বুধবার, ২৬ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রশাসন কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও বাংলার ভূমি মালিকদের মধ্যে সম্পাদিত একটি স্থায়ী চুক্তি হলো- চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এ চুক্তির আওতায় জমিদার উপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হন। জমির স্বত্বাধিকারী হওয়া ছাড়াও জমিদারগণ স্বত্বাধিকারের সুবিধার সঙ্গে চিরস্থায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় এক নির্ধারিত হারের রাজস্বে জমিদারিস্বত্ব লাভ করেন। প্রাচ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে দীর্ঘ বিতর্ক ও আলোচনার পর প্রণীত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে রাজস্ব সংগ্রহের নিছক ব্যবস্থা রূপে গণ্য করা যায় না। বরং এটি ছিল উপনিবেশিক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থারই একটি প্রধান অংশ। প্রশাসনের নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও পুলিশ বিভাগকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা কার্যকরকরণের উপযুক্ত করে তোলা হয়। তবে এ ব্যবস্থা বজায় রাখার সব সযত্ন প্রয়াস সত্ত্বেও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ভূমি রাজস্ব আইনের প্রভাব, এ শতকের শেষের দিকে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান, বিশ শতকে জাতীয়তাবাদের প্রচার-প্রসার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির মতো নানা কারণে সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতির চাপে এতে অবক্ষয়ের সূচনা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলবৎ হওয়ার পর থেকে এ ব্যবস্থার কয়েক দফা সংশোধন ও পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তিত বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে অবশেষে ১৯৫০ সালে সমগ্র ব্যবস্থাই বাতিল করা হয়। ১৬৯৮ সালে কলকাতায় জমিদারি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমাগত বাড়তে থাকে। পলাশীর যুদ্ধে (১৭৫৭) নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর কোম্পানি সর্বাপেক্ষা আধিপত্যশীল হয়ে ওঠে। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেশের প্রকৃত শাসক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয় বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানির (১৭৬৫) দায়িত্ব গ্রহণের পর। দেওয়ানি ব্যবস্থায় কোম্পানি কার্যত বাংলার অধিশ্বর হয়ে ওঠে।

বাংলার এ নতুন অধিশ্বর গোড়া থেকেই রাজ্য শাসনের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কোম্পানির বণিক ও হিসাবরক্ষক হিসেবে বাংলায় কোম্পানির কর্মকর্তারা পণ্যের কেনাবেচা, ব্যবসায়ের সুদীর্ঘ স্থিতিপত্র ইত্যাদি তৈরিতে দক্ষ হলেও শাসনকাজে তারা ছিল একেবারেই অজ্ঞ। জনবলের অভাব, ভাষার সমস্যা, দেশজব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অজ্ঞতা, বাংলায় প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য ইউরোপীয় জাতির উপস্থিতি ইত্যাদি- কারণ বাংলায় উপনিবেশ রাষ্ট্র গড়ে তোলার কাজে তাদের শ্লথগতিতে অগ্রসর হতে বাধ্য করে। একেবারেই গোড়ার দিকে কোম্পানি তাই দেশীয় সহযোগীদের যোগসাজশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ নতুন উপনিবেশ শাসনের পন্থা গ্রহণ করে। নব্য শাসকদের সমস্যাটি ছিল এই যে, এটি আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো নতুন বসতি স্থাপনের উপনিবেশ ছিল না, ইংল্যান্ডের আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা অনুযায়ী এটির শাসন পরিচালনাও সম্ভব ছিল না। আবার বাংলার অধিবাসীরা আফ্রিকা বা প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপদেশগুলোর আদিবাসীদের মতো কোনো অর্ধসভ্য জনসমাজও ছিল না, যে কারণে এখানে বেত্রশাসন ছিল অবাস্তব। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি দেখা দেয় আইন-কানুন প্রয়োগের ক্ষেত্রে। কোম্পানি বাংলার নিজস্ব আইন-কানুন বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা অনুযায়ী দেশ শাসনের অবস্থায় ছিল না, কেননা তা হতো উপনিবেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশেরই পরিপন্থী। বলাবাহুল্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল, প্রাচ্যদেশীয় বাণিজ্য পরিচালনায় বাংলার রাজস্ব আয়কে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করা।

সর্বশেষ খবর