শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

গরিবেরা রেমিট্যান্স আনে, ধনীরা পাচার করে

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

গরিবেরা রেমিট্যান্স আনে, ধনীরা পাচার করে

সেই চাণক্য প্লেটো অ্যারিস্টটলের যুগ থেকেই বণ্টনবৈষম্য ঘটিয়ে গরিবদের মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্য আত্মসাৎ করে ধনীরা আরও ধনী হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় প্রথমেই উল্লেখ রয়েছে, ‘জনগণের’ কথা, যারা সবাই মিলে দেশ স্বাধীন করেছে, সেই আমজনতার রাজনৈতিক অর্থনীতিতে এই প্রবণতার প্রবল উপস্থিতি লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠছে।  প্রিন্ট মিডিয়ায় গত সপ্তাহে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা বেশ বেড়েই চলেছে।

আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ইবলিশ শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেছিলেন। প্রভু নিরঞ্জনের নির্দেশ উপদেশ উপেক্ষা করে সম্পাদিত সেই ভুলের খেশারত হিসেবে স্বর্গ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল প্রথম মানব-মানবীকে। অনেকেরই ধারণা এমনতর অসতর্ক না হলে, সিদ্ধান্ত নিতে ভুল না করলে, এমন নির্দেশ অমান্যের ঘটনা না ঘটলে আজ সবাই স্বর্গে স্থায়ীভাবে বিনা দলাদলিতে বিনা সংকট সন্ত্রাসে বাস করা যেত। যা হোক আদি মানবের করা প্রথম নির্দেশ অমান্যের ঘটনা থেকে এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে যত অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, অন্তর্ঘাত, অপশাসন, আইনের বরখেলাপ, চোরাগোপ্তা হামলা, ডাকাতি, পুকুর এবং সাগর চুরি, প্রবঞ্চনা-প্রতারণা, কৃত্রিম ডলার সংকট, দুর্নীতি দুঃশাসন, স্বৈরাচার সব কিছুর সালতামামি ও শুমার করলে তার সারমর্ম দাঁড়ায়- রিলে রেসে অনেকেরই পারফরম্যান্স ভালো না, অনেকেই যথাসময়ে পরবর্তীজনের কাছে ক্ষমতা বা মশাল হস্তান্তর করার উপযুক্ত শিক্ষা পাননি বা নেননি। আজ যারা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন, ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা বা পথপন্থা শুরু করেন তাতে কখনো-সখনো মনেও হয় সবকিছুতে এমন সুরক্ষা লাভ ঘটবে যে, তাতে শনৈ শনৈ গতিতে উন্নতির পথে সবাই যাবে বা থাকবে। কিন্তু এ রকম প্রবোধ, প্রত্যয় অতীতে অনেক ঘটনার পরপরই নেওয়া হয়েছে- কিন্তু বিপর্যয় ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটা থেমে থাকেনি। অতীতে অর্জিত তিক্ত অভিজ্ঞতা, সে সময় নেওয়া প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা পারতপক্ষে তেমনভাবে থামিয়ে দিতে পারেনি ভাবী কালের অঘটন ঘটন সংঘটনকে।

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, অতি সনাতন কথা। আর ভারতে ব্রিটিশ সরকার সবাইকে শিখিয়ে গেছে, ‘চোর তো চুরি করবেই গৃহস্থকে সজাগ থাকতে হবে’, সর্বত্র’ সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ার’ ফন্দিফিকির চলছেই। সেই চাণক্যের আমল থেকে বলা হচ্ছে, ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা সহজ’। এমনতরো নীতিকথা খনার বচনে ঠাঁই পাওয়ার পরিবেশ পরিস্থিতি যেন তৈরি হয়েই চলেছে। মানুষের অভিজ্ঞতার ঝুড়ি বড় হয়, চুল পাকে যে প্রকারে ও গতিতে, চোর ডাকাত আর দুষ্কর্মী দুর্নীতিবাজের হাত পাকে তার চাইতে বেশি মাত্রায় ও গতিতে, সে কারণেও রিলে রেসে সবাই নিজের মশাল পরের জনকে দিয়ে যেতে চায় না। কিংবা এমন পর্যায়ে এমনভাবে দেয়, তা দিয়ে পরের জনের দৌড় শেষ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। ফলে দেশিক সাফল্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অন্যেরা সাফল্য কেড়ে নেয়, ট্রফি জেতে। শয়তানি বা দুষ্টবুদ্ধির বিনিয়োগ বেশ প্রখর, লক্ষ্যভেদি ও সুতীক্ষè, পক্ষান্তরে তাকে মোকাবিলা করা ওরফে মাড়িয়ে বা এড়িয়ে চলার প্রয়াস প্রচেষ্টা কেন জানি তত জোরালো নয়, মনে হয় যেন তারা হালে পানি পায় না। পরস্পরের দোষারোপে অধিকাংশ সময় পার হয় এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ঠেকে শেখার উপাদান শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়- একটু অন্য কায়দায় কিছু একটা আবার ঘটলে তখন সবাই আবার যুক্তির বাড়ি দৌড়ায়, যৌক্তিকতা খোঁজার কাজে লেগে যায় এবং এক সময় আবার ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

সেই রাখাল বালকের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। বাঘ এলো বাঘ এলো বলে গ্রামবাসীকে বারবার সচকিত সক্রিয় করতে করতে একসময় এ ধরনের তথাকথিত সতর্ককরণের প্রয়াসকে মূল্যহীন ভাববার অবকাশ তৈরি হয়ে যায়। শেষে সত্যি সত্যি যেদিন বাঘ আসে সেদিন আর তার ডাকে কেউ সাড়া দেয় না। ঠেকে শেখার বেলায় তাই ঘটে। ঠেকে না শিখতে শিখতে তা এক সময় অগৌণ হয়ে পড়ে এবং চূড়ান্ত মোকাবিলার সময় দেখা যায় এ ওর দিকে অঙ্গুলি হেলন ছাড়া কেউ আর কোনো প্রকৃত প্রতিরোধ গড়তে পারছে না, গড়ছে না।

আসলে বারবার দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর ফলে চোখ এমন ট্যারা হয়ে যায় যে, কোথায় দৃষ্টিক্ষেপ হচ্ছে তা বোঝার বিষয়টিও গোলমেলে হয়ে যায়। তখন বড় জোর এটা করলে ভালো হতো ওটা করলে ভালো হতো টাইপের চর্বিত চর্বণ উচ্চারণেই সব কিছু মিলিয়ে ও থিতিয়ে যায়। আসল বাদ দিয়ে নকলের দিকে চলে যায় চোখ, চোখে ধোঁকা দিয়ে ব্যস্ত রাখা হয় অন্যত্র-ফলে নকলের, অনিয়মের, অশিক্ষার, কুশিক্ষার বাড়ে সুযোগ। তারা বেশ বলশালী হয়।

বাংলাদেশের আমজনতা এমন এক সময় ও পরিবেশে বাস করে সেখানে অতি সতর্কতার নামে সময় ব্যয় হয় যত্রতত্র এবং আসল দুরবস্থা থেকে দৃষ্টি চলে যায় অনেক দূরে বহুদূরে। সেখানে সকালে সবাই সুকান্তর মতো ‘শিশুর নিরাপদ বাসযোগ্য বিশ্ব রচনায় মনোনিবেশের মন্ত্রযপে, তাদের সময় কাটে ‘সকল জঞ্জাল সরানোর’ প্রত্যয় ও প্রগলভতায়। কিন্তু কিছুই না করে বা করতে না পেরে বিকালে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নিয়ে সবাই বলে ‘আমার হাতে তো ছিল না পৃথিবীর ভার’।

অন্যের ওপর সব দায়-দায়িত্ব চাপানোর চৌকশ চতুর লোকের সংখ্যা বাড়ছে সমাজে। আসলে দশখান অব্যবস্থাপনার মধ্যে সবাইকে ব্যস্ত রেখে ইচ্ছায় অনিচ্ছার আড়ালে কারও কারও আসল কাজ উদ্ধারের পথ করা হয় নিরাপদ। সফলতা সবখানে-উপেক্ষায় এবং উপেক্ষার আড়ালে, উপলব্ধির খতিয়ান ও পর্চায় কাটাকাটির ঘটনা তাই বারবার ঘটে।

নানাবিধ অপউন্নতির অবয়বে সমাজে ভাঙাগড়ার পটপরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত- সেখানে ন্যায়নীতি নির্ভরতার সুশাসন বোধ বুদ্ধিও দ্রুত ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন অপকর্মের উন্নতিতে। সামাজিক মূল্যবোধ পরিবার ও সংসার ভেঙে যাচ্ছে, যা কোনো দিন ভাবা হয়নি বা যায়নি তা ঘটছে এখন সমাজ জীবনে। গ্রেশামের থিওরির মত, শহর ও গ্রাম থেকেও সুবচন, ধৈর্যশীলতা, শোভনীয়তা নির্বাসিত-অপসারিত অপমানিত হচ্ছে, সেখানে অকর্মণ্য অপদার্থদের সরব উপস্থিতি বাড়ছে। এমন ধারণাও প্রচার চলে আমজনতা সুশাসন বোঝে না, তারা দেখতে চায় উন্নয়ন। দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়ে আমজনতাকে মাথা ঘামাতে না করা হয় বলা হয় সরকারই এসব শোধ করবে। যুবসমাজের মধ্যে যে অস্থিরতা বাড়ছে-তাতে মনে হচ্ছে শিক্ষায়তনে গুণগতমান সম্পন্ন, চক্ষুষ্মান হওয়ার মতো পড়াশোনার যথাযথ চাপ বা তাগিদ নেই, পরীক্ষা দিলে পাস হয়ে যাওয়ার প্রথা পরিব্যপ্ত হওয়ার ফলে, গাইডবই পাঠ্যবই হচ্ছে, কোচিং বাণিজ্য বাড়ছে, বাড়ছে মাদকাসক্তি, মুঠোফোনে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সৌজন্যে এমকি দূরদর্শনেও দেশি-বিদেশি অবৈধ সংস্কৃতির অবাধ যাতায়াত বাড়ছে। কাউকে মর্মান্তিক আক্রমণ করার ছবি তোলার লোক পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু ওই আক্রমণ ঠেকানোর জন্য বা আক্রান্তকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে যাওয়ার জন্য যেন কেউ নেই। এ পরিস্থিতিতে অভিভাবক ও সমাজ চিন্তকদের দুশ্চিন্তা বেড়েই চলছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে প্রজন্ম উদ্যোগ নিয়ে দেশকে শিল্পায়িত করেছে, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম শিল্পায়নের রিলে রেসে অংশ নিতে চাচ্ছে না, দেশের নতুন উদ্যোক্তা ও মেধা দেদার পাচার হচ্ছে। শিক্ষক সমাজে আদর্শ স্থানীয়দের অপসৃয়মাণ অবস্থানে অবস্থা আরও সঙ্গিন হয়ে উঠছে। উপযুক্ত শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ ও মানসিকতা না বাড়ার কারণ শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিতকরণের দিকে যথানজর না থাকাই কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেশে শিক্ষিতদের চাকরি বাজার বাইরের লোক এসে দখল করছে, রেমিট্যান্স নিয়ে যাচ্ছে। গুণগতমান সম্পন্ন কার্যকর ও উপযুক্ত শিক্ষার জন্য অপেক্ষার পালা শেষ হোক, কেননা এহেন ক্ষতির পাল্লা যদি এমনই ভারী হয়ে যায় ভবিষ্যতে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করারও থাকবে না কিছুই। বারবার নতুন অবয়বে দুর্ঘটনা ঘটছে। আজকাল অনেকেই কেন জানি নাটকীয়তা পছন্দ করেন। তৃপ্তি পান একের পর এক ঘটনা ঘটুক এটা যেন চান কেউ কেউ। দুর্ঘটনার পেছনে সবাই দৌড়ায়, কেন দুর্ঘটনা ঘটছে তার ‘কজ’ এবং ‘ইফেক্ট’ এর মূল্যায়ন ও তদারকি হচ্ছে না। দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ এবং এর উৎসমূলে যাওয়া হয় না, কারণ প্রতিকার, প্রতিরোধ, প্রতিষোধনে, তদন্ত প্রতিবেদনে চোখ দেওয়ারই যেন সময় নেই। দুর্ঘটনার পরবর্তী বিষয় নিয়ে পরস্পর দোষারোপে মেতে ওঠা হয়। প্রচার প্রগলভতায় ভোগা হয় কিছু একটা করা হচ্ছে দেখে। দুর্ঘটনার উৎসমুখ বন্ধ করার উদ্যোগ তেমন একটা দেখা যায় না। এ যেন দুর্নীতি হওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজ যেমন শুরু হয়। সমাজে কেন দুর্নীতি হয়- দুর্নীতির উৎস কী, তার প্রতিরোধে প্রতিষেধকে না গিয়ে শুধু প্রতিকার নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়, এমন এক সময় যখন ক্ষতি বা দুর্নীতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। যে দেশ বা সমাজে গরিবেরাই রেমিট্যান্স আনে আর ধনীরা তা বিদেশে পাচার করে, সেখানকার আমজনতাকে উন্নতি-উন্নয়নের চমক দেখিয়ে, আয়বৈষম্য বাড়িয়ে, উসকে দিয়ে সবার আর্থ-সামাজিক স্বার্থ-সৌভাগ্যের ক্রমবিপর্যয় ঘটানোর অপপ্রয়াস অপচেষ্টার ধরন দেখে সেই প্রাচীন প্রবাদের কথাটিই মনে পড়ে যায়- বোকারা রাঁধে-বাড়ে আর চালাকেরা তা খায়।

                লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর