শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ডলার নিয়ে ডঙ্কা ও ডেঙ্গুর শঙ্কা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

ডলার নিয়ে ডঙ্কা ও ডেঙ্গুর শঙ্কা

প্রিয় পাঠক, যখন এই লেখা পড়ছেন, সবকিছু ঠিক থাকলে ততক্ষণে আমার দেশের বাইরে থাকার কথা। অনেক দিন আগে থেকেই অক্টোবর মাসের আগে আগে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় ঘটে যাওয়া ইতিহাসের গতি পাল্টে দেওয়া অক্টোবর বিপ্লব নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা ছিল। কারণ সমসাময়িক বহু ঘটন-অঘটন এ অক্টোবর বিপ্লবের কথা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল। তবে বিস্তারিত লেখার জন্য প্রয়োজন গবেষণা বা লেখাপড়া, যা সময় ও ধৈর্যসাপেক্ষ। সেই সময় আর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে দেশের ডলার সংকট। যদিও অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে একমাত্র মেয়ে এসব শুনে বারবার এক কাপড়ে চলে যেতে বলেছে, তবুও বাবা হিসেবে হাতে কিছু ডলার নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু না, বৈধভাবে ডলার কেনার কোনো পথ খোলা নেই। যে ব্যাংকে আজ প্রায় ৩৫ বছর বেতন-ভাতা-পেনশন জমা হচ্ছে, তারা না বলে দিয়েছে। সামরিক বাহিনীর নিজস্ব ব্যাংকে গিয়ে ফিরে এসেছি। মানি এক্সচেঞ্জগুলোর কাউন্টারে কাউন্টারে ধরনা দিয়েছি দিনের পর দিন। না, কেউ ডলার বিক্রি করে না। কেউ কেউ এমনভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন ডলার নয়, আমি মাদক কিনতে এসেছি। আবার ছোট চুল দেখে কেউ মাথা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত পরখ করে না করেছে। হয়তো গোয়েন্দা সংস্থার লোক ভেবেছে আমাকে। অথচ এই আমি প্রায় এক যুগ বিদেশে সম্মানজনক কাজ করেছি। সাধ্যমতো বৈধ পথে ডলার পাঠিয়েছি দেশে। অথচ আজ আমার প্রয়োজনে বৈধ পথে একটি ডলার পাওয়ার উপায় নেই। অথচ খবরের পাতা খুললেই দেখি দেশের বাইরে বাড়ি-গাড়ি ও ডলারের পাহাড় রয়েছে এ দেশের কিছু মানুষের। এই মানুষ নামের অমানুষগুলোকে অক্টোবর বিপ্লবের কথা পড়তে, জানতে ও অনুধাবন করতে বিনীত অনুরোধ জানাই।

১৪৬২ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৪৫৫ বছর ধরে বর্তমান রাশিয়া ও তৎসংলগ্ন বেশ কিছু এলাকা একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচারতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক টিজার (সিজার) সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সম্রাট তৃতীয় ইভান (১৪৪০-১৫০৫) থেকে শুরু করে সর্বশেষ সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাস (১৮৬৮-১৯১৮) পর্যন্ত বহু একনায়ক বর্তমান রাশিয়া ও আশপাশের এলাকায় গড়ে তুলেছিলেন এক কঠোর শাসনব্যবস্থা। কিন্তু এত পুরনো সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটেছিল অক্টোবর বিপ্লবে। দ্বিতীয় নিকোলাস শুধু ক্ষমতাই নয়, দেশও ছেড়ে ছিলেন এই বিপ্লবের শেষে। কিন্তু রেহাই পাননি বিপ্লবীদের হাত থেকে। তাকেও সপরিবারে পুড়িয়ে মারা হয়। আমরা সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসের নাম না শুনলেও ইউরো-ক্যারিবিও ব্যান্ড বনিএমের একটি জনপ্রিয় গানের সুবাদে রাসপুতিনের কথা শুনেছি। নিকোলাসের পারিবারিক বন্ধু ও ধর্মগুরু রাসপুতিন সামনে আসতেন না। কিন্তু তার প্রভাব ও পরামর্শেই সাম্রাজ্যের কলকাঠি নড়ত। আজ বাংলাদেশের অনেক দলের নেপথ্যেই যেন কাজ করছে কোনো না কোনো রাসপুতিন। তারাই দেশে-বিদেশ অবস্থান করে অশান্ত করে চলেছে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ এমনকি ধর্মীয় পরিবেশও। তারপরও রাসপুতিনের খোঁজে হন্যে হয়ে দেশে দেশে ছুটছে একশ্রেণির মানুষ। তারা দেশে দেশে ঘুরতে আর লবিস্ট নামের এ যুগের রাসপুতিনদের খুশি করতে কোথায় ডলার পায়, সে প্রশ্নের উত্তর মেলে না।

বিমানবন্দরে এসেই অনেক প্রবাসী শ্রমিকের দেখা পাই। কেউ প্রথম যাচ্ছে, কেউবা আবার ছুটি শেষে ফিরছে কর্মস্থলে। হিসাব মতে, ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি আজ প্রবাসী। তাদের বড় অংশই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে এবং দেশে পাঠায়। দেশে বৈধ পথে ডলার পাঠালে প্রণোদনাসহ যে মূল্য পাওয়া যায়, হুন্ডি চক্র তার চেয়ে বেশি মূল্যের প্রলোভন দেখায়। এ প্রলোভন থেকে নিজেকে দূরে রাখার মতো নৈতিক ক্ষমতা অনেকেরই নেই। তবে হুন্ডি ব্যবসা প্রতিরোধের জন্য আইন আছে, আরও আছে আইন প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন কর্তাব্যক্তি ও সংস্থা। অথচ হুন্ডি ব্যবসা চলছে তো চলছেই। যারা তাদের চেনার কথা, ধরার কথা, তারা দৃশ্যমানভাবে তৎপর হলে ডলার সংকট কিছুটা হলেও হ্রাস পেত। তপ্ত মরুর বুকে ঘাম ঝরিয়ে দেশে ডলার পাঠায় প্রবাসী শ্রমিকরা। গার্মেন্ট কন্যারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ডলার উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেয় মালিক পক্ষকে, যাদের অনেকেই আজ সরকার ও প্রশাসনের অংশ। তারপরও দেশে এমন ডলার সংকট সত্যিই দুঃখজনক। বিমানবন্দরে মশার যন্ত্রণা আবারও টের পেলাম। মনে পড়ল আমার সহকর্মী হিসাব শাখার মামুনের কথা। এই বেচারাও আমার জন্য হন্যে হয়ে চেনাজানা সব ব্যাংকে ঢু দিয়েছে, না বৈধ পথে সরকারি মূল্যে সেও ডলার জোগাড় করতে পারেনি। তবে জোগাড় করেছে একখান মেডিকেল টেস্ট রিপোর্ট যাতে লেখা আছে ডেঙ্গু পজিটিভ। রক্তচক্ষু নিয়ে দ্রুতই বাড়িতে ফিরতে হয় তাকে। অথচ বিদেশে যাওয়ার আগে হিসাব শাখার এই মানুষটিকে আমার বেশি প্রয়োজন ছিল দাফতরিক কাজে। এখন তার ডলার চাই না ডেঙ্গু সামলা অবস্থা। সবাই পরামর্শ দিচ্ছে ডাব ও অন্যান্য তরল পানীয় গ্রহণ করতে। অথচ এ দেশে ডাব ও স্যালাইন নিয়েও নাকি সিন্ডিকেট হয়। পৃথিবীর কোনো দেশে ভোক্তা অধিকারের সরকারি কর্মব্যক্তিরা ডাবের মূল্য বৃদ্ধি তদন্ত আর ডাব বিক্রেতাকে শাসন করেছেন বলে মনে হয় না।

ডেঙ্গু নিয়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা বিভিন্ন হাসপাতালে। বিশেষত এক একটি অবুঝ শিশুর মৃত্যু আমাদের হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি করে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে নতুন কেনা বহু যন্ত্র অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জেলায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট থেকে নির্মিত একাধিক সরকারি ভবন ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বহু আগে নির্মিত হলেও সেখানে কোনো কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় তা আজ মাদকের আড্ডা কিংবা পরিত্যক্ত ভবনে পরিণত হয়েছে। অথচ সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করার মতো কোনো বিছানাও পাওয়া যাচ্ছে না। এডিস মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের ন্যক্কারজনক ঘটনা কিংবা সরকারি কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ব এড়ানোর বক্তব্য কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভবিষ্যতে এ ডেঙ্গু বাড়বে বলেই বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ শঙ্কা প্রকাশ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত এবং সরাসরি দিকনির্দেশনায় পরিচালিত কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম একদিকে যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে এবং স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে ঠিক তখন তাঁর মন্ত্রী কিংবা মেয়রদের কার্যক্রমে জাতি নিতান্ত লজ্জিত ও শঙ্কিত।

আমাদের অর্থনীতির আকার আগের চেয়ে অনেক বড় হয়েছে। আরও বড় অর্থনীতির দেশ হতে চলেছি আমরা, অথচ এ দেশের বিমানবন্দরে এসে মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার কিনতে পারলাম না। বহু দেশ ঘুরেছি বছরের পর বছর ধরে। এমন একটা দুঃখবোধ নিয়ে কখনো দেশ ছাড়িনি। আসছে অক্টোবর মাসে দেশের রাজনীতি রাজনৈতিক অঙ্গন আরও উত্তপ্ত থাকার ইঙ্গিত স্পষ্ট। প্রার্থনা করি নিরাপদে থাকুক দেশের মানুষ। সেদিনের স্বপ্ন দেখি যেদিন ওয়াশিংটনের মানুষ ব্যাংকে আর মানি এক্সচেঞ্জে বাংলাদেশের টাকা খুঁজবে আর লন্ডনের মোড়ে মোড়ে সাইনবোর্ড ঝুলবে ‘এখানে স্বল্প সময়ে বাংলা শিখানো হয়’। হাসবেন না প্রিয় পাঠক। একদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরির আশায় বাংলা শিখত ইংরেজরা। আমাদের ঐশ্বর্য তেমনটাই ছিল। যে ইংরেজরা আমাদের সম্পদ লুটে নিয়ে গেছে, তাদের বিচার হয়নি। কিন্তু এ যুগে যারা এভাবে ডলার লুট করছে, তাদের বিচার একদিন হবেই হবে- এটাই প্রত্যাশা। দেশে ডলার সংকট নেই বলে যারা ডঙ্কা বাজিয়ে ছিলেন, তাদেরও বিচার হবে বলে আশা করি।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

email: [email protected]

সর্বশেষ খবর