বুধবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

সমঝোতার পথে আসুন

মাজহারুল ইসলাম

সমঝোতার পথে আসুন

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে ইতোমধ্যে দেশে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকার ও বিরোধী দল দুই পক্ষেরই বক্তব্য তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চান। তবে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। সরকার বলছে- নির্বাচন হবে সংবিধান অনুসারে। নির্বাচিত সরকারের অধীনে। অন্যদিকে বিএনপিসহ বেশকিছু বিরোধী দলের দাবি- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। দুনিয়ার গণতান্ত্রিক সব দেশে নির্বাচন হয় নির্বাচিত সরকারের অধীনে। নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব তা প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালের নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য যেসব দেশ নন্দিত ইউরোপ আমেরিকার, সেসব দেশেও নির্বাচন হয় নির্বাচিত সরকারের অধীনে। আমাদের দেশে দলীয় সরকারের নির্বাচনী কারসাজির কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠেছিল কিন্তু সেই সরকারের ইতিহাসও স্বচ্ছ নয়। তত্ত্বাবধায়কের আড়ালে যে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের চর্চা হয় ওয়ান-ইলেভেন তা আমাদের শিখিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। বলেছেন, সংবিধানে অনির্বাচিত সরকারের স্থান নেই। ফলে দেশে গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলে সংবিধানের আলোকেই পথ খুঁজতে হবে। আমাদের নির্বাচনব্যবস্থার যেসব ত্রুটি আছে তা রোধের ব্যবস্থাও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জরুরি।

নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে মতানৈক্য থাকায় দেশে যেমন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে তেমনি উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বৈশ্বিক অঙ্গনে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে অস্থিরতার আশঙ্কা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ একটি মধ্যপন্থি, ধর্মনিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ এবং স্থিতিশীল দেশ। কিন্তু এ বছরের শেষে বা আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে এখানকার রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি ততই অস্থির হয়ে উঠতে পারে। গত ৩০ জুলাই নির্বাচন ভবনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক টেরি এল ইসলে সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। তারা স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম। তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। চাইলেও কমিশন এটা করতে পারবে না, কারণ পরিবর্তন করার জন্য কোনো আইনি ফ্রেমওয়ার্ক তাদের নেই। এটা নিয়ে আমরা কথা বলেছি। এ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলের সদস্য হিসেবে আমি মনে করি নির্বাচন কমিশন এ সরকারের অধীনে কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে। আমি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিনিধিত্ব করি না। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, তারা দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চান। আমরাও মনে করি নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে।’ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি আয়ারল্যান্ডের রাজনৈতিকবিষয়ক সিনিয়র সাংবাদিক নিক পউল বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আমরা আশা করছি সংবিধান অনুযায়ী তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সক্ষম হবে।

গত মাসে বাংলাদেশ সফরকালে ইউএনবিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে সমর্থন দেওয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের জনগণের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই। যুক্তরাষ্ট্র কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ নেয় না। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সংগঠন ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আর সম্ভব নয়। সবার সহযোগিতা নিশ্চিত করা গেলে সংবিধান অনুযায়ী বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। সংস্থাটির চেয়ারম্যান গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেহেতু অসাংবিধানিক, সে বিষয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই।  তারা চান নির্বাচন কমিশনে যে আইন আছে তার যেন সঠিক প্রয়োগ হয়। রাজনৈতিক দলগুলো ও সরকার যেন নির্বাচন কমিশনকে সমর্থন জোগায়।

গত মাসে দ্য ইউরোপিয়ান টাইমস ও ইইউ অবজার্ভারে প্রকাশিত ‘দ্য ইইউ মাস্ট নট সাপোর্ট অ্যা কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিবন্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক কমিশনার ও ধর্মবিষয়ক বিশেষ দূত এবং বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজির সদস্য ইয়ান ফিজেল বলেছেন, বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থন দেওয়া কোনোভাবেই উচিত হবে না। অনির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা দেওয়া হলে তা আবারও সামরিক বাহিনীর হাতে চলে যেতে পারে। যেমনটি ঘটেছিল ১৭ বছর আগে ২০০৬ সালে। সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে পার্থক্য নেই। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ কাটাতে সরকার ও বিরোধী দলকে আলোচনায় বসতে হবে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন  অনুষ্ঠানে কী কী করা দরকার সে বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। নির্বাচন যেহেতু নির্বাচন কমিশনের আওতায় অনুষ্ঠিত হয় সেহেতু কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব তা বর্তমান নির্বাচন কমিশন প্রমাণ করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থার ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে। তাহলে বাংলাদেশেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর