মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

কৃষি বিনিয়োগে প্রশংসনীয় অভিযাত্রা

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

কৃষি বিনিয়োগে প্রশংসনীয় অভিযাত্রা

কৃষিই হোক আমাদের নিত্যদিনের আরাধনা। জিডিপি সম্প্রসারণে কৃষিতে বিনিয়োগ তথা ব্যাংক ঋণের কোনো বিকল্প নেই। ব্যাংকের সনাতনী ধারা ছিল শহরকেন্দ্রিক বিনিয়োগ। করপোরেট গ্রাহকনির্ভর এ দেশের ব্যাংক খাত নিমজ্জিত ছিল সেদিকে আগাগোড়া। এ খাতে ঝুঁকি কম। অল্প গ্রাহক বেশি বিনিয়োগ ছিল মূলমন্ত্র। তাতে তদারকির ঝামেলা কম ছিল। অতীতে আমি ব্যাংকের শহরকেন্দ্রিক বিনিয়োগের রেওয়াজ পরিবর্তন করে ইটপাথরের বেষ্টনী থেকে বিনিয়োগ অবমুক্ত করে সম্ভাবনাময় পল্লীর কৃষি খামার ক্ষুদ্র ঋণের গুরুত্ব নিয়ে বহু সোচ্চার হয়েছিলাম। এমনকি তুলনা করে দেখিয়েছি করপোরেট খাতে বড় ঝুঁকি নিয়ে চলার চেয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে ঋণ বিতরণ ব্যাংকের জন্য, দেশের জন্য টেকসই মঙ্গলজনক নীতিমালা হবে।

ইদানীং বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি খাতে ঋণের একটা অংশ বিতরণের তাগিদ দিচ্ছে সব তফসিলি ব্যাংককে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা, খেলাপি ঋণ নিয়ে আগে অনেক লিখেছি তাতেও কাজ দেয়নি বরং রাজনৈতিক তদবিরে বিনিয়োগ করার কারণে ব্যাংক দিন দিন দুর্বল হচ্ছে। আগে মফস্বলে বেসরকারি ব্যাংক কখনো বিনিয়োগ করেনি। ফিজিবিলিটি স্টাডি করে দেশের লাভ হলেও ব্যাংকের মুনাফা কম হয় বিধায় গ্রামীণ পর্যায়ে কোনো ব্যাংক বিনিয়োগে উৎসাহ দেখায়নি। কোনো প্রগতিশিল শীর্ষকর্তা ঝুঁকি নিয়ে প্রাচীনকালের বিনিয়োগের নীতিমালার বেষ্টনী ডিঙিয়ে সংস্কারের পদক্ষেপও নেয়নি। গতানুগতিক ধারায় তাদের মেয়াদ উত্তীর্ণ করে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চাকরি শেষ করে অবসরে গেছেন নিরাপদ থাকতে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উঠতে-বসতে কৃষির গুণকীর্তন করে কৃষির গুরুত্ব কুম্ভকর্ণের ঘুমে থাকা ব্যাংকারদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি কৃষিতে প্রণোদনার অর্থ ব্যাংকে দিয়েছেন কৃষি খাতকে মজবুত করতে। কৃষির সোনালি সম্ভাবনা দুয়ারে কড়া নাড়াচ্ছেন তিনি। এমনকি নিজে গণভবনে সমন্বিত কৃষি খামার পাইলট প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে কৃষি খাতের জাগরণ সৃষ্টি করেছেন, ব্যাংকারদের কৃষিতে বিনিয়োগের সাহস জুগিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে নির্দেশনা দিলেও ব্যাংক সাহসী হয়ে সে পথে অগ্রসর হতে পারেনি। ব্যাংকগুলো গ্রামীণ সেক্টরে বিনিয়োগে সর্বদা গড়িমসি করে বিভিন্ন অজুহাতে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এনজিও বা সমিতি দিয়ে ঋণ দেয় যা কৃষকের জন্য বা কৃষির জন্য সহায়ক হয় না। অবস্থা এমন, সারা গায়ে ঘা, ওষুধ দেব কোথা?

খবরে দেখলাম আফজাল তারিক কমান্ডার এবি ব্যাংকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশপ্রেমের স্পৃহায় নানা উদ্যোগ শুরু করেছেন। কৃষিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনার টাকা সংগ্রহে, চিঠি চালাচালি না করে কাজের ফাঁকে ফাঁকে সশরীরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তহবিল সংগ্রহ করে কৃষির নতুন নতুন খাতে ঋণ বিতরণ করছেন।

কৃষি খাতে এবি ব্যাংকের আগে কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। তিনি নিজে যোগাযোগ করে, ব্যাংক খাতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, উপমা সৃষ্টিকারী ইমেজ কাজে লাগিয়ে মূলধন সংগ্রহ করেন। এ অভিনব বিনিয়োগের সফলতার ঊষা জাতি দেখতে শুরু করেছে। কৃষিমন্ত্রীও উৎসাহ দিয়েছেন। কৃষকের মর্যাদার আসনে রেখে তারিক আফজাল তাদের দুয়ারে ব্যাংককে নিয়ে গেছেন। স্মার্ট কৃষি ঋণ কার্ড প্রদান করছেন। এবি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজাল কৃষিতে বিনিয়োগের চমক দেখালেন। তিনি এবি ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পর ধাপে ধাপে নতুন উদ্যোগে তার টিম সাজিয়ে দেশের জিডিপি খাতে আরও কীভাবে ভূমিকা রাখা যায় সেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। গ্রামীণ অর্থনীতি সবল করার লক্ষ্যে তারিক আফজাল এবি ব্যাংকের বিনিয়োগ খাতে অনেক যুগান্তকারী সংস্কার সাধন করেছেন। ফলে ব্যাংকিং সেক্টরে এবি ব্যাংক এখন একটি আলোচিত নাম। অন্য ব্যাংকগুলোর জন্য যা অনুকরণীয় হতে পারে। কৃষি খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি লোক নিয়োজিত। খাদ্য উৎপাদনের ওপর দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। কৃষিপণ্য আমদানি বন্ধ করতে হলে কৃষি খাতে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। এটা উপলব্ধি করেই তারিক আফজাল একের পর এক সাহসী ভূমিকা নিচ্ছেন। তার সুদূরপ্রসারী চিন্তা-গবেষণার ফসল কৃষিতে বিনিয়োগ প্রসারিত করে কৃষককে সুদের অভিশাপ থেকে উদ্ধার করছে।  আরও কিছু ব্যাংক এগিয়ে এসেছে নতুন ধারার ব্যাংক বাবস্থাপনা নিয়ে। শুধু কৃষি বিনিয়োগে ক্ষান্ত হননি তিনি। খেলাপি ঋণ আদায় ও এর পরিমাণ সীমিত আকারে নামানোর লক্ষ্য নিয়ে অনেক কার্যকর পদ্ধতি হাতে নিয়েছেন। তিনি একজন দক্ষ ব্যাংকার চটপটে প্রশাসক। প্রখর মেধার পরিচয় দিয়েছেন এবি ব্যাংককে এগিয়ে নিতে বিশেষ করে কৃষি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। ঝিমিয়ে পড়া ব্যাংকিং খাতে নবগতি এনে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছেন। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা। তবে কৃষির সঙ্গে আমার নাড়ির সম্পর্ক। কৃষির উন্নতির গুরুত্ব আমি বলতে বলতে ক্লান্ত হইনি, হব না। আমি কৃষির পক্ষে বলতেই থাকব, আমি গর্বিত যে আমার পূর্বপুরুষ কৃষক। আমিও একজন কৃষক by head and heart। তাই এ খাতের উন্নয়নে তার পদক্ষেপে প্রীত হয়ে সবাইকে উৎসাহিত করার তাগিদে আমার কলাম লেখা। তারিক আফজালকে সাধুবাদ জানাই কৃষক গ্রাহকবান্ধব ব্যাংকব্যবস্থা সংস্কার করার জন্য। তার বিরামহীন কর্ম বিশ্রামহীন কায়িক পরিশ্রম আমাদের খামারিদের, কৃষি উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হাত শক্তিশালী করছে। এর ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। আমি মনে করি, দেশ গড়ার সংগ্রামের ইতিহাসে তার নামও স্মরণীয় থাকবে। পুরনো ধাঁচের জটিলতা থেকে বের হয়ে নতুন কিছু করা কঠিন। অনেকে উদ্যোগী হয়ে ঝুঁকি দেখে থেমে যান চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে। সাহসী কর্মসূচি হাতে নিতে তিনি দোটানায় ভোগেন না। সহকর্মীদের মোটিভেট করা, উপযুক্ত কর্মী রিক্রুট, তাদের প্রশিক্ষণ, নজরদারি সবই একটা সুপরিকল্পনার প্রতিফলন। নিজে মাঠ পর্যায় উল্কার মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। গ্রাহকদের সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি করছেন।

তাতে ঘরে সুফলও তুলছেন। দৃষ্টিকাড়া সুনাম নিয়ে তিনি ব্যাংক পরিচালনা করছেন; কৃষি খাতে বিনিয়োগের সুফল ইতোমধ্যে ফলতে বসেছে। বর্তমানে কৃষিপণ্য অনেক বেশি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে আগের তুলনায়। খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যাপারে নিয়মিত তলব চালিয়ে ব্যাংককে নতুন গতি এনেছেন। আইনি, প্রশাসনিক, ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে উল্লেখযোগ্য ঋণ আদায় করে তা কৃষিতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা সবার আস্থা অর্জন করেছে। তার অনেক সহকর্মী বলেন, তার নীতি কাবলিওয়ালাদের ব্যবসার মতো দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। যোগ্যদের ঋণ দিতে হবে। আবার ঘরে ঘরে হাজিরা দিয়ে আদায় করতে হবে। প্রযুক্তি শিক্ষায় দক্ষ কর্মী নিয়োগ, আইটি পারদর্শী শিক্ষিত অফিসার নিয়োগ দিয়ে কর্মে চাক্ষুষ ফল এনেছেন। খেলাপি ঋণ, তালিকা ঋণ ব্যাংকের জন্মগত সমস্যা। সব ব্যাংক এ রোগে ভুগছে। ক্ষুদ্র শিল্প, কৃষি নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করে ঋণ দেওয়ার পরামর্শ অনুকরণীয় একটি উদ্যোগ। যেখানে শাখা নেই সেখানেও ঋণ দিচ্ছে তা আশাজাগানিয়া সাহসী পদক্ষেপ। বাম্পার ফল জাতি একদিন পাবে। কৃষিই আমাদের টিকে থাকার প্রধান খাত। কৃষি আমাদের প্রধান অর্থনীতির সেক্টর। বিশ্বে যা-ই ঘটুক আমাদের কৃষি আমাদের জীবনজীবিকার গতি বজায় রাখবে।

 

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর