শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

চাঁচড়া পোনা বাজারের হালহকিকত

শাইখ সিরাজ

চাঁচড়া পোনা বাজারের হালহকিকত

যশোরের চাঁচড়ায় পোনা বাজার জমে ওঠে খুব ভোরে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা ক্রেতারা ভোরে সূর্য ওঠার আগেই পোনা কিনে ট্রাকে বা পিকআপ ভ্যানে করে পোনা নিয়ে চলে যায় গন্তব্যে। গত শতাব্দীর সেই আশির দশক থেকে বেশ কয়েকবার আমার চাঁচড়া পোনা বাজারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশে আজ মাছ চাষের যে বিপ্লব, দেশজুড়ে মাছ চাষের বিকাশ তার পেছনে চাঁচড়া পোনা বাজারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।  সে সময় থেকে দেশের চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ মাছের পোনা যেত চাঁচড়া থেকেই। ড্রোনের চোখে চাঁচড়া বাবলাতলার পোনা বাজারের চিত্রটা অন্যরকম সুন্দর। সারি সারি ছোট ছোট পুকুর। সেখানকার একেকটা পুকুর মূলত একেকটা শোরুম। যশোরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদন করা রেণু পোনা এখান থেকে বিক্রি করা হয়। গত ৪০ বছরে ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়েছে এ বাজার।

আগেই বলেছি প্রতিবেদন তৈরি করতে বেশ কয়েকবার আমি এখানে এসেছি। দেখেছি মাছ নিয়ে এখানকার মানুষের উচ্ছ্বাস, বাণিজ্যের বিস্তার, জীবিকার সংগ্রাম। তুলে ধরেছি তাদের কথা, সরকারের কাছে বিভিন্ন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দাবি। মাসদুয়েক আগে পুনরায় সেই মাছ বাজারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এবারের চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। চৈত্র থেকে আষাঢ় পর্যন্ত রেণু পোনা উৎপাদনের ভর মৌসুমেও পোনা বেচাকেনার বাজার তেমন জমে ওঠেনি। বাবলাতলায় মাছের রেণু ও পোনা বিক্রেতারা হাঁড়ি নিয়ে সারি সারি বসে থাকলেও নেই ক্রেতার ভিড়। পাইকাররা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে এ বছর পোনা বিক্রি কমে এসেছে আশঙ্কাজনক হারে।

একেকটি ছোট পুকুরই এখানে টাকার একেকটি ব্যাংক। পুকুরে লাখ লাখ টাকার পোনা নিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা। ক্রেতা তেমন নেই। একটি হাপা থেকে চলছিল পোনা তোলার কাজ। কথা হয় ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে। তারা পোনা বাজারে বেচাকেনা কমে যাওয়ার তিনটি কারণ উল্লেখ করলেন। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানি কমে যাচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলে মাছ চাষ সম্ভব হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, মাছের খাবার থেকে শুরু করে যাবতীয় উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে অনেকেই মাছ চাষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তৃতীয়ত, মাছের পোনা এখন অনলাইনে বেচাবিক্রি হচ্ছে। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা এখানে আর আসছেন না।

আমাদের দেশে মাছ চাষের যে বিপ্লব ঘটে গেছে, হেক্টরের পর হেক্টর জমিতে পুকুর কেটে মাছ চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। আমি ওই আশির দশক থেকে বর্তমান পর্যন্ত নিবিড়ভাবে দেশের মাছ চাষ সম্প্রসারণের চিত্রটি কাছ থেকে দেখছি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘হাকিম আলীর মৎস্য খামার’ দেখে অনুপ্রাণিত হাজারো তরুণ মাছ চাষে উদ্যোগী হওয়ায় এখন মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম। চাষের মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশ ও ভিয়েতনাম পাশাপাশি অবস্থান করছে। এ দুই দেশের জলবায়ু, পরিবেশ ও প্রতিবেশ কাছাকাছি। মাছের উৎপাদনে কাছাকাছি হলেও মাছ রপ্তানিতে ভিয়েতনাম থেকে আমরা পিছিয়ে আছি অনেকখানি। ২০১৯ সালে ভিয়েতনাম শুধু পাঙাশ রপ্তানি করে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। তাদের রপ্তানিকৃত মাছের পরিমাণ ছিল আড়াই লাখ টন। মাছ রপ্তানিতে আমাদের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ আমাদের চাষ ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে বাজার ব্যবস্থাপনার অনাধুনিকতা।

চাঁচড়া পোনা বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় যশোর হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদ গোলদারের সঙ্গে। তিনিও বলেন, ঐতিহাসিক এই বাজারটি তার জৌলুস হারাচ্ছে দিন দিন। অথচ হাজার হাজার মৎস্য চাষি আর শ্রমিকের কর্মসংস্থান এ বাজারকে ঘিরে। সময় পাল্টাচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত দেশগুলোতে পাল্টাচ্ছে বাজার ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে কর্মপদ্ধতি। কিন্তু আমাদের দেশের প্রযুক্তির ব্যবহার খুব কম। এখানকার মৎস্য ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল চাঁচড়ায় একটা আধুনিক পোনা বাজারের। মৎস্য চাষিদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে এ বাজার থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে একটি আধুনিক পোনা বিক্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করে সরকারের মৎস্য বিভাগ। সেটি দেখতে গিয়ে জানা গেল নির্মাণের তিন-চার বছর পরও চালু হয়নি মাছের পোনার আধুনিক বিক্রয় কেন্দ্রটি। বিশাল একটি ভবন কার্যহীন খালি পড়ে আছে বছরের পর বছর। সেখানে উপস্থিত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল স্বল্প পরিসর ও অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করায় কেন্দ্রটি ব্যবহার করতে আগ্রহী নন পোনা ও হ্যাচারি ব্যবসায়ীরা।

উপস্থিত ছিলেন যশোর মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ খানসহ বেশ কয়েকজন পোনা ব্যবসায়ী। ফিরোজ খান বললেন, পোনা বাজারের ভবনটি নির্মাণ হয়েছে ত্রুটিপূর্ণভাবে। ভবন নির্মাণের আগে একাধিকবার তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু ভবন নির্মাণ শুরু থেকে বরাদ্দ পর্যন্ত পোনা উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের কারও সঙ্গে কথা বলেনি, পরামর্শ নেয়নি। যাদের জন্য ভবন তৈরি হচ্ছে, তাদের মতামত নেওয়াটা জরুরি ছিল বলে মনে করেন ফিরোজ খান। এখানে এত মৎস্য চাষির মধ্যে মাত্র ১১১ জনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, যাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকেই মাছের পোনা উৎপাদন বা ব্যবসার সঙ্গে আগে জড়িত ছিল না। পানির সংকট নিয়েও কথা বলেন তারা। পানিতে আয়রনের পরিমাণ বেশি বলে কোনোভাবেই পোনা বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না বিক্রয় কেন্দ্রের চৌবাচ্চাতে। অথচ একটি আধুনিক বিক্রয় কেন্দ্রের স্বপ্ন ও দাবি ছিল বহুদিনের। প্রশ্ন হচ্ছে, দীর্ঘপ্রত্যাশিত এমন সব উদ্যোগ কেন ব্যর্থ হচ্ছে? এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? এ নিয়ে কথা বলি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভবনের ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। অতি শিগগিরই যাবতীয় সমস্যা সমাধান করে, ত্রুটি সারিয়ে ভবনটি চালু করার ব্যবস্থা নেবে সরকার। তিনি আরও বলেন, সরকারের এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা। সব ব্যবসায়ীকে এক জায়গায় নিয়ে আসার মতো জমি সরকারের নেই। তবে কেউ যদি বিনিয়োগে আগ্রহী হয়, তবে সরকার তাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে।

জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে কৃষিজমি ও উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বিরূপ জলবায়ুর কারণে প্রতি বছর ১ শতাংশ কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ কৃষিজমির উৎপাদন কমে যেতে পারে। উৎপাদন ক্ষমতা যদি ৩০ শতাংশ না কমে ১০ শতাংশও কমে তাহলেও কিন্তু কৃষির ওপর অনেক বড় প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি এর প্রভাব কৃষির উপ-খাতগুলোতেও পড়বে। তবে সংকটের বিষয় হচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে কৃষকরা অবগত নন। তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের নানামুখী আগ্রাসনে অনাকাক্সিক্ষত সমস্যার মুখোমুখি মানুষগুলোর পাশে যেখানে তথ্য ও প্রযুক্তিসেবা নিয়ে দাঁড়ানোর দরকার, সেখানে অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা তাদের ফেলে দিচ্ছে আরও বিরূপ পরিস্থিতিতে। আমার প্রত্যাশা চাঁচড়া পোনা বাজারের মানুষগুলোর শ্রমে ঘামে ক্রমে বেড়ে ওঠা স্বপ্নের পরিধি যেন অটুট থাকে।  তাদের উদ্যোগের ফসল বর্তমানে বিস্তৃত চাষের মাছের অর্থনীতি। তাই আজ সমূহসংকট মোকাবিলায় তাদের প্রস্তুত করতে হবে, থাকতে হবে নিবিড়ভাবে পাশে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব  

[email protected]

সর্বশেষ খবর