রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কিছু নিবেদন আছে

মাকিদ হায়দার

কিছু নিবেদন আছে

চোখের পাতা দুটি বন্ধ করলেই পেছনের ফেলে আসা অনেক স্মৃতি মুহূর্তের ভিতরেই চোখের ওপর ভেসে ওঠে। স্পষ্ট দেখতে পাই সেই যে আমার হারানো দিন কাছে এসে বলে যায় আমি ফিরে এসেছি। শুধু এসেছি বলেই ক্ষান্ত হয় না, একে একে বর্ণনা করে যায় পেছনে সে কী কী ফেলে এসেছে তার দীর্ঘ পথচলার সময়। কে কখন ভালো বলেছিল, মন্দ বলেছিল কে, সবই মনের মাধুরী মিশিয়ে শুনিয়ে যায়। আমিও শ্রোতা হিসেবে শুনতে থাকি হারানো দিনের কথা। আমাদের পাবনা শহরের জিলাপাড়া মহল্লায় আমাদের পিতা দেশভাগের প্রায় ২৫-৩০ বছর আগে একটি দোতলা বাড়ি বানিয়েছিলেন। দোহারপাড়া গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার সুবিধার্থে ছেড়ে এসেছিলেন জিলাপাড়া মহল্লায়। বাড়ির দক্ষিণে পাবনা পলিটেকনিক স্কুলের ছাত্রদের জন্য ছাত্রাবাস এবং আরও দক্ষিণে ইংরেজ জেলা জজ সাহেবের প্রায় ৯-১০ একর জমির ওপর বিশাল হলুদ একটি বাড়ি। সেই বাড়িতে গোশালা এবং বাড়ির রক্ষীদের জন্য ছিল পৃথক ঘর। আইনকানুন ব্রিটিশের হাতেই ছিল। বাড়ির দক্ষিণে আরেকজন ধনী ব্যক্তির বাড়ি ছিল। বাড়িটি দোতলা। মালিক ছিলেন শচীন চৌধুরী। আমাদের পিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পুবের দিকে ছিলেন একজন মোক্তার কালীপদ সাহা এবং কয়েক ঘর ধোপার বাড়ি। সুবল ধোপার নাম আমার মনে আছে। বাড়ির পশ্চিমে পাবনা শহরের বড় মসজিদ। মসজিদের উত্তরে দুটি পুকুর। একটি পুকুরে মুসল্লিরা শুধু অজু করতে পারতেন। তার উত্তরে আরও একটি বিশাল পুকুর ছিল সর্বজনের জন্য উন্মুক্ত। জিলাপাড়ার সবাই ওই পুকুরে গোসল করতেন। একবার গোসল করতে গিয়ে প্রায় ডুবে মরতে বসেছিলাম। পুকুরের পশ্চিমে পাবনা জেলখানা। জেলখানার অনেক সেপাই গোসল করতেন। তাদেরই একজন আমাকে উদ্ধার করেছিলেন। আমি তখন ওই পুকুরের পুব দিকের নুরু মিয়ার প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস টু অথবা থ্রিতে পড়তাম। ওই প্রাইমারি স্কুলের দেয়ালসংলগ্ন এক তলা বাড়িটিতে কয়েকজন ভাই থাকতেন, তাদের যিনি অগ্রজ তিনি ছিলেন পাবনা জজ কোর্টের উকিল। উকিল সাহেবের এক মেয়ে ওই প্রাইমারি স্কুলে আমার সহপাঠিনী ছিলেন। নাম পুতুল। পুতুলের কাছ থেকে শুনেছিলাম ওর চাচা নাকি সিনেমা বানায় ঢাকায়। নাম মহিউদ্দিন আহমদ। আমাদের জিলাপাড়ার বজলুর স্যারের মেয়ে রত্তশন আরা ডেজীকে মহি চাচার সিনেমার নায়িকা বানিয়েছেন।

বজলুর রহমান স্যার ছিলেন ব্রিটিশের অধীনে সরকারি চাকুরে। অবসর নেওয়ার পর তিনি হয়েছিলেন আমাদের নুরু মিয়া পাঠশালার প্রধান শিক্ষক। মুসলমান এবং অনেক হিন্দু ছেলেই ছিল আমাদের সহপাঠী। ওই সহপাঠীদের একজন রাম। রামেরা থাকত শিল্প সঞ্জীবনী নামের একটি বিশাল গেঞ্জি কারখানায়। রাম একদিন জোর করেই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওদের বাড়িতে। খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। রামের মা আমাকে পাটালি আর নাড়ু-মুড়ি খেতে দিয়েছিলেন। খাওয়াদাওয়া শেষে যখন আমি আমাদের বাড়ির দিকে আসছিলাম ঠিক তখনই রামের মা আমাকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে কানের কাছে মুখ রেখে বলছেন, এ বাড়িতে রামের সঙ্গে আর কোনো দিন এসো না। রামের বাবা মেথর। তখন আমি ডোম, মেথর, মুচি বলে যে মানুষ আছে সেটা জানতাম না।

স্যার বজলুর রহমানের বড় মেয়ে মারা যাওয়ার পর স্যারের এক নাতি লেনিন, আমার সহপাঠী ছিল ওই প্রাইমারি স্কুলে। পরে লেনিন ও আমি পাবনা জিলা স্কুলে ক্লাস থ্রিতে ১৯৫৬ সালে ভর্তি হয়েছিলেম। চিত্রপরিচালক মহিউদ্দিন সাহেব কী সিনেমা বানিয়েছিলেন আমি সিনেমাটির নাম কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। পুরনো স্মৃতিও আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল না। ব্যর্থতা অতীতের এবং বর্তমানের। চিত্রনায়িকা রওশন আরা ডেজী পরে আর কোনো সিনেমায় অভিনয় করেননি। আমাকে জানিয়েছিল সহপাঠী লেনিন। ওই বন্ধুর সঙ্গে অনেক আগে একদিন স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে লেনিন জানাল তার ডেজী খাল্লামা ডাক্তার হয়েছেন।

ডেজী আপা ডাক্তার হয়েছেন শুনে ভালো লাগল। আমার যতদূর মনে পড়ে ১৯৫৮ সালে আমাদের বাড়ির বাগান থেকে সুপারি পাড়তে ২০-২৫ ফুট ওপর থেকে পড়ে গিয়ে পাবনা সদর হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল অনেক দিন। প্রায় নয়-দশ বছর পরে আমার ‘অ্যাপেনডিক্স’ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে থাকতে হয়েছিল অনেক দিন। তখন আমরা মালিবাগে ১৪/২ বাসায় ভাড়া থাকতাম। পাশের বাসায় থাকতেন ডাক্তার আজহারুল ইসলাম। তাকে আমরা দুলাভাই বলতাম। তিনি তখন ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক। তিনি তার ছাত্রদের দিয়ে সাকসেক্সফুলি অপারেশন করিয়েছিলেন।

আমার কৈশোরকালে পাবনা শহরে একজন মাত্র এমবি ডাক্তার ছিলেন। যিনি ইসহাক ডাক্তার নামে পরিচিত ছিলেন। শহরে তার ফি ছিল ৪ টাকা। শহরের বাইরে গেলে তিনি নিতেন ৮ টাকা। তবে ইসহাক ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনলে দাম কম রাখতেন বলে শুনেছিলাম। আমাদের জিলাপাড়ার বাড়িতে আমার ছোট ভাই খোকনের (দাউদ হায়দার) বয়স যখন তিন-চার, সে সময় পারনিসিয়াস ম্যালেরিয়া হয়েছিল। শহরের একমাত্র এমবি ডাক্তার জিলাপাড়ায় এলেন, যথারীতি ওষুধ দিলেন, ওষুধে খুব একটা কাজ না হওয়ায় পিতা-মাতা সবাই কান্না করছিলেন। তখন আমার দাদিমা পিতাকে ডেকে বললেন, হোমিওপ্যাথি ডাক্তার শিশির ভৌমিককে নিয়ে আয়। মায়ের কথামতো পিতা বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি শিশির ভৌমিককে নিয়ে এলেন। ডাক্তারবাবু বেশ কিছুক্ষণ খোকনকে দেখার পর মাতা আর পিতাকে বললেন, হাকিম ভাই (আমাদের পিতা শেখ মোহাম্মদ হাকিম উদ্দিন) ভগবানের নাম করুন। আর মাকে বললেন, কোরআন শরিফ পাঠ করতে এবং যাওয়ার সময় যথারীতি হোমিও ওষুধ দিলেন এবং শেষে বললেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আশা করি ভালো একটি ফল পাবেন, আর যদি না হয়... একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাক্তার বলে গেলেন এখন একমাত্র ভগবান সহায়।

হোমিও ডাক্তার শিশির ভৌমিক পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে শহরের বাড়ি স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে যাওয়ার আগের দিন আমাদের পিতা-মাতার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আমার এখনো মনে পড়ে শিশির কাকার চোখ ভিজে গিয়েছিল। তিনি খোকনের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ শেষে বলেছিলেন, বেঁচে থাকলে খোকন তুমি খুব বিখ্যাত মানুষ হবে। খোকন যে কারণেই হোক সে খুব বিখ্যাত। তবে খোকন ১৯৭৪ সালে কলকাতায় যাওয়ার পরে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারেনি। বিতর্কিত একটি মাত্র কবিতার জন্য খোকন আজ প্রায় ৪৯ বছর স্বদেশের মাটিতে আসতে পারেনি। বর্তমানে তার আবাস জার্মানি। তবে প্রতি দু-তিন বছর পর পর কলকাতায় এলে আমাদের সপরিবার যেতে হয় কলকাতায়। এমনকি মেজো কাকা শেখ হাবিবুর রহমানের ছেলে, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান রাজাও আমাদের সঙ্গে গিয়ে খোকনের সঙ্গে দেখা করে। দুজনই একই বছরে মাধ্যমিক পাস করেছিল এবং পাবনায় থাকাকালে ছোট কাকা কাশেমের বড় ছেলে বিশিষ্ট নাট্যকার হাসনাত মোশাররফ রতন, ওরা সবাই পাবনার গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশন থেকে লেখাপড়া শেষে ঢাকায় এসে ভর্তি হয়েছিল। খোকন সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে আর আনিসুর রহমান রাজা আজিমপুর হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেছিল। তখনকার দিনে পাবনা শহরে জনাকয়েক এলএমএফ ডাক্তার ছিলেন। আবুল হোসেন ও সীতামনী সাহা। সীতামনী সাহা মাথায় ইংরেজদের ক্যাপ ঝুলিয়ে সাইকেলে চেপে চলে যেতেন পাবনা শহরের পুব দিকের বিভিন্ন গ্রামে। মন্দিরপুর, শিবপুর, রাজাপুর ও আতাইকুলায়। ওইসব গ্রামের রোগীরা ডাক্তার সাহার পুরো ভিজিট দিতে না পারলেও পরে আম, জাম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন প্রকারের ফল প্রায় প্রতিদিনই দিয়ে যেতে দেখেছি। শহরের অন্যান্য এলএমএফ ডাক্তার যেতেন না কারণ এলএমএফ ডাক্তারকে দোগাছি হরিতলা নিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না।

১৯৫৮ সালে শহরের দোতলা বাড়ি মাত্র ৪০ টাকায় ভাড়া দিয়ে আমাদের দোহারপাড়ায় পিতা চলে এসেছিলেন। একবার আমার মেজো বোন সেলিনা হায়দার ঝর্ণার প্রচ- জ্বর হয়েছিল, পাবনা শহর থেকে ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়েছিলেন অগ্রজ দুলাল ভাইকে (রশীদ হায়দার)। কোনো এলএমএফই আসেননি, পিতা বাধ্য হয়ে আরিফপুর গ্রামের হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ওসমান গণির কাছে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। মাত্র ৮ আনার বিনিময়ে তিনি যে ওষুধ দিয়েছিলেন তাতে ঝর্ণা আপার জ্বর অনেকটা কমে গিয়েছিল। হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ওসমান গণি আমাকে বলেছিলেন তিন দিন পরে এসে আরও এক শিশি নিয়ে যাস, আমি মাকে বলার পর মা তিন দিন পরে হাতে ওষুধের শিশি দিয়ে পিতাকে বললেন ৮ আনা পয়সা দিতে, ডাক্তারকে দিতে হবে। পিতা বললেন, টাকা ভাঙতি নাই এবং আমাকে বললেন ওসমানকে বলিস পরে দিয়ে দেব। আমি শিশি হাতে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াতেই দেখি আমার ফুটবল খেলোয়াড় সাথি কাইউম দাঁড়িয়ে আছে। কাইউম আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল, আজ হবিহার মাঠে দোহারপাড়া ও আরিফপুরের ফাইনাল ফুটবল খেলা, আমি ওসমান গণি ডাক্তারের কাছে না গিয়ে বাড়ির সামনের পানির কল থেকে ওষুধের শিশিটা গলা পর্যন্ত ভরে কাচারিঘরের ভিতরে আমি আর কাইউম কিছুটা সময় কাটিয়ে দিয়ে মায়ের হাতে ওষুধের শিশিটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম আগের নিয়মেই খাওয়াতে বলেছেন ডাক্তার। সেই পানি খেয়েই ঝর্ণাপা ভালো হয়ে গেলেন।

মানুষের আত্মবিশ্বাসই একমাত্র আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। গত বছর আমার নিজের বড় বড় তিনটি অপারেশন করলেন প্রখ্যাত শল্য চিকিৎসক ডাক্তার জালালুল ইসলাম ভূইয়া মুকুল। অনেক উচ্চতর ডিগ্রি তিনি পেয়েছেন বিদেশ থেকে। প্রফেসর ভূইয়ার স্ত্রীও ডাক্তার, তার চেয়ে তার বড় পরিচয় তিনি একজন সুবিখ্যাত লেখক। শাহিনা সোবহান মিতু। জামালপুর শহরের বকুলতলায় নিবাস। তারই আহ্বানে আমি সদ্যপ্রয়াত কবি মোহাম্মদ রফিক, অনুজ জাহিদ হায়দার স্বপনসহ জনাকয়েক ঢাকা থেকে ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে গিয়েছিলাম জামালপুর। স্টেশনে গিয়ে দেখলাম অনেক তরুণ-তরুণী আমাদের অভ্যর্থনাসহকারে নিয়ে গেলেন। পিতা বিখ্যাত অ্যাডভোকেট সৈয়দ আবদুস সোবহানের বাড়িতে। মিতু খুব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে আমাদের শুনিয়েছিলেন দুই সন্ধ্যায়। মিতু পরে ডাক্তার হয়েছেন। হয়েছেন প্রফেসর। ডাক্তার জালালুল ইসলাম ভূঁইয়া মুকুলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কয়েক বছর আগে। পরে স্বপন জানিয়েছিলেন মিতুর স্বামীর নাম। যাই হোক, গত বছরের তিনটি অপারেশন বাবদ তিনি কোনো প্রকার সম্মানি নেননি। হাসপাতালের রুম ভাড়া এবং অন্যান্য ডাক্তার সম্মানি নিলেও তিনি কেন নিলেন না? মুকুল ভাই হেসে জানালেন, আপনার কাছ থেকে নিই না। বিশেষত গরিব নিম্নবিত্ত আর নিই না কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের কাছ থেকে। জীবনে এই প্রথম শুনলাম, কিন্তু ডাক্তারদের সম্পর্কে অনেকেই অনেক সময় বিরূপ মন্তব্য করেন। ডাক্তার বিদ্যাটি ভীষণ কঠিন বলেই আমার মনে হয়।

আমাদের মহল্লায় একজন ডাক্তার দম্পতি আছেন। প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ১২টা-১টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। সময় দেন মাত্র ৩ থেকে ৪ মিনিট। পারিশ্রমিক পুরোটাই নেন। কোনো গরিব, নিম্নবিত্ত পারতপক্ষে তার চেম্বারে যান না। তাই ওই ধরনের চিকিৎসকের কাছে আমার কিছু নিবেদন আছে। টাকা নেন ক্ষতি নেই, তবে উপভোগ করতে পারেন কি না আমার জানা নেই।

                লেখক : কবি

সর্বশেষ খবর