শিরোনাম
শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

নিরাপত্তা নিয়ে নানা ভাবনা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

নিরাপত্তা নিয়ে নানা ভাবনা

একটা সময় ছিল যখন সশরীরে বা অস্ত্র নিয়ে কোনো আক্রমণ হলে তা প্রতিহত করার কৌশল বা ক্ষমতাকে নিরাপত্তা বলে গণ্য করা হতো। পৃথিবীর বুকে স্নায়ুযুদ্ধ ধারণার প্রবর্তক ও আমেরিকার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়াল্টার লিপম্যান ১৯৪৩ সালেও মনে করতেন শত্রুর আক্রমণের মুখে কোনো দেশের বৈধ স্বার্থ অটুট রাখার সক্ষমতা অর্জন এবং যে কোনো চ্যালেঞ্জ যুদ্ধ করে মোকাবিলার শক্তিকে নিরাপত্তা বলা যায়। আমেরিকারই রাজনৈতিক বিশ্লেষক হ্যারল্ড ডি উইট লাসওয়েলের দৃষ্টিতে নিরাপত্তার অর্থ বিদেশিদের দিকনির্দেশনা থেকে মুক্ত থাকা। তবে কালের বিবর্তনে এ নিরাপত্তার ধারণা, পরিধি বা প্রভাব ক্রমেই বাড়তে থাকে। সত্তরের দশকে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব (১৯৭৭-১৯৮১) ও স্বনামধন্য পরমাণু বিজ্ঞানী হ্যারল্ড ব্রাউন এক ব্যাখ্যায় দাবি করেন- একটি দেশের পক্ষে বাহ্যিক ও ভূমির অখন্ডতা নিশ্চিত করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা, দেশের প্রকৃতিকে সুরক্ষা প্রদান, সীমান্তের প্রতিরক্ষা এবং বিদেশি হস্তক্ষেপ থেকে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ও শাসনব্যবস্থাকে সুরক্ষিত রাখার নামই হলো নিরাপত্তা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রসিদ্ধ নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও নিরাপত্তাবিষয়ক কর্মকান্ডে জড়িতদের সংগঠন আয়মার ডাউন গ্রুপ (বর্তমান নাম রি থিঙ্কিং সিকিউরিটি) ২০১৬ সালের প্রেক্ষাপটে ভয়, ক্ষুধা ও দরিদ্রতা থেকে মুক্তি, সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকা এবং ঝুঁকিমুক্ত সামাজিক পারিপার্শ্বিক ব্যবস্থা (প্রকৃতি ও পরিবেশগত) এবং স্বাস্থ্যকর জীবন ধারাকেই নিরাপত্তা বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। বর্তমানে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষা, দেশের অভ্যন্তরে বা সীমান্তে তৎপর অপশক্তিকে মোকাবিলা, সীমান্ত সুরক্ষার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি, জ্বালানি, স্বাস্থ্য, প্রকৃতি ও পরিবেশ, খাদ্য সর্বোপরি ডেটা (সাইবার) ব্যবস্থাপনাকে নিরাপদ রাখার কৌশলকে দেশটির নিরাপত্তা বলয় বলে বিবেচনা করা হয়।

বাংলাদেশে গত ২৮ আগস্ট সোমবার মন্ত্রিপরিষদে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদিত হয়েছে, যা একটি সময়োচিত পদক্ষেপ। অপপ্রয়োগের আশঙ্কা বাদ দিয়ে নির্মোহ দৃষ্টিতে আইনটি অনুধাবন করা প্রয়োজন। কারণ পৃথিবী আজ যতটা জাগতিক ততটাই যেন ভার্চুয়াল, যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আগেকার দিনে সিনেমা বা উপন্যাসে ব্যাংক ডাকাতির কথা জানা যেত। যেখানে কালো মুখোশ পরা ডাকাতরা বোমা ফাটিয়ে বা বন্দুকের গুলি ছুড়ে ব্যাংকের টাকা লুট করত। কিন্তু ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তৎকালীন ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনে এবং ২০ মিলিয়ন ডলার শ্রীলঙ্কায় নীরবে সরিয়ে ফেলে হ্যাকার নামক এ যুগের একদল ব্যাংক ডাকাত। এ জন্য তাদের ব্যাংকে যেতে হয়নি, এমনকি বাংলাদেশে আসতেও হয়নি, কোনো গুলি বা বোমা ছুড়তে হয়নি বা খুনখারাবি করতে হয়নি। এটাই সাইবার জগৎ, আর এখানেই প্রয়োজন যথাযথ নিরাপত্তা।

দেশের জনগণের তথ্যভান্ডার তথা জাতীয় তথ্যভান্ডারের তথ্য বা ডেটা চুরির ঘটনা ঘটেছে বহুবার। একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট হ্যাক বা অকার্যকর হয়েছে অসংখ্যবার। এমনকি পুলিশের জরুরি নাগরিক সেবা ৯৯৯-এর ফেসবুক পেজ দখল করে সেখান থেকে অপ্রাসঙ্গিক সব ভিডিও প্রচার করতে থাকে হ্যাকাররা। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) ওয়েবসাইট দখল করে তা অকার্যকর করে দেয় হ্যাকারদের আরেকটি দল। অথচ তখন পুলিশের অস্ত্র-গোলাবারুদের অভাব ছিল না। ৩০ আগস্ট ২০২৩ তারিখের সংবাদ থেকে জানা যায়- সরকারি কৃষি বিপণন অধিদফতরের ওয়েবসাইট থেকে ৪০ বছরের তথ্যভান্ডার উধাও হয়েছে। ১৫ আগস্ট ভারতীয় হ্যাকাররা বাংলাদেশে বড় ধরনের সাইবার আক্রমণের হুমকি দেয়। একুশে আগস্ট প্রকাশিত একটি বাংলা সংবাদপত্রের তথ্যমতে, ১৫ থেকে ২১ আগস্ট এ ছয় দিনে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন ধরনের ৩৬টি প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় হ্যাকাররা হামলা চালিয়ে কারও তথ্যভান্ডার উন্মুক্ত করে দেয় আবার কারও কারও ওয়েবসাইট দখল ও অচল করে রাখে। আগে প্রতিটি থানা এলাকায় কতটি চুরি বা ডাকাতি হলো তার হিসাব রাখা হতো এবং এ হিসাবের ওপর ভিত্তি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি বা অবনতির গ্রাফ আঁকা হতো। আজ থানা পুলিশ তথ্য চুরি, ব্যাংকের টাকা সরানোর মতো অপরাধ কোন পরিসংখ্যানে দেখানো হয় তা জানা নেই, তবে এটা জানা আছে সাইবার অপরাধ মোকাবিলার মতো প্রশিক্ষিত জনবল ও সরঞ্জাম আমাদের নেই। ফলে এক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রণীত বায়ুদূষণবিষয়ক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ৩০ আগস্ট প্রকাশিত এ দেশের একটি বাংলা সংবাদপত্রে। এতে বলা হয়- বিশ্বের বুকে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হলো বাংলাদেশ এবং এ দেশের ১৬ কোটি ৪৮ লাখ মানুষ সারা বছর দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে। এর ফলে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ছয় বছর আট মাস করে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল মেয়াদে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ ছিল বাংলাদেশ আর সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় নিচ থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ঢাকা। হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্টসহ পাঁচটি রোগে ভুগছে এ দেশের কয়েক কোটি মানুষ। সম্প্রতি করোনার (কভিড-১৯) ছোবল কেড়ে নিয়েছে বহু প্রাণ, বিপর্যস্ত করেছে দেশের অর্থনীতি। বর্তমানে চলছে ডেঙ্গুর ছোবল। ম্যাড কাউ, বার্ড ফ্লু (bird flue) কিংবা এনথ্রাক্সের মতো রোগ তছনছ করছে দেশের পশু ও পোলট্রি শিল্প। নদী-নালায় বয়ে চলেছে বিষাক্ত পানি, যেখানে মাছ এমনকি কীটপতঙ্গও টিকতে পারে না। মাছ ও মুরগিকে খাওয়ানো হচ্ছে বিষাক্ত বর্জ্য। আর এসব মাছ-মুরগি খেয়েই বেঁচে আছি। আমাদের সব জেলায় আইসিইউ নেই, বার্ন ইউনিট নেই। আবার চিকিৎসা যন্ত্র থাকলেও তা চলে না বা চালানোর মানুষ নেই। জনজীবনের নিরাপত্তায় তাই সেনাবাহিনী বা পুলিশের পাশাপাশি দরকার স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশাল বাহিনী। মানুষের জীবন বাঁচাতে আজ বুলেট বোমার পাশাপাশি দেশের প্রতি উপজেলায় প্রয়োজন ভ্যাকসিন, সিরিঞ্জ, ভেন্টিলেটর ও অক্সিজেন সিলিন্ডার। সেখানেই যেন আজ নিরাপত্তার ভিত্তি।

বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলসহ বাংলাদেশের একটা অংশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে বলে আগেই পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বের বহু গবেষণা সংস্থা। তবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতোমধ্যে উপলব্ধি করছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি ক্রমাগত বৃষ্টিতে নিমজ্জিত ছিল চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা। পাহাড় বা ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে বহু স্থানে। যে গাছের বিস্তীর্ণ শিকড় পাহাড় বা মাটি কামড়ে ধরে ভূমিধস ঠেকানোর কথা ছিল, সে গাছ আমরা কেটে সাবাড় করে ফেলেছি। গাছের অভাবে আবার উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে শহরাঞ্চলে, নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। সাগরের নোনা পানি মাটির নিচ দিয়ে সমতলের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। সিডর কিংবা আইলার মতো সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় কয়েক মিনিটেই নিঃস্ব করে দিচ্ছে উপকূলীয় মানুষের জীবন। পানযোগ্য মিষ্টি পানির সন্ধানে প্রতিনিয়ত ছুটছে তারা। এক কথায় বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব ও নিশ্চিত ক্ষতির সামনে নিরাপদ নয় বাংলাদেশ নামের এ জনপদ।

আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা দাবি করি। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের বরাতে ২৯ আগস্ট একটি পত্রিকা লিখেছে- আসছে বছরে বাংলাদেশে ২০ লাখ টন চাল আমদানি করতে হবে। ভারত ও মিয়ানমারের চাল সংক্রান্ত নীতিমালা ও চালের ওপর ধার্যকৃত কর চিন্তার ভাঁজ ফেলে বাংলাদেশের মানুষের কপালে। ডিম, মুরগি, গরুর গোস্ত, পিঁয়াজ, কাঁচা মরিচ- সবকিছুর দাম ওঠানামা করে আমাদের আমদানি নীতি বা ভারতের রপ্তানি নীতির ওপর। অথচ বিশ্বের বহু দেশ আফ্রিকা অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদে জমির লিজ নিয়ে সেখানে নিজ জনগণের প্রিয় বা প্রধান খাবারের উপকরণ বা শস্যদানা উৎপাদন করছে তাদের দেশেরই জনবল সেখানে নিয়ে। এসব দেশ খাদ্য নিরাপত্তা ও বেকারত্ব নিয়ে ভাবছে বলেই এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা কি ভাবছি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে? কোনো কারণে দেশের আমদানি বিঘিœত হলে বিদেশ থেকে আনা গুঁড়াদুধের ওপর নির্ভরশীল আমাদের শিশুরা কী খেয়ে বাঁচবে? অন্তত শিশুদের জন্য নিরাপদ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ খাদ্য নিরাপত্তা আমরা কবে গড়ে তুলব?

জ্বালানি নিরাপত্তাও আজ ঝুঁকির মুখে। কয়লার অভাবে পায়রা ও রামপালের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে অনেকবার। গ্যাসের সংকটও সৃষ্টি করেছে নানা জটিলতা। অথচ আমাদের বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলের কয়লা কিংবা বঙ্গোপসাগরের তলদেশের তেল বা গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা তৈরি হয়নি ৫০ বছরে। আজও আমরা ভাবছি বঙ্গোপসাগরের কোন ব্লকে চায়না আর কোন ব্লকে আমেরিকা গ্যাস অনুসন্ধান করবে। অনুসন্ধান যারাই করুক স্বার্থ বিঘিœত হলে এ গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে কুরুক্ষেত্র সৃষ্টি হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? অথচ জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে ও অনুসন্ধান চালানোর লক্ষ্যে সক্ষমতা অর্জনের জন্য ৫০ বছর যথেষ্ট সময়।

সার্বিকভাবে বলা যায়- বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে কেবল দেশের ভূখন্ডের নিরাপত্তার কথা ভাবলেই চলবে না, ভাবতে হবে আমাদের সাইবার জগৎ, অর্থনীতি, জৈব জগৎ ও বায়ু, প্রকৃতি পরিবেশ, জলবায়ু, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়েও। এ বিষয়ে উদাসীনতার অভাব অরাজকতা ও হিংস্রতা উসকে দেয়, যা অনেক ক্ষেত্রে দেশ রক্ষার জন্য নিবেদিত বাহিনীগুলো বুলেট-বোমা দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যার অসংখ্য উদাহরণ পৃথিবীর বুকে রয়েছে।

ইংল্যান্ডের এককালের রাজবধূ প্রয়াত প্রিন্সেস ডায়ানা আজ থেকে ২৬ বছর আগে (৩১ আগস্ট ১৯৯৭) কার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। তবে ধারণা করা হয় যে, ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্সটিনের এজেন্টরা রাজপ্রাসাদের ইশারায় এমন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। শেষ করছি প্রিন্সেস ডায়ানার একটি করুণ উদ্ধৃতি দিয়ে- ‘আমি মূল্যবান উপহার চাই না। আমি চাই না কেউ আমাকে কিনে নিক। যা কিছু প্রয়োজন, সবই আছে আমার। আমি শুধু চাই কেউ একজন থাকুক, যে আমাকে উপলব্ধি করতে দেবে যে আমি নিরাপদ ও সুরক্ষিত।’

 

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

email : [email protected]

সর্বশেষ খবর