শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

হোঁচট খায় পাকিস্তান, গতিময় বাংলাদেশ

অ্যাডাম এরেলি

হোঁচট খায় পাকিস্তান, গতিময় বাংলাদেশ

পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পালনের জন্য দেশটির অষ্টম অন্তরবর্তী সরকার ১৪ আগস্ট (২০২৩) শপথ নিয়েছে। এর কয়েকদিন আগেই দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থীকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। এ যেন আগ্নেয়গিরির মুখে কাবুকি (কাবুকি জাপানের একধরনের নাটক) মঞ্চায়ন। বস্তুত, গত বছরের এপ্রিলে সেনাবাহিনীর নকশায় ইমরান খানকে অপসারণ এবং তারপর তাকে তিন বছরের কারাদন্ড দেওয়ার ঘটনা সামরিক একনায়কত্ব কবলিত রাষ্ট্রের অসহায়ত্ব।

ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড (আইএমএফ) পাকিস্তানকে ৬০ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার সহায়তা দেয়। জুলাই মাসে তারা অর্থসংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য (বেলআউট) ২০তম ঋণ দিয়েছে। পাকিস্তানের এই হতদশা ১৯৭১ সালে পৃথক হওয়া বাংলাদেশের থেকেও খারাপ। পাকিস্তান বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর তালিকায় ছিল ১৯৭১ সালে। অখন্ড পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, শিল্প ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের ভাগে রেখে ওই বছর পাকিস্তান বিভক্ত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও চীনের মাও সেতুংয়ের মধ্যে ঐতিহাসিক সমঝোতায় মধ্যস্থতা করছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। এর ফলে দেশটি বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে সক্ষম হয়। পাকিস্তানের প্রতি ওই সময় পশ্চিমাদের ছিল পূর্ণ সমর্থন।

পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ ছিল ভঙ্গুর। ভোলায় ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল এরপর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারায় ৩০ লাখের বেশি মানুষ। বেঁচে যাওয়া মানুষের ৮০ শতাংশ ছিল অতি দরিদ্রতার মধ্যে। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল ছিল যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদশেকে ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ বলে অভিহিত করেন। যদিও পরে তিনি তার ওই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন।

এরপর কেটে যায় ৫২ বছর। এখন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অবস্থা গেছে বদলে। বিশ্বে এখন খুব কম দেশই পাকিস্তানের মতো ‘ভঙ্গুর এবং ভীতসন্ত্রস্ত’ অবস্থায় আছে। পরমাণু অস্ত্রে শাক্তিমান পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতি ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে- এই ভয়েই পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা ভোটাভুটি বিলম্বিত করছেন। ভারতের দিকে আঙ্গুল উচিয়ে কয়েক দশক ধরে সামরিক নেতারা ইসলামি চরমপন্থাকে উৎসাহিত করেছেন। পরনতিতে সেই জঙ্গিদের আস্ফালন-সন্ত্রাসের কারনে এখন পাকিস্তানের কিছু কিছু অংশে বিরাজ করছে ‘শাসন চালানো অসম্ভব’ পরিস্থিতি।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ এশিয়ার স্থিতিশীল সরকারগুলোর অন্যতম। দেশটিতে ইতিহাসের দীর্ঘ সময় শাসনকারী নারী নেতৃত্ব রয়েছে। পাকিস্তানের মতো ঢাকা রাজনৈতিক মতলবে ধর্মীয় চরমপন্থাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেনি। ৫০ বছর আগে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের অর্ধেক। কিন্তু এখন বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের দ্বিগুণ এবং এটা দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশের শিশু মৃত্যুর হার পাকিস্তানের এক তৃতীয়াংশ; নারী শিক্ষার হার ৫৮ শতাংশ বেশি। বহু আগে পোলিও বাংলাদেশ থেকে সমূলে উৎপাটিত হয়েছে। পাকিস্তানে এখনো পোলিও রয়েছে।

খুব সম্ভব বলার মতো সবচাইতে বড় পার্থক্য- দুই দেশের জলবায়ু পরিবর্তনগত দুর্বলতা। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ১৯৭০ সালের ভোলার ঘূর্ণিঝড়। দেশটির প্রায় এক চতুর্থাংশ ভূখন্ড সমুদ্রপৃষ্ঠথেকে ৭ ফুটেরও কম উঁচুতে অবস্থিত। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাপক ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন মোবাবিলায় বছরের পর বছর বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। সমগ্র গ্রামকে তারা নিয়ে যাচ্ছে ক্ষতির বাইরে। তুলনায় পাকিস্তান ২০২২ সালে বন্যায় খুবই বিপর্যস্ত হয়। দেখা গেছে, দুর্যোগময় আবহাওয়ার সামনাসামনি হওয়ার প্রস্তুতি পাকিস্তানের সবথেকে কম। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে সংস্কৃতিগত, ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক অনেক মিল। তাহলে তাদের মধ্যে এত পার্থক্য কেন!

পার্থক্যের কিছু অংশ রাজনৈতিক। বাংলাদেশে রয়েছে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা। আর এটাই টেকসই উন্নয়নের অবস্থা তৈরি করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালে হত্যা করা হলে তার মেয়ে শেখ হাসিনা রাজনীতিতে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর জামানায় বিগত ১৫ বছরে দেশে দর্শনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জ্বালানি, সড়ক এবং অবকাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশের গার্মেন্টস শিল্প প্রসারে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ায় গার্মেন্টস রপ্তানি ব্যাপক সম্প্রসারিত হয়। আর এটা লাখো মানুষকে বিশেষ করে নারীদের দরিদ্রতা থেকে বের করে এনেছে। বাংলাদেশের বার্ষিক রপ্তানি পাকিস্তানের দ্বিগুণ।

পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যে আরেকটা পার্থক্য হলো- প্রভাবশালী আঞ্চলিক খেলোয়াড় ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়নি বাংলাদেশ। ১৯৪৮ সালে দেশভাগের সময় কাশ্মীর ভারতের কাছে যাওয়াকে ‘পরাজয়’ মনে করেন পাকিস্তানের অভিজাত শ্রেণী। তাই তারা, জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায় তা ধীরে ধীরে দেশটিকে বিষাক্ত করে তোলে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিরক্ষা ব্যয় পাকিস্তানের একক বৃহত্তম বাজেট বরাদ্দ বিষয় হয়ে রয়েছে। পাকিস্তান বর্তমানে সামরিক খাতে জিডিপির ৪ শতাংশ ব্যয় করে, যেখানে বাংলাদেশের ব্যয় ১.৯ শতাংশ। পাকিস্তানের চারটি বৃহত্তম ব্যবসা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান সশস্ত্র বাহিনীর হাতে গড়া এবং নিয়ন্ত্রিত।

সীমিত সম্পদ দিয়ে বিশাল এক নিরাপত্তা সরঞ্জাম রক্ষনাবেক্ষনে ত্যাগের প্রয়োজন; নইলে সেটা অস্থিরতার কারণ হতে পারে। পাকিস্তান তার সামর্থ্যের বাইরে খরচ করে বিপ্লব এড়াতে পেরেছে। অবিরাম রক্তশূণ্যতাপ্রবন অর্থনীতি সত্ত্বেও, গড়পড়তা পাকিস্তানি পরিবার গড়পড়তা বাংলাদেশি পরিবারের চেয়ে বেশি খরচ করে। অথচ জিডিপির শতাংশ হিসাবে পাকিস্তানের মোট মূলধন বাংলাদেশের ভগ্নাংশের সমান। আন্তর্জাতিক এক অর্থনীতিবিদ পাকিস্তানের দুর্দশার চমৎকার এক বিবরণ দিয়েছেন এভাবে: প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াই পাকিস্তানের আচরণ অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ রফতানিকারকদের মতো। দেশটির সমাজ মধ্যম আয়ের বা উচ্চ-আয়ের ভোগী সমাজ নয়; এটি একটি নিম্ন-আয়ের ভোক্তা সমাজ। তাই, পাকিস্তানিরা ধারাকর্জ করে হলেও তাদের বাইরের ঠাঁট বজায় রাখে।

বাংলাদেশের দ্রুত উত্থান এবং পাকিস্তানের ক্রমাগত পতন মার্কিন নীতিপ্রনেতাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে। প্রথমত, সামরিক বাহিনীর আধিপত্যাধীন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো ঋণপরিশোধ ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে- এরকম কোনো ভ্রমে ভোগা উচিত নয়। দ্বিতীয়ত, যেসব রাষ্ট্র ইসলঅমকে মতলবী কাজে ব্যবহার করে- যেমন ভারতের বিরুদ্ধে হাক্কানি নেটওয়ার্ক ও অন্যান্য জঙ্গীদের ব্যবহার করেছিল পাকিস্তান- তাদের চাইতে নিরাপদ হচ্ছে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্র যারা সফলভাবে রাজনৈতিক ইসলামকে ম্যানেজ করে। এটাও শিক্ষনীয় যে, ভোটারদের কল্যানে যেসব সরকার নিবেদিত-যেমন বাংলাদেশ সরকার- তারা সমর্থন পাওয়ার যোগ্য।

 

লেখক : বাহরাইনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত। নিবন্ধটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন ‘টাউনহল’ সাময়িকীতে ২৫ আগস্ট ২০২৩ প্রকাশিত

সর্বশেষ খবর