শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভোটে অনীহা- কার কী দায়?

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

ভোটে অনীহা- কার কী দায়?

আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিসে সর্বপ্রথম ‘ভোট’ নামক রাজনৈতিক প্রথাটি চালু হয় বলে ধারণা করা হয়। অনেকের মতে, পৃথিবীর বুকে গণতন্ত্র চর্চার শুরুটাও সেখান থেকে। তখন গ্রিস ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক সমাজ। সেই সমাজের যেসব পুরুষ কৃষক জমির মালিক ছিলেন, তারা বছরে একবার একটি প্রসিদ্ধ স্থানে একত্রিত হতেন। তারপর তারা জমির মালিকদের মধ্যে যেসব সমাজ নেতা বা রাজনৈতিক নেতা ঘৃণিত বা অন্যায় কাজে জড়িত অথবা অজনপ্রিয়, তাদের নাম একটি ভাঙা পাত্রের টুকরায় লিখতেন এবং বড় পাত্রে জমা করতেন। এভাবে কারও নাম যদি ৬ হাজারের বেশি কৃষক লিখতেন, অর্থাৎ কেউ যদি ৬ হাজারের বেশি ভোট পেতেন, তবে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্তকে ১০ বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠানো হতো। আর কেউ যদি ৬ হাজারের বেশি ভোট না পেত, তবে কাউকে নির্বাসনে যেতে হতো না, সবাই মিলে একত্রে চাষবাস করতেন। ভোটের জন্য ব্যবহৃত ভাঙা বাক্সের টুকরাকে তৎকালীন গ্রিক ভাষায় ‘অস্ট্রাকা’ বলা হতো, যেখান থেকে ‘অস্ট্রাসাইজ’ বা বহিষ্কার শব্দের উৎপত্তি। বর্তমান বিশ্বে মাত্র ৬ হাজার না সূচক ভোটের কারণে যদি কাউকে নির্বাসনে পাঠানোর রীতি থাকত, তবে হয়তো সমাজ নেতা বা রাজনৈতিক নেতা বলে কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হতো। তবে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্রচলিত এই প্রথা বা নেতিবাচক ভোটপদ্ধতি গ্রিসে কার্যকর ও শান্তিপূর্ণ শাসনব্যবস্থা উপহার দিয়েছিল। সীমিত জনসংখ্যার কারণেই যে তা সম্ভব হয়েছিল এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই।

বিগত আড়াই হাজার বছরে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে ভোটিং পদ্ধতি। এক সময় আমাদের দেশে নির্বাচন মানেই ছিল উৎসবের আমেজ। শহর-বন্দর, গ্রামগঞ্জ পাড়া-মহল্লার গন্ডি পেরিয়ে ভোটের আবেগ ছড়িয়ে পড়ত শোবার ঘর অবধি। ভাইয়ের বিপরীতে ভাই কিংবা পিতা বনাম পুত্র, শ্বশুর বনাম জামাই, চাচা বনাম ভাতিজা, মামা বনাম ভাগিনা- এমন বহুমাত্রিক ভোটের রসালো আলাপ জমে উক্ত সমাজ জীবনে। এর বিপরীতে আবার চালু হলো নির্বাচনের নামে ভোট চুরি, লুণ্ঠন, কারচুপি, সূক্ষ্ম কারচুপি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ভূতের আসর, ডাকাতের উপস্থিতি- ইত্যাদির মতো হাজারো উপদ্রব, যা প্রকৃত ভোটারদের বড় অংশকে ভোটবিমুখ করে তোলে। খাবারের অরুচি যেমন মানব দেহ ও মনের একটি রোগ, তেমনি ভোটের অরুচিও একটি রাজনৈতিক রোগ হিসেবে বিবেচ্য। এই রোগ থেকে পরিত্রাণ না পেলে গণতন্ত্র নামের আদর্শ শাসন ব্যবস্থার আড়ালে মেনে নিতে হয় রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, উপনিবেশিকবাদ ছদ্ম স্বাধীনতা কিংবা শৃঙ্খলিত সার্বভৌমত্ব। বিগত ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনের নির্বাচনী এলাকায় ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন ভোটারের ভোট প্রদানের কথা ছিল। এই ভোটের জন্য প্রস্তুত করা হয় ১২৪টি ভোট কেন্দ্র। ভোট শেষে দেখা যায় এই নির্বাচনী এলাকায় ভোট দিয়েছেন ৩৭ হাজার ৪২০ জন অর্থাৎ ১১.৫১ শতাংশ। ১২৪টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ২৩টি ভোট কেন্দ্রে ভোট পড়ার হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে। এমনকি দুটি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১ শতাংশেরও কম। এই নির্বাচনের জন্য খরচকৃত সমগ্র দেশের জনগণের দেওয়া করের টাকার পরিমাণ জানা নেই। তবে যদি ধরা হয় প্রতিটি ব্যালট পেপার ছাপা, পরিবহন ও সংরক্ষণ বাবদ ১০ টাকা খরচ হয়েছে, তবে ৩ লক্ষাধিক ব্যালট পেপার বাবদই খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। ৬ থেকে ১০টি বুথ বিশিষ্ট ১২৪টি ভোট কেন্দ্রের প্রতিটিতে যদি ৩০ জন করেও সরকারি ব্যক্তি (আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ) নিযুক্ত হয়ে থাকেন এবং তাদের যাওয়া, আসা, থাকা, খাওয়া, ভাতা, এক দিনের বেতন বাবদ জনপ্রতি যদি ১ হাজার টাকা খরচ হয়ে থাকে তবে এখানে ব্যয় প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। যদি ২০০ জনের স্টকিং ফোর্স ম্যাজিস্ট্রেটসহ গাড়িযোগে দায়িত্ব পালন করে থাকেন এবং তাদের পেছনেও খরচ হয়েছে একটা বড় অঙ্ক। আরও খরচ হয়েছে নির্বাচনী সরঞ্জাম বহন, পাহারা দেওয়াসহ নানাবিধ খাতে। খোদ নির্বাচন কমিশনের নানা স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দিনভর এই নির্বাচনের জন্য নানাভাবে শ্রম দিয়েছেন, আর দেশের জনগণ দিয়েছে সেই শ্রমের আর্থিক মূল্য। সার্বিক বিচারে এই নির্বাচনে কয়েক কোটি টাকার নির্বাচন বলা যায়। অথচ ভোট পড়েছে ৩৭ হাজার ৪২০টি। এই নির্বাচনে দেশের বাঘা এক থিংকট্যাঙ্ক লড়াই করেছেন একজন হিরো আলমের সঙ্গে। সেই হিরো আলম আবার ধোলাই খেয়েছেন। আর দেশ ও সরকার খেয়েছে পশ্চিমা ধমক। এসব কিছুর নেপথ্যে হয়তো বহু কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে এর অন্যতম কারণ যে ভোটার অ্যাপাথি বা ভোটে অনীহা তথা ভোটে অরুচি তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। ঢাকা-১৭ এলাকায় অতি ধনী, ধনী, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের বসবাস। পুরো নির্বাচনী এলাকায় ভোট প্রদানের অতি নিম্ন হার প্রমাণ করে, ভোটার অ্যাপাথি তথা ভোটে অরুচি পেয়ে বসেছে ধনী গরিব নির্বিশেষে সবাইকে। তবে অনেকেই মনে করেন, তরুণ ও যুবকদের ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা জাতির জন্য অশনিসংকেত। তরুণদের ভোটে আগ্রহ কমার কারণ অনুসন্ধান করেছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক এনজিও সার্চ ফর কমন গ্রাউন্ডের পরিচালক মাইকেল জেবিন। তার মতে, দেশে বিরাজমান সমস্যা অনেক তরুণকে তখন হতাশ বা নিরাশ করে, সে যখন দেখে দেশে দুর্নীতি হচ্ছে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কোনো কল্যাণ হচ্ছে না, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, জ্বালানি, পরিবেশ, প্রকৃতি ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে অবস্থার ক্রমেই অবনতি ঘটছে, তখন সেই তরুণটি একটি ভোটের মূল্য হারিয়ে ফেলে। আইভোরিকোস্টের ইয়াং আফ্রিকান রিডার্স ইনিশিয়েটিভের সদস্য মার্ক গনোর দৃষ্টিতে ২০১০ সালের রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের পর জাতিগত দাঙ্গা তরুণদের ভোটের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। ইংল্যান্ডের অনলাইন মিডিয়া কন্টিনিউরের ডেপুটি এডিটর ফ্রান্সকা ক্যাসিডি ভোটে অনীহার নেপথ্যে পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তার মতে ভোটে আগ্রহ না থাকার নেপথ্যে সাধারণ কারণ হলো এ বিষয়ে উৎসাহ বোধ করেন না ভোটারদের বড় অংশ। ভোটারদের আগ্রহের সবকিছু যখন ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, তখন ভোটারদের কাছে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়টি তুচ্ছ মনে হয়। তাই ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়লে ভোট প্রদানের হার কমে যায় বলে মনে করেন তিনি।

আবার রাজনৈতিক শিক্ষা বা রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবও ভোটে অনাগ্রহের একটি কারণ। ভোটারদের রাজনৈতিক আগ্রহ ও সচেতনতা দিনে দিনে কমছে গণতন্ত্রের তীর্থপীঠ খোদ ইংল্যান্ডে। সেখানে ২০১৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী ৬৮% ভোটার ভোট দিয়েছে সেখানে ২৪ বছরের নিচের ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৩৯ শতাংশ। এর আগে ২০১৫ সালে নির্বাচনে পর সেখানকার গবেষণা ও জরিপ সংস্থা সার্ভিস সেন্টার পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, যারা ভোট প্রদান থেকে বিরত থেকেছেন তাদের অধিকাংশই ভোটপ্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের প্রতি আস্থা বা বিশ্বাস হারানোর কারণে ভোট কেন্দ্রে যাননি। কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকায় দলের প্রার্থীর প্রভাব বা প্রতিপত্তি এত বেশি যে, তাদের বিজয় সুনিশ্চিত করে ধরে নেয় ভোটাররা। এক্ষেত্রে একজন মনে করেন, তার ভোট দেওয়া না দেওয়ায় কিছুই যায় আসে না। কারণ বিজয়ী কে হবেন তা পূর্বনির্ধারিত। ফলে তিনি ভোট দেন না।

২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর আমেরিকার জরিপ ব্যুরোর গবেষণায় দেখা যায়, ভোটের দিন ৮.৬% ভোটার এলাকায় ছিলেন না এবং ১৮.৯ শতাংশ ভোটারের নিজের কাজে খুবই ব্যস্ত থাকায় ভোট প্রদানের ফুসরত মেলেনি। অপরদিকে ১৫.৭% শতাংশ ভোটার রাজনীতি ও ভোটে অনীহা এবং ১২.৭% ভোটার প্রার্থী বা দল পছন্দ না হওয়ায় ভোট দেননি। আর নিবন্ধন জটিলতায় ভোট দেওয়া হয়নি শতকরা ৫.৫ জনের। মজার বিষয় হলো, ২.৭ শতাংশ ভোট কেন্দ্র খুঁজে পায়নি আর ৩.৯% ভোটের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল।

বাংলাদেশের ভোটের ইতিহাস বড় বিচিত্র। এখানে শত শত কেন্দ্রে শতকরা ১০০ ভাগ ভোট পড়ার রেকর্ড বা প্রামাণিক দলিল আছে। আবার সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে দুটি কেন্দ্রে এক শতাংশের কম ভোট পড়েছে এই সংকট নিরসনে কী প্রয়োজন? গবেষণা, শিক্ষা, সংস্কার- না অন্য কিছু? কেউ কী জাতিকে জানাবেন?

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর