজস্টেশনের সব সময় তথ্য আদান-প্রদান হয়। অনেকটা জিপিএস চিপের মতোই। গরু যদি তার চাহিদামতো খাদ্য না খায়, কিংবা তার স্বাভাবিক চাঞ্চল্য না থাকে তাহলে চিপটি অটোমেটিক তথ্য প্রেরণ করবে বেজস্টেশনে। সেখানে বসেই কিম তথ্য পেয়ে যাচ্ছেন কম্পিউটারে। এমনকি যেখানেই থাকুক, কিমের মোবাইল ফোনে নোটিফিকেশন চলে আসছে। কিম একজন সহকারী নিয়ে মাত্র দুজনেই পুরো খামারটি দেখাশোনা করতে পারছেন শুধু প্রযুক্তির কল্যাণে।

নেদারল্যান্ডসের বারেনড্রেখ্ট এলাকায় বিশাল বিশাল সব গ্রিন হাউস। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বড় বড় সব কারখানা। সেখানে কোনো গ্রিন হাউসই ৫ হেক্টরের কম নয়। সবচেয়ে বড়টি ১২৫ হেক্টর জমির ওপর। সারি সারি অসংখ্য গ্রিন হাউস। ২০১৪-১৫ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসে এত বেশি গ্রিন হাউস নির্মাণের হিড়িক পড়ে যে, দেশটি পরিচিত হয়ে উঠছিল গ্লাস হাউসের দেশ হিসেবে। পরবর্তীতে গ্রিন হাউস নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। সেচের জন্য ব্যবহার হচ্ছে বৃষ্টির পানি। নালার মাধ্যমে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয়। ওখানকার পানিতে মাছ চাষও হচ্ছে। আর সোলার প্যানেলে উৎপাদন হয় বিদ্যুৎ। গ্রিন হাউসগুলো শুধু খাদ্যই উৎপাদন করে না, বলা যায় একেকটা গ্রিন হাউস একেকটা পাওয়ার হাউস। প্রতিটি গ্রিন হাউস তাদের বিদ্যুৎ চাহিদার শতকরা ৯০ ভাগ নিজেরাই উৎপাদন করে। বাকি ১০ ভাগ পূরণ হয় প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে।

৩৫-৩৬ বছর বয়সের তরুণ ইয়ন ফান ডের অলেখের ক্যাপসিকামের গ্রিন হাউসে গিয়েছিলাম আমরা। ৮.৬ হেক্টর জমির গ্রিন হাউসটিতে প্রায় ২ লাখ ক্যাপসিকামের গাছ। গ্রিন হাউসের দুই পাশে ক্যাপসিকামের চাষ। মাঝখানে চলছে বাছাই আর প্যাকেজিং। গাছ থেকে তোলা ক্যাপসিকাম নিয়ে আসছে রোবট। প্রোগ্রামিং করা। একটার পর একটা ঢেলে দিচ্ছে সর্টিং প্যানেলে। কোনোটিই কোনোটির সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে না। একটি রোবট চলে যাচ্ছে বাগানের দিকে ফসল তুলে আনতে, হয়তো আর একটি রোবট ফসল তুলে নিয়ে ফিরছে। দুটি রোবট ক্রস করার সময় একটা থেমে যাচ্ছে। একটা রোবট চলে যাওয়ার পর অন্যটি যাচ্ছে। যেন প্রত্যেকটিই নিয়ম মেনে চলছে। গ্রিন হাউসটি থেকে প্রতি বছর ২.৫ হাজার টন ক্যাপসিকাম উৎপাদন করা হয়। তারা শুধু লাল ক্যাপসিকামের চাষই করেন। উৎপাদিত ক্যাপসিকাম চলে যায় নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম এবং জার্মানির বাজারে।

আমাদের দেশেও প্যারামাউন্ট গ্রুপ, প্যারাগন ও সৌরভ গ্রুপ গ্রিন হাউস কৃষিচর্চা করে আসছে। নাহার ডেইরি, আমেরিকান ডেইরি, ডাচ ডেইরি বা ডায়মন্ড এগের মতো বহু প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তির কৃষিতে বিনিয়োগ করে কৃষিশিল্পের বিকাশে ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি আমাদের এখনই নেওয়া উচিত। সেগুলো হলো : ১. প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব ২. নলেজ গ্যাপ ৩. ধীরগতির ইন্টারনেট ৪. দেশীয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের অভাব ৫. কৃষক পর্যায়ে ট্যাব/স্মার্টফোনের অভাব ৬. সরকারের নীতিমালা সংক্রান্ত জটিলতা ৭. মোটিভেশনের অভাব ইত্যাদি। জলবায়ু পরিবর্তনের এ সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্যের তাগিদ থেকে স্বল্প শ্রমে অধিক উৎপাদনে স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচারের বিকল্প নেই। আগামীর পৃথিবীতে কৃষি খাতে এগিয়ে থাকতে কৃষককে স্মার্ট প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আর স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়নে সরকারের সুনির্দিষ্ট সুপরিকল্পিত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কৌশল থাকা প্রয়োজন। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য সবার আগে প্রয়োজন স্মার্ট কৃষি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর