সোমবার, ৩১ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফেলে আসা চাকরি 

হোসেন আবদুল মান্নান

ফেলে আসা চাকরি 

কক্সবাজার থেকে বিমানেই ঢাকা ফিরে আসার কথা ছিল। লবিতে প্রাতঃরাশের সময় কাইয়ুম বলল, আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি, এখনই যাত্রা করব। আপনি গেলে একসঙ্গে যেতে পারি। আপনার পুরনো জায়গা, দেখে গেলে বোধহয় ভালো লাগবে। আশ্চর্য, বিমানের দামি টিকিটটার কথা না ভেবে নতুন প্রেমে পড়া কিশোরের মতন তার প্রস্তাবে তাৎক্ষণিক রাজি হয়ে গেলাম।  সড়কপথে লংড্রাইভ আমাকে বরাবরই আকৃষ্ট করে। দুই পাশের মানুষের আটপৌরে জীবন, গরু-বাছুরের পাল, রাখাল বালক, মাঠে কৃষকের বিচরণ, গাছপালা, বৃক্ষ, লতাগুল্মে ফুটে থাকা বনফুল, পাখির উড়াউড়ির ওপর উদাস নজর রাখা আমার আজন্ম নেশা। একই কারণে চাকরি জীবনেও আকাশ পথের অবাধ সুবিধাকে উপেক্ষা করে বারবার মহাসড়ককে বেছে নিয়েছি।

আমাদের গল্পের আমেজের মধ্যে গাড়ি চলছে। রামু, ঈদগা, চকরিয়া উপজেলার সবুজ বনভূমির ভিতর দিয়ে এগিয়ে এসে মাতামুহুরী নদীর ব্রিজটা অতিক্রম করি। সামনে লোহাগাড়ার সীমান্ত দিয়ে নতুন সড়ক ধরে আমরা পেকুয়ার দিকে যাচ্ছি। সড়কটি কিছুদিন হলো চালু হয়েছে। আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে গোটা আকাশ। বাইরে অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে। গাড়ির পিঠের ওপর ঝরে পড়া বৃষ্টির শব্দ যেন মনের গহিনে সংগীতের ছন্দ তুলছে। রবি ঠাকুরের গানের মতো-‘মন মোর মেঘের সঙ্গী-উড়ে চলে দিকদিগন্তের পানে’...।

হঠাৎ দেখি, এই তো বাঁশখালী চলে এসেছি। সামনেই উপজেলা পরিষদ ও পৌর এলাকায় প্রবেশ করব। বৃষ্টি কমে আসায় সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে এসেছে।

আমি কাইয়ুমকে বললাম, ড্রাইভারকে এখানে গাড়িটা একটু থামাতে বলুন তো।

সে বলল, এটা তো উপজেলা এলাকা, এখানে আগে কোর্ট কাচারি ছিল।

আমি বললাম, ‘জানি এক সময়ে আমাকে এ জায়গায় একাধিকবার আসতে হয়েছে। এখানে আমার কিছু অমলিন স্মৃতি পড়ে আছে। সড়কের ডান পাশটায় মুনসেফ বা সহকারী জজের আদালত এজলাস ছিল। ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে দেশব্যাপী হেফাজতের নৃশংস তান্ডবের সময় তারা এখানকার কোর্ট কাচারিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। শত শত দু®প্রাপ্য নথিপত্র পুড়ে ছাইভস্ম হয়েছিল। আমি তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। মনে পড়ে, খবর পেয়ে সবার আগে আমি এসে দাউদাউ করা আগুনের লেলিহান দেখেছিলাম এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। সে সময় তারা অত্র এলাকার সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরেরও মারাত্মক ক্ষতি করেছিল।’

কাইয়ুম চট্টগ্রামের মানুষ, সে আমার চেয়ে এ এলাকার রাস্তাঘাট ভালো চেনে। সে সময়ে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুখমন্ডল চাঁদের ভিতর দেখা যাচ্ছে এমন গুজবের সুযোগ নিয়ে জামায়াতে ইসলাম ও সমমনাদের সমর্থকদের ইলেকট্রিক করাত দিয়ে গাছ কেটে হাইওয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার কথা সে-ও দিব্যি স্মরণ করতে পারল। এ ঘটনার তিন দিন পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বাঁশখালী এলেন। পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ঢাকা থেকে তিনি হেলিকপ্টারে এখানকার কলেজ মাঠে অবতরণ করেন। বাঁশখালীর স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছিলেন। তবে সেদিন চট্টগ্রামের বেশ কজন সংসদ সদস্যও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেলিকপ্টার থেকে মাটিতে পা রেখেই সালাম বিনিময় করলেন। আমাকে দেখেই মৃদু হেসে বললেন, ‘চল গাড়ি কোথায়’? আমি তাঁকে নিয়ে গাড়িতে উঠতে যাব, এমন সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য সুলতানুল কবীর চৌধুরী আমাকে পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মন্ত্রীর পাশের সিটে উপবিষ্ট হলেন। তখন পর্যন্ত আমি তাঁকে চিনতাম না। তিনি এ এলাকার এক সম্ভ্রান্ত অভিজাত পরিবারের একজন সদস্য বলে জানি। খুব কাছে থেকে দৃশ্যটি নিবিষ্ট চিত্তে অবলোকন করলেন চট্টগ্রাম-৭ বোয়ালখালীর এমপি ও তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান মঈনউদ্দীন খান বাদল। অগত্যা আমি অন্য একটা গাড়িতে চেপে মন্ত্রীকে অনুসরণ করতে থাকি। পুড়িয়ে ফেলা কোর্ট ও পার্শ্ববর্তী এলাকা পরিদর্শন শেষে এবং বাঁশখালী ছাড়ার প্রাক্কালে মন্ত্রী এবং সাবেক আলোচিত সিএসপি কর্মকর্তা জনাব আলমগীর আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘শোন, কিছু মনে কর না, সিভিল সার্ভেন্টদের এমন অভিজ্ঞতা আগেও অনেক হয়েছে। আমাদেরও এগুলো মোকাবিলা করতে হয়েছিল। ভালো থেক, টেককেয়ার।’

হেলিকপ্টার আকাশের সীমানায় অদৃশ্য হয়ে গেলে যে যার গন্তব্যে হাঁটছে। দেখলাম সংসদ সদস্য মঈনউদ্দীন খান বাদল আমার দিকে দুই কদম এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালেন। বললেন, দেখেছ তো ডিসি, রাজনীতির সংস্কৃতি চর্চায় আমরা এখনো কোথায় আছি! আমি তোমার চোখে-মুখের অব্যক্ত ভাষা দেখছিলাম। চল, আজ এখান থেকে সোজা তোমার বাংলোয় ওই যে ‘ডিসি হিল’ সেখানে যাব। আজ তোমার সঙ্গে বসে চা খেতে চাই। ডিসির হিলে আগে কবে গিয়েছি এখন স্মরণে নেই।

জানতে চাইলাম, আমি কি আপনার গাড়িতে?

তিনি বললেন, না, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িতেই আমি বসতে চাই। তুমি অর্ডিনারি নও, একজন হাইরেটেড ডেপুটি কমিশনার বলে আমি জানি।

আমি তাঁকে বাম পাশে বসতে বললে তিনি স্বভাবসুলভভাবে বললেন, ‘নো, আই শেল টেক রাইট সাইড।’ ঘণ্টাখানিকের রাস্তা। তিনি নানা বিষয়ের অবতারণা করলেন। এই জনপদে বেড়ে ওঠা, ছাত্রজীবনে নৌকায় কর্ণফুলী পার হওয়ার স্মৃতি, ঢাকা যাওয়ার গল্প এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনাবলি ইত্যাদি। সাঙ্গু নদীর ওপর ব্রিজটা অতিক্রম করার সময় তিনি বলে উঠেছিলেন,  দ্যাখো মান্নান, ’৭১ সালে এই ডান পাশটায় আমরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অ্যাম্বুস নিয়ে সেখানে সারা রাত কাটিয়ে ছিলাম। এ নদী পথে পাকিস্তানি আর্মিরা সেই বান্দরবানের কাছাকাছি পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারত।

এক সময়ের বাম রাজনীতির একনিষ্ঠ কর্মী, সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও বাগ্মী বাদলের সেদিনের কণ্ঠস্বর, বাচনিক শব্দাবলি আজও আমার কানে প্রতিধ্বনিত হয়। তাঁর সঙ্গে ডিসি হিলের সেই প্রসন্ন অপরাহ্ণের স্মৃতি আমাকে নিরন্তর দোলা দেয়।

আমি গাড়িতে বসেই বিষণ্ণ মনে ভাবছিলাম, মানুষগুলো একে একে নিঃশব্দে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আমরাও একদিন নিভৃতে অতলান্তে তলিয়ে যাব। দিনরাত্রির সবকিছু যথারীতি চলমান থাকবে। এ পৃথিবী কি কিছু মনে রাখে?

 

লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর