শিরোনাম
শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

নেদারল্যান্ডসে প্রযুক্তিনির্ভর ফলবাগান ব্যবস্থাপনা

শাইখ সিরাজ

নেদারল্যান্ডসে প্রযুক্তিনির্ভর ফলবাগান ব্যবস্থাপনা

পৃথিবীতে কৃষিশিল্পের আজকের যে বিকাশ, তাতে অনন্য ভূমিকা রেখেছে ব-দ্বীপ রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডস। শুধু কৃষিপণ্যের উৎপাদনই নিশ্চিত করেনি তারা, কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষিজ্ঞানকে সম্পদে রূপান্তর করতে সমর্থ হয়েছে দেশটি। ক্রমেই নেদারল্যান্ডস হয়ে উঠেছে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির সূতিকাগার। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহারের বিকল্প যে নেই, সেই সত্য উপলব্ধি করে অনেক দূর এগিয়েছে তারা।  প্রিয় পাঠক, এর আগে একাধিকবার নেদারল্যান্ডসের কৃষিপ্রযুক্তি ও গবেষণার অনেক বিষয় আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি। ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টার, ফ্লোটিং ফার্ম, রয়্যাল আইকোলকাম্প থেকে শুরু করে ভাগিনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিষয়ক গবেষণা নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করেছি চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে। নেদারল্যান্ডসে কৃষিকে ঘিরে নানামুখী আয়োজন। বিশেষ করে কৃষিশিল্প ও কৃষিবাণিজ্য নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ‘ডেলফি’ এমনই এক প্রতিষ্ঠান, তাদের কাজ হচ্ছে ফলবাগান ব্যবস্থাপনা নিয়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অব থিংসের সফল ব্যবহারে এ প্রতিষ্ঠান ফল উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, পাশাপাশি দিচ্ছে ফলবাগান গড়ে তোলার কারিগরি সহযোগিতাও। গত বছর এপ্রিলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল নেদারল্যান্ডসের জিল্যান্ড নামক এলাকায়। ওই এলাকাটির মূলত ফলবাগানের জন্য বিশেষ খ্যাতি রয়েছে।

সেখানে গিয়ে পরিচয় হলো দীর্ঘদেহী এক তরুণের সঙ্গে। নাম রেনে বল্। তিনি ডেলফির ফল উৎপাদন বিভাগের প্রধান। রেনে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানালেন। বললেন, ডেলফি সাধারণত ফুল ও ফল নিয়ে কাজ করে। যে বাগানটিতে আমরা গিয়েছিলাম সেখানে পিয়ার ও আপেল চাষ হচ্ছিল। তারা বাগান ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করেছে মূলত তা দেখতেই আমাদের সেখানে যাওয়া। বাগানটি ২০ হেক্টর জমিতে। রেনে মূলত ডেলফির কনসালটেন্ট। পাশাপাশি তিনি তার চাচাকে নিয়ে ওই বাগানটি পরিচালনা করছেন। ওই এলাকায় যত ফলবাগান আছে, তাদের প্রযুক্তি ও এর প্রায়োগিক বিষয়টি শিখিয়ে দেওয়াই রেনের কাজ। সোজাসাপ্টায় বললে, বলতে হয়, তারা আসলে প্রযুক্তিজ্ঞান বিক্রি করছে। আমরা যে সময়টিতে সেখানে গিয়েছিলাম তখন মূলত আপেল আর পিয়ারের ফুল আসার মৌসুম। সারি সারি পিয়ার আর আপেলের গাছ। ২০ হেক্টর জমির সাড়ে তিন হেক্টর জমিতে পিয়ারের বাগান, ৮ হেক্টরে আছে আপেল চাষ আর বাকি জমিতে অন্যান্য ফল চাষ করছে।

গাছে গাছে ফুলের সমারোহ। ইতোমধ্যে ফলের অবয়ব দেখা দিয়েছে। রেনে একটি পিয়ার গাছের ডাল দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে দেখুন, এই ডালের তিনটি ফলের একটি প্রকৃতগতভাবেই বলিষ্ঠ হবে আর আমাদের কাজ হবে বাকি দুটিকে সরিয়ে ফেলা। ভালো উৎপাদনের স্বার্থেই এই কাজটি করতে হবে।’ সময়টা তখন এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ। রেনে জানালেন আর চার মাস পরেই ফল হার্ভেস্ট শুরু হবে। অর্থাৎ ছয় মাসের এই ফল উৎপাদন কার্যক্রম। বেশ গোছানো ফলের বাগান। প্রকৃতি আর প্রযুক্তির সমন্বয়ে এখানে চলছে দারুণ কৃষি আয়োজন। রেনে বলতে থাকলেন, ‘একেকটি গাছে ৬ থেকে ৭০০’ ফল এসেছে। আমরা কিন্তু প্রতিটি গাছে ১০০ করে ফল রাখব।’

‘ঠিক ১০০টিই?’- জানতে চাইলাম আমি। রেনে বললেন, ‘আমরা গবেষণা করে দেখেছি, ১০০টি করে ফল যদি আমরা রাখি একেকটি পরিপক্ব ফলের আকার হবে ৬০ থেকে ৭৫ মিলিমিটার। সুপারশপগুলোতে যার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। আমাদের ওখানে ফল সংরক্ষিত আছে। আমি আপনাদের দেখাব। যদি ১৫০টি করে রাখি। তবে ফলের আকার ছোট হয়ে আসবে। এবং বাজারে এর দামটাও কমে যাবে।’ এর মাঝে একটি পিয়ার গাছ দেখলাম। যাতে প্রচুর ফুল এসেছে। কিন্তু ফলের অবয়ব নেই। বুঝলাম। এটা বোধহয় পুরুষ গাছ। রেনেও জানাল তাই, ‘পলিনেশন ট্রি।’ একটি বাগানে সাধারণত ১০% পলিনেশন ট্রি রাখতে হয়। বাতাসে এবং মৌমাছি মাধ্যমে প্রাকৃতিক উপায়ে পরাগায়ণ হয়।

তাদের বাগান ব্যবস্থাপনায় প্রকৃতির পাশাপাশি প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার রয়েছে। ফল উৎপাদন থেকে শুরু করে সংরক্ষণ অবধি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অব থিংসের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। বলা যায়, স্মার্ট ফলবাগান ব্যবস্থাপনা। পাইপ টেনে ড্রিপ ওয়াটার ইরিগেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রেনে জানালেন, সেচ ব্যবস্থাপনার পুরোটাই স্মার্টপ্রযুক্তির। হাতের মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করে দেখালেন কী করে ফোন দিয়েই তিনি সেচ চালু ও বন্ধ করতে পারেন। লক্ষ্য করলাম, ড্রিপ ওয়াটার ইরিগেশনের পাইপটি মাটি থেকে উঁচুতে রাখা। রেনে এর কারণ হিসেবে বললেন, এতে গাছের গোড়ার মাটির পরিচর্যা করা সহজ হয়। তারা মেশিন দিয়েই আগাছাগুলো পরিষ্কার করতে পারেন।

প্রতি হেক্টর জমিতে ৩ হাজার করে গাছ আছে। প্রতিটি গাছের বয়স ২৫-৩০ বছর। অথচ দেখে বোঝা যায় না। কোনো গাছের উচ্চতাই ৭ ফুটের ওপরে নয়। রেনে জানালেন, প্রতি বছরই ফল হার্ভেস্টের পর গাছগুলোকে ভালো করে প্রুনিং করা হয়। ভালো ফলনের জন্য প্রুনিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। একেকটা পিয়ার গাছ ফল দেয় ৫০ থেকে ৬০ বছর। আর আপেল গাছ ফল দেয় ১৫-২০ বছর। রেনে একটা পিয়ার গাছ দেখিয়ে বললেন, ‘এই গাছটার বয়স ২৫-৩০ বছর হবে। কিন্তু এই ডালটার বয়স ২ বছরের কম। প্রতি বছরই গাছগুলোকে আমরা ভালোভাবে প্রুনিং করি। নতুন শাখাতে যে ফল আসে তার গুণগতমান অবশ্যই পুরনো শাখার ফল থেকে ভিন্ন হয়। পুরনো ডালের ফলগুলো হয় দুর্বল আর নতুন ডালের ফলগুলো বেশ বলিষ্ঠ।’ জানতে চাইলাম, ‘আচ্ছা। আপনি তো বললেন এখানে ৩ হাজার গাছ আছে। প্রতিটি গাছ থেকে ১০০টি করে ফল সংগ্রহ করেন। তাহলে হেক্টর প্রতি কী পরিমাণ ফল উৎপাদন হয় বছরে?’

রেনে জানালেন, এটা একেবারেই হিসাব করা। প্রতি হেক্টরে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার কেজি ফল পাওয়া যায়। যদি আবহাওয়া বড় ধরনের কোনো সমস্যা না করে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন তারা। ঋতুগুলো ঠিক যেন আগের জায়গায় নেই। বসন্ত মনে হয় একটু আগেই চলে আসছে। ঋতু মেনে চাষাবাদে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদেরও। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমেই তারা সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে পারছেন। আপেল বাগানের প্রাকৃতিক শোভা অন্যরকম। গাছে গাছে ফুল আর কুঁড়ি। বাতাসে মৃদু ঘ্রাণ। এর ফাঁকেই যন্ত্রের উপস্থিতি। যন্ত্র মেপে নিচ্ছে প্রকৃতির সব উপাদান ঠিকঠাক আছে কি না। মাটির আর্দ্রতা মাপার একটি সেন্সর চোখে পড়ল। রেনে জানালেন যন্ত্রটি প্রতি মুহূর্তে মাটির অবস্থা সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছে। সেচের প্রয়োজন হলেই অ্যালার্ম দিচ্ছে।

এটি নিঃসেন্দেহে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাগান ব্যবস্থাপনার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাপমাত্রার কারণে আমাদের দেশে আপেল বা পিয়ার চাষ হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আম, কুল, মাল্টা, পেয়ারা কিংবা ড্রাগন ফলের বাগান ব্যবস্থাপনা কেমন হওয়া উচিত তার একটি ধারণা এখান থেকে নেওয়া যেতে পারে।

রেনের আপেল বাগানে দেখতে পেলাম নতুন এক যন্ত্রের। নেদারল্যান্ডসে বছরে গড়ে প্রায় ১০ বার শিলাবৃষ্টি হয়। শিলাবৃষ্টি ফলের মারাত্মক ক্ষতি করে। তাই শিলাবৃষ্টি ঠেকানোর জন্য তারা এই মেশিন ব্যবহার করছে। মেশিনটির নাম অ্যান্টি হেইল প্রোটেকশন মেশিন। বাগানজুড়ে এরকম মেশিন আছে ৯টি। রেনে জানালেন, শিলাবৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে খবরটি তারা আগেই জেনে যান। আর এই মেশিনের মাধ্যমে শিলাবৃষ্টিকে আকাশেই ভেঙে পানিতে রূপান্তর করে ফেলা যায়। এতে শিলার আঘাতে ফলের ক্ষতি হয় না। এমন একটি যন্ত্র কোনো কৃষকের পক্ষে হয়তো একা কেনা সম্ভব নয়। একটি মেশিনে ৫০ হেক্টর জমি শিলাবৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে পারে। তাই ৯ জন কৃষক মিলে তারা মেশিনগুলো বসিয়েছেন।

আপেল বাগানে চাষ করা হচ্ছে এলস্টার জাতের আপেল। প্রতিটি আপেল গাছেও ১০০টি করে আপেল রাখা হয়। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসেই তারা হার্ভেস্ট করে। চোখে পড়ল বিশেষ মৌমাছির বাকশো। এরা সাধারণত পরাগয়ণে সহায়তা করে। আমাদের দেশের মতোই মধুচাষি আছেন। যারা আপেল বা পিয়ারের মৌসুমে মৌমাছির বাকশো নিয়ে আসেন, মধু সংগ্রহ করেন। বিশাল বাগানটি প্রতিটি কাজই যন্ত্রনির্ভর। বলা ভালো প্রযুক্তিনির্ভর। এত বিশাল বাগান অথচ তেমন কর্মী চোখে পড়েনি। কারণ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে প্রযুক্তি। রেনে নিয়ে গেলেন বাগানটির পাওয়ার হাউসে। যেখান থেকে সেচের সঙ্গে পুষ্টিকণা মেশানো থেকে শুরু করে বাগানের সব প্রযুক্তি এখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এরপর নিয়ে গেলেন স্টোরেজ রুমে। সেখানে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সারা বছর ফল সংরক্ষণ করে রাখেন। সাধারণত ফলের মৌসুমে দাম বেশি পাওয়া যায় না। ফলে এক বছরের মতো তারা ফল প্রিজার্ভ করার ব্যবস্থা করেছে। মৌসুম ফোরালে বাজারে ফল কমে গেলে যখন দাম ভালো পাওয়া যায় তখন তারা প্রিজার্ভ থেকে ফল মার্কেটে ছাড়ে। এতে বেশি লাভ পাওয়া যায়। কোন ফল কোন তাপমাত্রায় থাকবে তার একটা হিসাব তারা করে নিয়েছে। নেদারল্যান্ডসের ভাগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেনোমিয়াতে ফলের শেলফ লাইফ বাড়ানো নিয়ে তাদের গবেষণাও এর আগে তুলে ধরেছিলাম। এ ব্যাপারে ডেলফি ভাগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা নেয়। প্রযুক্তিই সবকিছু সহজ করে দিয়েছে। বিশাল বাগান পরিচালনায় কাজগুলোর দায়িত্ব এখন মেশিন আর প্রযুক্তির। আর নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে গুণগতমানের ফল উৎপাদন। উন্নত বিশ্ব নানাভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত জটিলতাগুলো মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কৃষি উৎপাদনে নিশ্চিত করছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সফল ব্যবহার। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি খাদ্য তথা কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছাতে প্রয়োজন শতভাগ গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসের অনুসরণ। যা প্রযুক্তি নির্ভরতা ছাড়া সম্ভব নয়। আগামী দিনের টেকসই কৃষি অর্থনীতির জন্য এমন চর্চাগুলো অনুসরণ জরুরি। জরুরি কৃষি পরিকল্পনার জায়গাগুলো আরও মজবুত করার।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব  

[email protected]

সর্বশেষ খবর