শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কতিপয় বাবা ও বাস্তবতা

মাজহারুল ইসলাম

কতিপয় বাবা ও বাস্তবতা

ছোট্ট এক বালক পরিচিত হলো ‘কতিপয়’ শব্দের সঙ্গে। শব্দটি তার এতই ভালো লাগল যে, সে যথেচ্ছভাবে এর ব্যবহারও শুরু করল। একদিন শহরে চাকরিরত বাবাকে সে একপ্রস্থ চিঠি লিখল- ‘কতিপয় বাবা সমীপেষু, আমার কতিপয় সালাম নেবেন। খোদার রহমতে আমরা কতিপয় ভালো আছি।’ ইত্যাদি ইত্যাদি। গল্পটা মনে পড়ল রাজনীতিকদের একাংশের কান্ড দেখে। ছোট্ট সেই বালকের মতো তারা তত্ত্বাবধায়ক শব্দটির চর্চায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সর্বরোগের একমাত্র ধনন্তরী ওষুধ এ যুক্তিতে তা আদায়ে আন্দোলনে উৎসাহী হয়ে পড়েছেন। এমনকি লবিং করে বিদেশিদের ডেকে আনছেন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে। তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে কথা বললেও কেউই সরকারকে তত্ত্বাবধায়কের বড়ি গিলতে বলেননি। সরকার বুঝে শুনেই বিএনপি ও সমগোত্রীয়দের আন্দোলনকে পাত্তা দিচ্ছে না। তারা এগিয়ে যাচ্ছেন সাংবিধানিক নিয়মে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে। সরকার ও বিরোধী দলের দূরত্ব সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সমঝোতা ও সংলাপের বিকল্প নেই। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে যে রাজনীতি আমাদের দেশে বিদ্যমান সেখানে ‘সমঝোতা’ শব্দটি সত্যিকার অর্থেই নির্বাসিত। আমাদের দেশের রাজনীতিকরা সবাই আপসহীন তকমা কপালে সেঁটে চলতে পছন্দ করেন। যিনি যত আপসহীন তার দাম নাকি এ দেশের রাজনীতিতে তত বেশি। সমঝোতার পথে পা বাড়ানোকে তারা কবিরা গুনাহ মনে করেন। গণতন্ত্র এবং আপসহীনতার মধ্যে বৈপরীত্য থাকলেও তারা তা মানতে নারাজ। এ ভূখন্ডের গত ছয় দশকের অভিজ্ঞতা সংলাপের সুফল সম্পর্কে সন্দিহান হওয়ারই তত্ত্ব দেয়। সবারই জানা, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পাকিস্তানে গভীর রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়। এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। বৈঠকে মওলানা ভাসানী ও জুলফিকার আলী ভুট্টো যোগ না দেওয়ায় তা ফলপ্রসূ হয়নি। ফলে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয় বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানালে শুরু হয় সংকট। এ প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। স্বাধিকারের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানি প্রশাসন কার্যত অচল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সংলাপের ডাক দেন ইয়াহিয়া খান। রক্তপাত এড়াতে বঙ্গবন্ধু তাতে সাড়াও দেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার কয়েক দফা বৈঠকও হয়। এ বৈঠকের আড়ালে চলে সেনা অভিযানের প্রস্তুতি। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন বাংলাদেশেও সংলাপের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ। ১৯৮৫ সালে তিনি সংলাপের ডাক দেন। দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাতে অংশ না নেওয়ায় তা প্রহসনে পরিণত হয়। ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে। এ আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে সারা দেশ। সংকট নিরসনে সরকার ও বিরোধী দলকে সংলাপে বসানোর প্রাণান্তকর চেষ্টাও চলে। এক পর্যায়ে কমনওয়েলথ মহাসচিবের দূত হিসেবে স্যার নিনিয়ান স্টিফেন বাংলাদেশে আসেন। সরকার ও বিরোধী দলকে সংলাপে বসাতে দূতিয়ালি শুরু করেন তিনি। সরকারি দল রাজি হলেও সংলাপে অনীহা দেখায় বিরোধী দল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন হয়। সংসদের প্রায় সব আসনে জয়ী হয় বিএনপি। নির্বাচনের পর তুমুল আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করে সে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। ২০০৬ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলেও সংলাপের চেষ্টা চলে। বিএনপি মহাসচিব মরহুম আবদুল মান্নান ভূঁইয়া সে সংলাপে সরকারি দলের নেতৃত্ব দেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেন দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। এই দুই নেতার ব্যক্তিগত সদিচ্ছা সত্ত্বেও সংলাপ সফল হয়নি। পরিণতিতে ওয়ান-ইলেভেনের আবির্ভাব হয়। দুই প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার ওপর নেমে আসে কারা নির্যাতনের অভিশাপ। দুই শীর্ষ দলের নেতাদের অনেকেই নির্যাতনের শিকার হন। গণতান্ত্রিক রাজনীতি পরিচালিত হয় সমঝোতা ও সংলাপের ধারা অনুসরণ করে। যাদের চরিত্রে এ দুটির অভাব প্রকট তারা সংলাপে বসবেন এটা আশা করাও দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার- এ মনোভাব আর যাই হোক সংলাপের জন্য সহায়ক নয়। সরকার সংলাপের আগ্রহ দেখালেও সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে বিরোধী দল এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে দেশ আবার ২০১৪ সালের মতো বিএনপিহীন নির্বাচনের পথে হাঁটছে। তবে আগামী নির্বাচনে বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতা ভিন্ন পরিচয়ে অংশ নেবেন এমনটিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপির সাবেক এমপি মেজর আখতার (অব.) ভুল সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে এসে দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

                লেখক : প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর