শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ডেঙ্গুর ডিগবাজি

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

ডেঙ্গুর ডিগবাজি

ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন থেকে সমুদ্রপথে ১১ তলা জাহাজে চড়ে নরওয়ের রাজধানী অসলো যাচ্ছি। ১৯ ঘণ্টার জলপথ পাড়ি দেওয়ার সময় জাহাজ ‘পার্ল সিওয়েজ’ এর কেবিনে কাচের দেয়ালে একটা ছোট দাগ, মনে হলো পাতলা প্রকৃতির মশা বসে আছে। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে হলেও আমার মাথায় ও মনে ডেঙ্গুর ভয় ও ভাবনা বিশেষভাবে কার্যকর। ভাবলাম এটা সে নয়তো। দেশে মশারির গায়ে এভাবে ঘাতকটি বসে আছে মনে করে সব সময় মারার চেষ্টা করি। আমি কাচের গায়ে অনেকটা সতর্কতার সঙ্গে (দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা যেভাবে গায়েবি আসামির জন্য সতর্কতা অবলম্বন করে) চাপ দিলাম। না এটি এডিস মশাদের কেউ নয়। এটা এমনিতে একটি কালো দাগ। ভাবলাম এ নর্থ সির সমুদ্রপথে (আটলান্টিক মহাসাগরের শরিক, এক সময় যার নাম ছিল জার্মান সাগর) যেখানে উপমহাদেশীয় মশা-মাছির কোনো আস্তানা তো দূরের কথা, কোনো ভাবশিষ্যেরও থাকার কথা না। তবু এ অতি ক্ষুদ্র এডিস মশা বা অণুবীক্ষণ যন্ত্রে যাকে দেখতে হয় সেই করোনাভাইরাসের কথা এখানে এভাবে মাথায় আসে কেন। আসে এ কারণে একটি ক্ষুদ্র মশা কিংবা ভাইরাস ব্যক্তি-পরিবার-সমাজের সারা জীবনের কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, জাতীয় অর্থনীতিতে অসতর্ক অস্বচ্ছ ব্যয়ের বহর বেড়ে গেলেও স্থায়ী নিয়ন্ত্রণের কোনো সদুত্তর মেলে না। আসলে মানুষ যে পরিবেশে যে ধারণা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে, বড় হয় তার চিন্তা-চেতনার মধ্যে তা সারাক্ষণ একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর মতো বাতচিৎ করতে থাকে। আশির দশকে আমি যখন অক্সফোর্ডে বিশেষ বিদ্যার্জনে গেছি সেখানে শিক্ষক ক্লাসে আমাদের কয়েকটা ছবি দেখিয়ে তার ব্যাখ্যা করার জন্য মনসচক্রবালের ব্যাপ্তি সম্পর্কে পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। একটা ছবিতে ছিল এক ভদ্রলোক টিভির সেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে কিছুটা বেজার মনে হচ্ছিল। আফ্রিকার ঘানা থেকে আসা সহপাঠী তার মতো করে ব্যাখ্যা দিলেন টিভিটা নষ্ট হয়ে গেছে তাই বিরক্ত বদনে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। মোজাম্বিকের বন্ধু বললেন লোকটি শিক্ষক, ছাত্রদের বোঝাতে চাচ্ছেন কিন্তু কীভাবে এটাকে ব্যবহার করতে হয় তা এখনো রপ্ত করতে পারেননি। এশিয়ার বাংলাদেশের আমি বললাম, কারেন্ট চলে যাওয়ায় টিভি অনুষ্ঠান দেখা যাচ্ছে না তাই লোকটা বেজার। আমাদের প্রশিক্ষক বললেন, যার যার ব্যাকগ্রাউন্ডে যে নলেজ আছে তা তাকে সেভাবে ব্যাখ্যা করার উপায় করে দিয়েছে। বাংলাদেশে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া একটি নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার এবং (সেই আশির দশকে, একমাত্র টিভি চ্যানেলে) প্রিয় একটি নাটক দেখায় বিঘ্ন ঘটায় এমন বিরক্তভাব। ছবি দেখে আমার অভিজ্ঞতার যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি অন্য দেশের পরিস্থিতি ও পরিবেশ থেকে আসা অন্য সহপাঠীদের ব্যাখ্যার সঙ্গে একই কারণে তা মেলেনি। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর কথা আমার প্রথম চিন্তায় আসে যখন আমাদের নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগের পার্বত্য চট্টগ্রাম অফিসের এক চাকমা সহকর্মী পাহাড়ি মশার কামড়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান। সেই সময় ডেঙ্গুর ভয়াবহতার কথা কানে আসে। সে তো গেল শতাব্দীর আশির দশকের কথা। এরপর সেই ডেঙ্গু পাহাড়, জঙ্গল, নদী, চিনকির আস্তানা, ইলিয়টগঞ্জ, দাউদকান্দি পেরিয়ে ধোলাইখাল ছাড়িয়ে ঢাকা শহরে এখন তার বাহাদুরী দেখে কে? ২০১৫ সালের পর থেকে বর্ষাকাল এলে মেয়র মহোদয়ের সংবাদ সম্মেলন, ওষুধ ছিটানো, লার্ভা ধ্বংসের ফটোসেশন কতকিছু দেখা ও শোনার অভিজ্ঞতা হচ্ছে ঢাকা মহানগরীর। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম কবিগুরু রবিঠাকুরের পরিবার কলকাতা শহর ছেড়ে পালিয়েছিলেন এ ডেঙ্গুর ভয়ে। আসলে তখন কি একই সিমটমসম্পন্ন ব্যাধির নাম ডেঙ্গু ছিল? মনে হয় না। কেননা মশাবাহিত ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ডেঙ্গু- এদের নামপত্তন সিএস, আরএস, বিএস খতিয়ান অনুযায়ী বারবার শ্রেণি পরিবর্তনের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্রিটিশ বা পাকিস্তানের পূর্বতন নিবর্তন নিপীড়ন আইনের উত্তরসূরি, ইতোমধ্যে তাকে কখনো ডিজিটাল এখন সাইবার বিশেষ আইন বলার চেষ্টা হচ্ছে। নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢালার রীতি ও রেওয়াজ এ উপমহাদেশে আছে, থাকবে।

২০১৭ সালে ডেঙ্গুর সঙ্গে তার খালাতো বোন চিকনগুনিয়া এক তালে একসঙ্গে অনেক কিছু দেখিয়েছিল। আমি সে সময় চিকনগুনিয়াকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম বলে সে আমার ও আমার স্ত্রীর ওপর রাগ ঝেড়েছিল। কী কষ্ট পেয়েছিলাম সে বছর ওই অবস্থায় হজে গিয়ে আপাতত রেহাই পেয়েছিলাম। ২০১৮-২০১৯ সালে চিকনগুনিয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু মোটামুটি ভালোই চালাচ্ছিল। বর্ষাকাল এলেই আতঙ্কগ্রস্ত। বসন্ত, হাম, চিকনগুনিয়া একবার হলে আর হবে না এ জাতীয় একটা ইনডেমনিটি পাওয়া যায়। কিন্তু ডেঙ্গুর সেরকম সার্টিফিকেট দেওয়ার এখতিয়ার নেই, এমনকি তাদের বড় খালার বড় সন্তান করোনারও সে ধরনের প্রতিশ্রুতি সনদ দেওয়ার উদাহরণ নেই, তাই যদি হতো তাহলে বুস্টারসহ চারবার টিকা নিয়েও করোনার তিন-চারবার আক্রমণ ঠেকানো যেত। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে প্রথম তশরিফ আনে মহামারি করোনা। তার কাছে গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল কিছু না। সে এলো দুনিয়াজুড়ে মূর্তিমান আতঙ্ক নিয়ে। শীতকালে চীনে তার যাত্রা শুরু। ডোনাল্ড ট্রাম্প সাহেবের সেবার ভোটের বছর। তিনি ফতোয়া দিলেন এপ্রিল-মে মাসে গরম শুরু হলে করোনা পালানোর পথ পাবে না। কিন্তু করোনা ট্রাম্প সাহেবের কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ‘শি’ এর কথা। গোটা মার্কিন মুল্লুকে মূর্তিমান বিধ্বংসী আঘাত। অর্থনীতি জীবন-জীবিকায় আঘাত এলো গোটা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য পেরিয়ে ভারত এবং হতভাগ্য আর প্রায় সব দেশে। বাংলাদেশে ডেঙ্গু ২০২০-২১-২২ এ তেমন পাত্তা পায়নি তাদের কাজিন করোনার কাছে। ডেঙ্গুকে কেউ শিরোনামে আনতে দেয়নি। তাই আইইডিসিআর সংবাদ সম্মেলনে করোনার তখন মোক্ষম উপস্থিতি। অবশেষে ২০২২ এর শেষে দেশি-বিদেশি হস্তক্ষেপে করোনার দিন ঘনিয়ে আসে। কিন্তু গত দেড়-দুই বছরে আবার ডেঙ্গুর পোয়াবারো। ডেঙ্গু এখন যা আমি এ ইউরোপ থেকে জানতে পারছি ভয়াবহ চিন্তার কথা, যা আমাদের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনীতিতেও ডেঙ্গুর ডিগবাজি খাওয়ার প্রবণতা। এখন সনাতন লক্ষণ ও আবহমান চিকিৎসায় স্থিতিশীলতা নেই। কে জানে করোনার কাছ থেকে সে বিশেষ তালিম নিয়েছে কি না? কে জানে মানুষের মনে ভয় ঢোকানোর ক্ষেত্রে ইন্ধন পাওয়ার জন্য সে বিদেশি লবিস্ট নিয়োগ করেছে কি না? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান পুরোহিত (ডিজি) সেদিন বলেছেন, বাংলদেশে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করেছে। এটি সিঙ্গাপুরের (ভেজাল) কীট বিক্রির পরোক্ষ উপলক্ষ তৈরির নীলনকশার খসড়া কি না। কে জানে দেশের মানুষের বিদ্যমান সমস্যাগুলো থেকে মতি-গতি অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য কোনো চিন্তা চৌবাচ্চার পরামর্শ সে পাচ্ছে কি না?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের কথা শুনে ডেঙ্গু শিবিরে আত্মবিশ্বাস আত্মতৃপ্তি আর আত্মগৌরব প্রকাশের নমুনা দেখতে কারও বাকি নেই। ডেঙ্গুদের হেড কোয়ার্টার থেকে এটাও বলা হয়েছে- যাক আমাদের সমস্যা ও সম্ভাবনার বিশ্ব স্বীকৃতি মিলছে। করোনার মতো বারবার ভোল পাল্টানো, ডেঙ্গুর ডিগবাজি খাওয়াতে এর কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির এ প্রেরণা, ওষুধ সংগ্রহ ছিটানো ব্যবসার কাজে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। নিজেদের সমস্যায় বাইরের লোকেদের নাক গলানো দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি দেনদরবার ব্যবসা-পাতির কারণ সৃষ্টি যেখানে নৈমিত্তিক সেখানে ডেঙ্গুকে নোবেল না হোক অন্তত বুকার না হোক দেশীয় ভেজাল পদক পর্যন্ত তো জুটতে পারে।

কিন্তু এটা কোনো অবস্থাতেই তাদের কাছে হই হুল্লোড়ের সংঘাত সংক্ষুব্ধকরণের বিষয় নয়, যারা ডেঙ্গুতে মারা গেছেন (যাদের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়েছে), যাচ্ছেন, বেঁচে থাকতে যারা অসম্ভব ব্যথা-বেদনায় কাতর হচ্ছেন, যে পরিবার চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সে ব্যক্তি বা পরিবার ডেঙ্গুর বিস্তারকে, তার ডিগবাজি খাওয়াকে হালকাভাবে দেখা মেনে নিতে পারে না। করোনার সময় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তারা তো স্বাস্থ্য দফতরের দুর্নীতির ফাইল মামলার আর্জি পর্যন্ত গড়ানো দেখতে পারেনি। ক্ষতিগ্রস্তরা এখনো প্রশ্ন করতে পারেননি কেন এডিস মশা নির্মূল করার পথে না গিয়ে তাকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি, ওষুধ বিক্রি, স্বাস্থ্যসেবা খাতের তেলেসমাতি, অপারগতা, অদক্ষতা আর নেতৃত্বে অদূরদর্শিতার কারণ ব্যাখ্যা চাইতে পারবেন না। যারা মারা যাচ্ছেন তারা এবং যারা আক্রান্ত হয়ে অশেষ কষ্ট পাচ্ছেন তারা ডেঙ্গু শেষ হলে অকৃতজ্ঞ জাতি সাফল্যের হাসি হাসবে কি না?  করোনা মোকাবিলার মতো ডেঙ্গু নির্মূল নিয়ন্ত্রণে জিপিএ ফাইভ পাওয়ার আনন্দে প্রচারে প্রগলভ হবে কি না তা তো দেখার বিষয়। উল্টো করে বলা যায়, ডেঙ্গু ডিগবাজি দেওয়ায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে আশকারা পেয়েছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের রাজনীতি, সিন্ডিকেটেড অর্থনীতি, দুর্নীতি ও স্বার্থান্ধ ব্যবসা-বাণিজ্য বোধ থেকে।

                লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

সর্বশেষ খবর