বুধবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

জাতির পিতার কখনো মৃত্যু হয় না

বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী

জাতির পিতার কখনো মৃত্যু হয় না

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলেও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দুটি ভূখন্ড এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষাভাষী নিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় এবং ওই রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর জাতিগত বৈষম্য, শোষণ-শাসন, দমন-পীড়ন ও প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে বাংলার কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, মুটে-মজুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তীব্র গণ আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪-এর স্বাধিকার আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান ও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তথা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের আগে প্রতিটি আন্দোলনের অভিন্ন ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক পটভূমি ও উদ্দেশ্য এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর কাছে দৃশ্যমান ছিল। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইস্পাতকঠিন মনোবল এবং সুদৃঢ় রাজনৈতিক নেতৃত্বে বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম স্বাধীনতাযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়, যে কারণে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পিতা হিসেবে নবরূপে আবির্ভূত হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন; যার পরিপ্রেক্ষিত রচনা ও সম্পূর্ণ নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু-প্রদত্ত বজ্রকণ্ঠে কালজয়ী ভাষণের দিকনির্দেশনার মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের জীবন উৎসর্গ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে ভৌগোলিক স্বাধীনতা লাভ করা সত্ত্বেও মহান নেতা কারাবন্দি থাকায় স্বাধীনতার স্বাদ অপূর্ণ থেকে যায়। অবশেষে মুক্তিকামী মানুষের আশীর্বাদে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা কারাজীবন শেষ করে দেশে ফিরে এলেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসার পর বাংলার নিপীড়িত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত গণমানুষের আর্থসামাজিক মুক্তি ও আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। তিনি সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসনের পরিবর্তে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। শোষণহীন সমাজ গঠনের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়। ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা’ সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ ও পাস হয়। ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সালে গণপরিষদে বাংলাদেশের খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাত্র ১০ মাসের মধ্যে জাতির পিতা বাংলাদেশের জনগণকে একটি পূর্ণাঙ্গ শাসনতন্ত্র উপহার দেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর নতুন সংবিধান কার্যকরের পর গণপরিষদ বাতিল করা হয়। ১৯৭২ সালে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ- এ চার মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে সংবিধান রচিত হয়। সংবিধানের চার মূলনীতি ঘোষণা কেবল ঘোষণাই ছিল না, ওই সংবিধানেই বলা হয়েছে, সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলো বাংলাদেশ পরিচালনার মূলনীতি হবে। আইন প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তা প্রয়োগ করবে, সংবিধান বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে নির্দেশক হিসেবে কাজ করবে এবং এটি রাষ্ট্র ও নাগরিকদের জীবন ও কার্যের মূল ভিত্তি হবে। আইন পদ্ধতির মৌলিক বিধি উপেক্ষা করে কোনো ব্যক্তিকে তার জানমাল ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যায় না। নির্বাহী কর্তৃপক্ষ বা আইন পরিষদের যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ প্রতিরোধকল্পে সংবিধানে ন্যায়বিচারের বিধান করা হয়। জাতীয় সংসদে অনুমোদিত বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে : ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ যা সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের শাসনের মূল দর্শন হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে। ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। জাতির পিতা ’৭২-এর সংবিধানে দেশের আপামর জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। মানবাধিকার, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা প্রণীত সংবিধানের নির্দেশনা অনুসরণের বিকল্প নেই। চার মূলনীতির মধ্যেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দিকনির্দেশনা রয়েছে। ’৫০-এর দশক থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিফলন ঘটেছিল আমাদের সংবিধানে। ’৭২-এর সংবিধান ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাঠামোগত রূপ। এরপর সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জাতির পিতার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯২টি পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি ও বাঙালি জাতির ইতিহাস বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে প্রথম বাঙালি নেতা হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে সমগ্র বিশ্বনেতার দৃষ্টি আকৃষ্টই করেননি, তিনি বিশ্ববাসীর কাছে নন্দিত হয়েছিলেন।

সদ্যস্বাধীনতাপ্রাপ্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে কাজ শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশকে লুটেপুটে খেতে চেয়েছিল, পাকিস্তানি শত্রুদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। দেশপ্রেম, নীতি ও নৈতিকতার কারণে স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্ষুশূলে পরিণত হন বঙ্গবন্ধু। শত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে যুদ্ধবিধ্বস্ত নবজাতক দেশকে পুনর্গঠন করে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তিনি। অনুরূপ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত বিশ্বাসঘাতক খুনি মোশতাক ক্ষমতার লোভে পাকিস্তানি পরাজিত শত্রুদের সঙ্গে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাদের গভীর ষড়যন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। ওরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা চিরতরে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের নিজ বাসভবনে স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ষড়যন্ত্রে সামরিক বাহিনীর বিপথগামী উচ্চাভিলাষী কিছু সেনা অফিসার ও সৈনিক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকদের নির্মম বুলেটে নিহত হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ, প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগনে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত এবং আমির হোসেন আমুর খালাতো ভাই আবদুল নঈম খান রিন্টুসহ মোট ১৮ জনকে হত্যা করেছিল। খুনিরা ক্ষমতায় বসাল তাদের ফরমায়েশি সরকারের প্রধান করে বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমদকে। জাতির পিতার খুনিদের বাঁচানোর জন্য মোশতাক ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের ক্ষমতা বেশিদিন টেকেনি। একই বছর ৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনিরা খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেরাই ক্ষমতা দখল করে নেয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে বিদেশের বিভিন্ন মিশনে চাকরি দিয়ে বঙ্গবন্ধু খুনিদের পুরস্কৃত করে। অন্যদিকে ইনডেমনিটি বিল সংসদে পাস করিয়ে জাতির পিতার হত্যাকান্ডের বিচার স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়। একই সঙ্গে রাজাকার, আলবদর বাহিনীর শীর্ষ নেতাদের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত লাল সবুজের পতাকা ওদের গাড়ি ও বাড়িতে উত্তোলন করে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত করেছে। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন।

বিচার বিভাগ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ। তিনি বিচারপ্রার্থী জনগণের দোরগোড়ায় ন্যায়বিচার পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই ভুখন্ডে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দক্ষ বিচার বিভাগ গঠনের জন্য দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও স্বাধীন বিচার বিভাগ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টসহ আমাদের বিচার বিভাগ বঙ্গবন্ধুর হাতেই সৃষ্টি হয়েছে। জাতির পিতার নির্দেশিত পথ ধরেই তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের বিচারব্যবস্থাকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নেওয়ার কাজে ব্রত আছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের বিচার বিভাগ হবে গণমুখী, দেশপ্রেমের সঙ্গে মানুষের সুখ-দুঃখ উপলব্ধির মাধ্যমে আইনানুগ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। বিচারের মর্মবাণী যেন বাংলার সর্বস্তরের প্রতিটি মানুষের বুঝতে কষ্ট না হয়। বিচারকের রায় বিচারপ্রার্থী প্রতিটি মানুষ যাতে সহজে বুঝতে পারে যে, আদালতের রায়ে বিচারপ্রার্থী ন্যায়বিচার পেয়েছে, এটা প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক। এ অনুভূতি থেকে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পন্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন তার পরে বাংলা ভাষা চালু হবে তা হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সেই বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু ছিলেন বদ্ধপরিকর। ১৯৭২ সালে রচিত আমাদের সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩২, ৩৩ অনুচ্ছেদে আইনের শাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশের স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমেই কেবল কোনো রাষ্ট্রে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আইনের শাসন ছাড়া গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ। সে কারণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীন বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। বঙ্গবন্ধুর চেতনা থেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই বিচারকদের মাতৃভাষায় রায় লিখতে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে আসছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন, কর্ম এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস এক ও অভিন্ন। তাঁর কর্মময় জীবনের ইতিহাসের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই মহান মানুষটি জীবনে যা করেছেন সবই ছিল দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল দেশের নিপীড়িত, নির্যাতিত ও অবহেলিত মানুষের স্বার্থে। স্ত্রী, কন্যা, পুত্র ও পরিবারের জন্য তাঁর কোনো সময় বরাদ্দ ছিল না। অপরিসীম ত্যাগের মহিমায় তাঁর জীবন মহিমান্বিত। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ সৃষ্টি হতো না। জাতির পিতা আজ সশরীরে আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর আদর্শ বাঙালি জাতির হৃদয়ে চিরজাগ্রত আছে। তিনি অম্লান, তিনি অমর, তিনি বেঁচে থাকবেন হাজার বছর। সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় তিনি কালের বিবর্তনে ক্রমান্বয়ে অধিক সম্মানের আসনে উদ্ভাসিত হবেন। মানবতাবাদী বিশ্বনেতার লাখো কোটি সন্তান অনুসরণ করবে জাতির পিতার আদর্শ। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অনন্তকাল এক ও অভিন্ন হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে পৃথিবীর মানচিত্রে। তাঁর আদর্শে গড়ে উঠবে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় স্বাধীন বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক এটিই জাতির প্রত্যাশা।

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়। আগস্ট এলেই বাংলার আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতি অশ্রুসিক্ত হয়। বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তাঁর মৃত্যু নেই, তিনি চিরঞ্জীব। জাতির পিতার কখনো মৃত্যু হয় না। তাঁর আদর্শ ধারণ করে এক মুজিব থেকে লাখো মুজিব সৃষ্টি হয়েছে বাংলার মাটিতে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি। বঙ্গবন্ধু বিশ্বের একমাত্র নেতা যিনি কেবল বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন। এ জাতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় গড়ে তুলেছেন। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম, যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল বাংলাদেশসহ বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী।

 

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সরকারি কৌঁসুলি

সর্বশেষ খবর