শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ইন্দিরা গান্ধী

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ইন্দিরা গান্ধী

ভারতীয় সময় তখন সকাল ৯টা ৩০। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লির লালকেল্লা থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি দেখতে পান তৎকালীন বিদেশ সচিব জগৎ মেহতা এবং  RAW-এর প্রধান রামনাথ কাউর লালকেল্লার ভিতরে ঢুকেছেন।  ইন্দিরা গান্ধী তার বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে লিফটে উঠলেন। নামতেই দেখেন নিচে দুজন দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী সংবাদ? তারা ইন্দিরাজির হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিলেন। আর মুখে বললেন, বঙ্গবন্ধুর ওপর বড় ধরনের হামলা হয়েছে। দুই অফিসারকে গাড়িতে তুলে তিনি চলে গেলেন ২ নম্বর সফদরজং রোডে তাঁর বাসভবনে। ৩২ নম্বর ধানমন্ডি রোডে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন তাঁর হটলাইন থেকে। পারলেন না। ঘুট করে একটা শব্দ তুলে লাইন কেটে গেল। ইন্দিরা গান্ধী সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ওই দুই অফিসারকে ফোনটা দিয়ে বললেন, দেখ তো কী হলো। তারা পরীক্ষা করে দেখে বললেন, ম্যাডাম হটলাইনের সংযোগ কেটে গেছে। এরপর তিনি নির্দেশ দেন, ঢাকার হাইকমিশনের সঙ্গে কথা বল। ঢাকায়ও সেদিন ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে হাইকমিশন দফতর ছুটি। রাষ্ট্রদূত সমর সেন নিজেও ছুটিতে কলকাতায় এসেছিলেন।

এ কথা আমি শুনেছি স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। ১৯৭৭ সালে ইন্দরা গান্ধী ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার সরকারি বাড়ি বদলিয়ে তিনি চলে আসেন উইলিংডন ক্রিসেন্ট রোডের একটি ছোট বাড়িতে। তখনো তিনি লোকসভার সদস্য। একদিন সকালের বিমানে দিল্লি যাচ্ছিলাম। বিমানে দেখা হলো সে সময়ের পশ্চিমবঙ্গের সেচ ও বিদ্যুৎমন্ত্রী বরকত গণি খান চৌধুরীর সঙ্গে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম হঠাৎ দিল্লি যাচ্ছেন? গতকাল বিধান সভায় তো কিছুই বললেন না। তিনি জবাব দিলেন আমাকে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি তলব করেছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি সোজাসুজি ম্যাডামের বাড়ি যাবেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ তাই যাব। আমি এরপর অনুরোধ করি আমাকে নিয়ে যাবেন? তিনি বললেন, আপনি কেন যাবেন? আমি জবাব দিলাম আপনি আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দেবেন। আমার সঙ্গে পরিচয় করানোর সময় ইন্দরা গান্ধী বরকত সাহেবকে বলেন, আমি ওকে চিনি। ও কী চায়? বরকত বলেন, ও আপনার সঙ্গে কথা বলে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেবে। আপনি কীভাবে দেশ চালিয়েছেন, বাংলাদেশ ইস্যু কীভাবে দেখেছেন- এসব ব্যাপারে জানতে চায়। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, কিন্তু তাকে কথা দিতে হবে এখন কিছু লিখতে পারবে না। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বহু পুরনো সচিব ধাওয়ানকে ডাকলেন। তাকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, এ কয়েকদিন আমার এখানে আসবে। বিকাল ৪টার সময় তুমি অন্য কাউকে সময় দেবে না। সেই সাক্ষাতে আমার প্রশ্ন ছিল- আপনি লন্ডনে তারাপদ বসুর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল।

সরাসরি উত্তর না দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন- তোমরা ক’ ভাই? আমি বললাম, আমার আরও তিন ভাই আছে। আমরা মোট চার ভাই। উনি উত্তর না দিয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আবেগ আড়াল করতেই তিনি দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে নিজের আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলেন, আমার এক ভাই। মুজিব। এর আগেও হেনরি কিসিঞ্জার ভুট্টো বাহিনী দু-তিনবার চেষ্টা করেছিল। আমি তাকে বারবার সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু সে আমার কোনো কথাই শোনেনি। বারবারই আমাকে বলতেন- দেশের লোকরাই তো আমাকে জাতির পিতা বানিয়েছে। আমাকে এরা কেউ মারবে না। কিন্তু আমি তাকে বারবারই সতর্ক থাকার কথা বলেছি। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ১৫ তারিখে আপনি মুজিবকে কী বলতে গেছিলেন। সে সময় আপনার ফোন লাইন কেটে যায়? তিনি আমাকে বলেন, সে কথা এখন লিখো না। সাহস সঞ্চয় করে বলেই ফেললাম। আপনার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র আছে? তিনি আড়চোখে আমাকে দেখে বললেন, তুমি মোরারজি ভাইকে চেন? আমি কোনো কাগজপত্র রাখিনি। মোরারজি ভাইয়ের কাছে যাও, তার টেবিলেই যা কিছু কাগজপত্র থাকার সেগুলো আছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, একজন মহিলার কাছে আমেরিকার বিদেশনীতি পর্যুদস্ত হলো। আমরা ওকে উচিত শিক্ষাই দেব। আমি প্রতিদিনই তাঁর বাড়িতে যাওয়ার সময় প্রশ্ন কী করব ভাবতে ভাবতে যেতাম। প্রশ্ন করে ছিলাম আপনি কি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফোন করেছিলেন? তিনি বলেন হ্যাঁ তবে ফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়। তারপর থেকে আমরা আর ধানমন্ডিতে যোগাযোগ করতে পারিনি। মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে আপনার কেমন মনে হয়েছিল? জবাবে ইন্দিরা বলেন, গুরুদেবভক্ত। তাই দেশের নামও তিনি সোনার বাংলা রেখেছিলেন। একটু মুচকি হেসে বলেন, আমিও গুরুদেবের ছায়ায় ছিলাম। সেকথা তোমরা জান। শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন। শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। একজন মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর মনে হয় যখন তিনি স্বদেশ, স্বজাতির জন্য লড়াই করেন। আপামর জনসাধারণের স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেন। এ শুধু একজন মানুষের সৌন্দর্য নয়। সমগ্র মানবতার সৌন্দর্য। কারণ একজন মানুষের মধ্য দিয়েই কখনো কখনো সমগ্র মানবতার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। একজনই তখন হয়ে ওঠেন সামাগ্রিক ব্যক্তিত্বের প্রতিনিধি। রবীন্দ্রনাথের সেই প্রত্যাশিত, প্রতীক্ষিত নেতাই ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পুরো স্বদেশকে তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তার কথায়, চিন্তায়, কর্মে পুরো দেশের বাস্তবতার প্রতিফলন দেখেছিল বাংলাদেশের মানুষ। পুরো দেশের মানুষ তার মধ্যে দেশের নায়ক ও নেতাকে খুঁজে পায়। এ স্বাধীনতা আনার জন্য বঙ্গবন্ধু সঙ্গে পেয়েছিলেন এমন এক গুণীজনকে যিনি রবীন্দ্রনাথের স্নেহছায়ায় শিক্ষা এবং আদর্শ লাভ করেছিলেন। তিনি হলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ দুজনের মৃত্যু যেন একই সূত্রে গাঁথা। এ দুজনের মৃত্যুর নেপথ্যে কাজ করেছে আমেরিকা ও পাকিস্তান। বাংলাদেশের এক কোটি মানুষকে ইন্দিরা গান্ধী যখন আশ্রয় দিয়েছিলেন, তখন পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব বাংলার ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে। আর বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে ১৯৭১ সালে দেখেছিল সেই নিপীড়ন, অত্যাচার, ধর্ষণ ও নানা অসামাজিক কাজ। পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করেছে। মুসলিম লিগের ছাত্রনেতা হিসেবে টুঙ্গিপাড়ার মুজিবুর রহমান মুসলিম ছাত্রদের নিয়ে অবিভক্ত বাংলায় নানা সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। ১৪ আগস্টে তিনি বলেছিলেন, আমার এবং আমার সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে। ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। আর ওই দিনই বাংলাদেশে সপরিবারে মুজিব হত্যা। কিসিঞ্জার তার কথা রেখেছে। ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন গোটা এলাকা অন্ধকার করে দেওয়া হয়েছিল। কেটে দেওয়া হয়েছিল টেলিফোন লাইনও। বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধি দুজনকেই নিজ নিজ বাড়িতে হত্যা করা হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী হত্যার কিছুদিন আগে তার ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধীকে হত্যা করার নেপথ্যেও দিল্লির মার্কিন দূতাবাসের হাত ছিল। বড় ছেলে রাজীব গান্ধী যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাকে দিল্লি থেকে ২ হাজার মাইল দূরে দক্ষিণ ভারতের জনসভায় বক্তৃতা করার সময় মানববোমা দিয়ে হত্যা করা হয়। এটাই ছিল কিসিঞ্জার সাহেবের বদলা। তাকে যে হত্যা করা হতে পারে সে কথা চার দিন আগে ওড়িশার এক জনসভায় বলেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। পরদিন তিনি কলকাতার রাজভবনে এক সাংবাদিক বৈঠক করেন। সেখানে আমি প্রশ্ন করেছিলাম- আপনি ভুবনেশ্বরে বলেছেন, আপনাকে হত্যা করা হতে পারে। হু ইজ ইউর কিলার? আমাকে উপস্থিত কংগ্রেস নেতারা থামানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু আমি থামিনি। ওনার মিডিয়া অ্যাডভাইজার আমাকে এসে বলেন, তোমাকে উনি ঘরে ডাকছেন। যাও। আমি ঢুকে দেখি উনি চা বানাচ্ছেন। আমাকে দেখে চিৎকার করে বললেন, তুমি জান না, আমাকে কারা মারতে চায়?

বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের নায়ক জিয়া ও খন্দকার মোশতাক। বরাবরই আমেরিকানদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ রেখে চলেছেন। আমরা কলকাতায় দেখেছি। খন্দকার মোশতাক কোনোদিনই মুজিবনগর সচিবালয়ে যাননি। বেশির ভাগ সময় কাটাতেন হোচিমিন সরনিতে আমেরিকান উপদূতাবাসে। এমনকি খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহাবুব আলম চাষী আরও দু-তিনজনকে নিয়ে আমেরিকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। তখনকার ভারতের গোয়েন্দারা দমদম বিমানবন্দরে তাকে আটকে দেয়। জাতিসংঘে গিয়ে খন্দকার যে ভাষণটি দিতেন সেটি লিখে দিয়েছিলেন ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বদলা নেওয়ার জন্য খুব বেশি লোক বাংলাদেশের রাস্তায় নামেনি। নেমেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন প্রথম সারির যোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী। ১৫ আগস্ট বাঙালির কাঁদার সময় নয়। বিশ্ব মোড়লরা একটুও বদলায়নি। আমরা যতদূর খবর পাচ্ছি, আসন্ন বাংলাদেশের নির্বাচন বানচাল করার জন্য একটি দেশ উঠেপড়ে লেগেছে।  তারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী জিয়াউর রহমানের তৈরি করা দল বিএনপি এবং তাদের দোসর জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তাদেরই সমর্থন করছে বিশ্ব মোড়ল একটি দেশ। এতকিছু সত্ত্বেও আগস্টে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আবারও তুলে ধরার দায়িত্ব বর্তেছে বাংলাদেশের মানুষ এবং আওয়ামী লীগের ওপর।

                লেখক : ভারতীয় সিনিয়র সাংবাদিক

 

সর্বশেষ খবর