বুধবার, ২৬ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

সালুনের নুন, নুনের সালুন

আফরোজা পারভীন

সালুনের নুন, নুনের সালুন

দেশে এখন অগুনতি কবি-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক। তাদের প্রমোট করার জন্য প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে অগুনতি সংগঠন। পুরস্কার, দন্তবিকশিত পোস্ট, ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। সাহিত্য, পেশাজীবী, বিষয়ভিত্তিক, জেলাভিত্তিক, আঞ্চলিক, ধর্মভিত্তিক অসংখ্য সংগঠন নিয়োজিত তাদের সেবাদানে। চলছে অন্যকে পিছে ফেলে সামনে যাওয়ার দৌড়, ছড়াচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প। ফেসবুক কাজগুলো সহজ করে দিয়েছে। যা ইচ্ছে তা-ই ছাপানো, নাচ-গান-অভিনয়, রান্না, সেলাই ফোঁড়াই, রাজনৈতিক বক্তব্য, টকশোতে বুদ্ধিজীবী সাজার এমন সহজ উপায় থাকলে পিছিয়ে থাকে কোন বোকা!

একদিন এক ভদ্রলোক ফোন করে জানালেন, আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমার একটা বই রিভিউ করবেন। বই চাই তার। ওনার নাম কবি দিয়ে শুরু। অবাক হয়ে বললাম, কবি আপনার নামের অংশ! হ্যাঁ। কিন্তু কীভাবে? কেন নয়, নামের আগে যদি ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ড. প্রফেসর হয় কবি হবে না কেন। জোরেশোরে বললেন। বললাম, কিন্তু ওগুলো কোনোটাই নামের অংশ না। লোকজন না জেনে লিখে। পিতা-মাতা জন্মের পর আপনার নাম কবি ওমুক রাখেননি। তিনি যারপরনাই নাখোশ হলেন। তবুও এলেন। তবে এসে বই না চেয়ে চাইলেন টাকা। এমন কবি-সাহিত্যিকের দেখা আপনারাও নিশ্চয়ই পেয়েছেন।

আগের দিনে কোনো গ্রামে একজন সচিব থাকলে সে গ্রাম পরিচিতি পেত ‘সচিবের গ্রাম’ হিসেবে। কোনো বাড়িতে ‘দারোগা’ থাকলে বংশপরম্পরায় ওই বাড়ির নাম হতো ‘দারোগা বাড়ি’। এভাবে ‘ডেপুটি বাড়ি’, ‘উকিল বাড়ি’ ‘চেয়ারম্যান বাড়ি’ আমি অনেক পেয়েছি। তখন ডিগ্রি দিয়েও মানুষের পরিচয় হতো। যেমন বিএসসি সাহেব, এমএসসি সাহেব। সেকালে নামের শেষে বিএবিটি, এমএবিটি, ডাবল এমএ লেখার যৌক্তিকতা ছিল। তখন শিক্ষার হার ছিল কম। এমন একটি ডিগ্রি অনেক গৌরবের বিষয় ছিল। কেউ ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করলে সারা গ্রামের লোক দেখতে আসত। ছাত্রটিকে মাথায় তুলে নাচানো হতো। এখন ঘরে ঘরে এমএ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। তারার ছড়াছড়ি। কে ভালো ছাত্র কে মন্দ বোঝা কঠিন। চাকরি বা প্রতিষ্ঠা দিয়েও বিচার হয় না। মেধাই এখন একমাত্র যোগ্যতা না। টাকা, কানেকশন, রাজনৈতিক পরিচয়, অঞ্চল, মামু-খালুর জোর না থাকলে প্রথমকে ডিঙিয়ে শেষজন চাকরি পায়, প্রমোশন, এক্সটেনশন পায়। যুগ বদলে গেছে। আগে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালো পাত্র বলতে বোঝা হতো স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ, ভালো বংশ, ভালো লেখাপড়া। এখন ভালো পাত্র মানে গাড়ি, বাড়ি ব্যাংক-ব্যালেন্স। চাকরি বা ব্যবসা যাই করুক সেটা কতটা ভারী সেটাই দেখার বিষয় এখন। চরিত্র, বংশ, মদ খায় কি না, জুয়া খেলে কি না, মাদকাসক্ত কি না ছেলের টাকা আর প্রতিষ্ঠা থাকলে এসব নিয়ে খুব মাথা ঘামান না অভিভাবকরা। ব্যাপারটা যেন এমন, ওগুলো থাকলে একটু-আধটু চারিত্রিক দোষ মেনে নেওয়া যায়। পুরুষ ছেলে, সোনার আংটি বলে কথা! সোনার আংটি আবার বাঁকা হয় নাকি! ও বিয়ে হলে শুধরে যাবে ঠিক।

আমাদের কবি-সাহিত্যিকের কেউ কেউ পরের ভুল ধরতে ওস্তাদ। অনেকেই দুটো বাক্য শুদ্ধ করে লিখতে পারেন না, বাংলা বানানে অজস্র ভুল, বাক্য গঠন হয় না তারপরও তারা মুখিয়ে থাকেন অন্যের ভুল ধরতে। প্রায়ই দেখি শুদ্ধ বানান কেটে ভুল লিখে সংশোধন করে দিয়েছে কোনো কোনো দিগ্গজ। ভুল শব্দ প্রয়োগ করেছে। দেখি আর হাসি। মনে মনে বলি, মাস্টারি না শিখে মাস্টারি কর কেন! এ কথা ঠিক, সবাই সবটা জানে না। ভুল সবারই হয়। কিন্তু গায়ে পড়ে ভুল ধরতে গিয়ে নিজে পণ্ডিতি করার তো কোনো দরকার নেই। আগে তো দরকার নিজে শেখা। অনেকের নেমকার্ড দেখার মতো! কী নেই সেখানে। কোন সংগঠনের সদস্য ছিল সেটা থেকে শুরু করে কোন বাজার কমিটি মনিটরিংয়ে ছিল সেটা পর্যন্ত। এসব লিখলে কী ওজন বাড়ে! এসব পড়ার সময় কার! সত্যিকার বড় মানুষ নাম ছাড়া কিছু লিখেন না। তবে জ্ঞানে এবং মনে অতটা বড় হওয়া সত্যিই শক্ত!

শিষ্টাচার আর শুদ্ধাচার নাকি প্রশিক্ষণের বিষয়! এটা জানলাম চাকরিজীবনের শেষ দিকে এসে। অথচ আগে জানতাম, এগুলো শিখে পরিবার থেকে। আমরা তাই শিখেছি। সালাম দাও, কুশল জিজ্ঞাসা কর, মিথ্যা কথা বলো না, ভালো হয়ে চলো, কথা দিলে কথা রাখো, মন দিয়ে পড়াশোনা কর, গুরুজনকে সম্মান কর, অন্যকে আগে দিয়ে নিজে পরে খাও, ঢকঢক করে চা-পানি গিল না, চিবিয়ে চিবিয়ে শব্দ করে খেও না, অতিথি এলে এগিয়ে আনো, যাওয়ার সময় এগিয়ে দাও, গুরুজনের সামনে পা তুলে বসো না, সিগারেট পান কর না, শিক্ষককে সম্মান কর, প্রতিবেশীর দিকে নজর দাও, গরিব দুঃখীকে সাহায্য কর এমন হাজারো শিক্ষা তো আমরা ছেলেবেলায় পরিবার থেকে পেয়েছি। পারস্পরিক আদান-প্রদান, দিয়ে থুয়ে ভাগ-বাটোয়ারা করে খাওয়া পরিবারই আমাদের শিক্ষা দিয়েছে। তখন ধারকর্জের চল ছিল। নুন থেকে ডিম, মরিচ থেকে চাল সবই তো এ বাড়ি ও বাড়ি ধার দেওয়া-নেওয়া হতো। ছিল চমৎকার সম্প্রীতি। ঘরে কিছু না থাকলে নিজেকে মোটেও অসহায় লাগত না। মনে হতো পাশের বাড়িতে আছে। ওটাও আমার পরিবার। শবেবরাতে হালুয়া রুটি, কোরবানিতে মাংস বিলানো এসব ছিল সংস্কৃতি। কোথায় গেল সে সব! আমরা এখন এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়েছি যে, কাউকেই লাগে না। খাব না তবু কারও কাছে হাত পাতব না- এটাই যেন এখনকার সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি মোটেও ভালো না। আদান-প্রদানে মমত্ব বাড়ে। দিতে হয়, নিতে নেই শুধু। এটা মানলে কোনো সমস্যা থাকে না।

আমাদের রাজনীতিবিদের একাংশ চরম অধৈর্য! কেউ কাউকে মানে না, সবাই নেতা হতে চায়, ক্ষমতা চায়। ষাট দশকের ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনীতিবিদদের এক টেবিলে বসে গল্প করতে দেখেছি, কাঁধে হাত দিয়ে চলতে দেখেছি, এক বিছানায় ঘুমাতে দেখেছি। এই তো বেশ কয়েক বছর আগে বেগম খালেদা জিয়ার ছেলের বিয়েতে এসেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁরা পাশাপাশি বসেছিলেন। হাসিমুখে কথা বলেছিলেন। এটাই তো কাম্য।

এখন কাদা ছোড়াছুড়ির অন্ত নেই। অন্য দল তো বটেই নিজ দলেই চলছে কর্তৃত্বের বিরোধ। সাম্প্রতিককালে এই কাদা ছোড়াছুড়ির চূড়ান্ত দেখছি আমরা। কোটা আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নূর একসময় অনেকের কাছেই হিরো হয়ে উঠেছিলেন তার সাহসী ভূমিকার জন্য। যার ফলশ্রুতিতে তিনি ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে গণ অধিকার পরিষদ নামে একটা দল করেন তিনি। এই দলের শীর্ষনেতা রেজা কিবরিয়া ও নূরের মধ্যে শুরু হয়েছে কর্তৃত্বের লড়াই। নূরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপসহ দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন রেজা কিবরিয়া। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘অনেক বড় চাকরি করতেন, বড় ঘরের ছেলে, ফার্স্টক্লাস ছাড়া বিমানে চড়েন না। যে ফার্স্টক্লাসের কথা নূর কল্পনাও করতে পারে না। তার কল্পনা দৌড় বড়জোর বিজনেস ক্লাস পর্যন্ত। তিনি চাকরি ছেড়ে জনসেবার জন্য দেশে ফিরে এসেছেন’। তিনি বড় ঘরের ছেলে, একজন শ্রদ্ধেয় লোকের সন্তান, ভালো লেখাপড়া জানেন, বড় চাকরি করতেন এটা সত্য। তবে তার কথাবার্তায় বোঝা যায়, তিনি রাজনীতির মানুষ না। রাজনীতি করতে হলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে সাধারণ হতে হয়। তাদের একজন হতে হয়। রাজনীতির মূলকথা জনসংশ্লিষ্টতা, জনবিচ্ছিন্নতা নয়। এই যে তিনি এতসব বড় বড় কথা বলেন, এটা যে রাজনীতিবিদের মুখে বেমানান এটাও বোধহয় জানেন না। অন্যদিকে নূর যে কোনো কথা শুরু করার আগেই বলেন, তিনি ভিপি নূর। তিনি ভিপি ছিলেন, এখন নেই। তিনি এক্স। বারবার ভিপি নূর বলা সংগত না। কোনো বাগাড়ম্বরই ভালো না। এটাই হচ্ছে আমাদের রাজনীতির হালহকিকত!

অনেক দিন আগে একটা ছবি দেখেছিলাম। বঙ্গবন্ধু তখন প্রধানমন্ত্রী। সেদিন ৩২ নম্বরের বাড়িতে মুরগি রান্না হয়েছিল। লুঙ্গি পরিহিত বঙ্গবন্ধু তাঁর বডিগার্ডের একজনকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলেছিলেন, ‘চল ভাত খাবি। আজ কামালের মা মুরগির সালুন রান্না করেছে’। আর দিন দুয়েক আগে দেখলাম আরেকটা ছবি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কলাগাছের তন্তুর শাড়ি যিনি আবিষ্কার করেছেন সেই ভদ্রমহিলাকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। এটাই শিক্ষা। এটা পরিবার থেকে আসে। রক্তের ধারাবাহিকতায় আসে। আমাদের এলাকায় তরকারির আরেক নাম সালুন। টুঙ্গিপাড়া আর নড়াইল তো একই জনপদ। সালুনের নুন চেখে দেখা একটা সাধারণ নিয়ম। সালুন যাতে নুনে পুড়ে না যায় তাই গৃহিণীরা খুন্তির আগায় ঝোল নিয়ে চেখে দেখেন। নুন ঠিক হলে তাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। জীবনের জন্যও এই চেখে দেখা জরুরি। শিক্ষাটা ঠিকমতো হলো কি না, সহবতটা ঠিকমতো শিখল কি না, সেটা পরখ করে দেখতে হয় পরিবার থেকেই। তা না হলে সালুনের নুন না হয়ে নুনের সালুন হয়ে যায়।

লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্ম সচিব

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর