বিজিএমইএর সাবেক ভবনের পাশে হাতিরঝিলের কিয়দংশ (এখনো বোঝা যাচ্ছে না সম্পূর্ণ কি না) বালি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। হাতিরঝিলের অকাল মৃত্যু ঘটিয়ে সীমা যদি সোনারগাঁও হোটেল থেকে মহাখালী সড়ক মধ্যস্থিত অংশ হাওয়া করার মতলব থেকেই থাকে তাহলে বিজিএমইএর ভবন ভাঙার প্রশ্নটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। অতবড় একটি বিশাল অবকাঠামো নির্মাণ, ভাঙার এবং বিজিএমইএকে অন্যত্র সরানোর যে আর্থিক সংশ্লেষ তা একটি বড় ধরনের অপচয় অপব্যয় কি না এ বিষয়টি উঠে আসছে প্রকারান্তরে। হাতিরঝিলের গা ঘেঁষে দেখা যাচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের নির্মাণযজ্ঞ চলছে, তাতে হাতিরঝিলের নান্দনিক ও পরিবেশগত সৌকর্য কীভাবে রক্ষিত হবে তা পরিবেশবাদীদের ক্ষীণ উদ্বেগ প্রকাশের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। এখনো জানা যাচ্ছে না হাতিরঝিলের ওপর দিয়ে চলমান সার্কুলার রোড খোঁড়াখুঁড়ির কাজ কবে শেষ হবে।
অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও সুচারুরূপে নির্মিত সার্কুলার রোড মোটা দাগে খোঁড়াখুঁড়ি এবং মন্থরগতিতে ভরাটের দ্বারা পূর্বের অবস্থায় আনার উদ্যোগে অমনোযোগিতা দুঃখজনক নয় শুধু, পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিতে আপত্তিকরও বটে। হাতিরঝিলের পাড়ে লাগানো গাছ এবং সৌন্দর্যবর্ধন প্লান্টগুলো ইতোমধ্যে অযত্নের শিকার হয়ে পড়ছে। গাছ কাটা পড়ছে, ঝড়ে উপড়াচ্ছে। একটি কেআইপি এলাকা বলে ঘোষিত হাতিরঝিলের দেখভালের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার দায়িত্বশীলতায় দুর্বলতা ও গাফিলতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। লেকের পানিতে কচুরিপানার উপস্থিতি বাড়ছে। দুই পাড়ে পলিথিন ও অন্যান্য আবর্জনা জমতে শুরু করেছে। দুঃখজনক এবং আশঙ্কা এই যে, টলটলে পানির এ লেকটি অমনোযোগিতায় পুনরায় বদ্ধ পানি ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত না হয়। প্রকল্প দলিলে ছিল লেকের ভিতর একটি অভয়ারণ্য দ্বীপ তৈরি হবে। সেখানে কারও যাওয়া-আসার সুযোগ থাকবে না। উদ্বোধনের অনেক পরে দ্বীপে গাছ লাগানো শুরু হয়েছে বটে তবে সেখানে যাওয়ার জন্য শোভন সুন্দর পথ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বিদ্যুতের ঘর নির্মাণ উঁকি দিচ্ছে, যা অভয়ারণ্য তৈরির দর্শন পরিপন্থী।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2023/10.%20October/13-10-2023/BD-Pratidin_2023-10-13-09.jpg)
মনে পড়ছে ২০০৬ এর ফেব্রুয়ারিতে আমি প্ল্যানিং কমিশনে সদস্য, ভৌত অবকাঠামো হিসেবে যোগ দেওয়ার এক মাসের মাথায় একটা প্রকল্প এলো- হাতিরঝিল প্রকল্প। সেখানে বলা হলো, রামপুরা থেকে সোনারগাঁও হোটেলের লিংক রোড পর্যন্ত একটা বড় ফ্লাইওভার হবে। সোনারগাঁও হোটেলের ওখান থেকে ফ্লাইওভারে উঠে সবাই সহজে সরাসরি রামপুরা যাতায়াত করতে পারবে, এতে মগবাজারসহ তৎসংলগ্ন এলাকায় ট্রাফিক জ্যাম কমবে ইত্যাদি। এ পরিকল্পনা নিয়ে অনেকদিন ধরে কাজ করছে কয়েকটি সংস্থা। পরিকল্পনা কমিশন থেকে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে প্রশ্ন রাখলাম যে, ঝিলের ওপর দিয়ে ফ্লাইওভার হলে তার নিচে ঝিলের পচা গলা পানির কী হবে, তারা বলল সেটা ওভাবে থাকবে। অর্থাৎ ওপর দিয়ে যখনই ফ্লাইওভার বানাব তখন নিচের পানি নষ্ট হয়ে গেল না কি হলো ওর প্রতি কারও কোনো নজর থাকবে না। ফলে মরে যাবে ঝিল। অন্য অনেক খালের পোস্টমর্টেম রিপোর্টে যেমন পাওয়া গেছে ময়লা আবর্জনায় ভরাট হওয়া জলাধারে প্রথমে সেখানে বাঁধাকপির চাষ হতে থাকবে তারপর একসময় উঠতে থাকবে দালানকোঠা, ঠিক যেমনটি হয়েছে মতিঝিলের ঝিল, ধোলাইখাল, বেগুনবাড়ীর খাল। ধানমন্ডি লেকের সঙ্গে হাতিরঝিলের এক সময়কার সংযোগ, হাতিরপুলের খাল, ধোলাইখাল এমনি আরও কত পানির আধার হারিয়ে গেছে। তৎকালীন যিনি উপদেষ্টা ছিলেন যিনি পূর্ত মন্ত্রণালয় বা ভৌত অবকাঠামো এসব বিষয় দেখতেন, মরহুম আনোয়ারুল ইকবাল, তিনিসহ আমরা বেশ জোর দিয়ে বললাম, না তা হবে না, পরিবেশবাদীদের কথা আমাদের ঢাকা শহরের পানির আধারগুলো উদ্ধার করতে হবে। একসময় হাতিরঝিল ধানমন্ডির লেকের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এটা গুলশান, বনানী, বেগুনবাড়ী হয়ে ওই পাড়ে বালু নদীতে পড়েছে, এভাবে মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে খাল ছিল। আশির দশকে সরকার বিদেশি সাহায্য নিয়ে স্টর্ম ওয়াটার প্রজেক্ট বানিয়ে ধানমন্ডির সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পান্থপথের ওপর দিয়ে যে রাস্তা বানিয়েছে, হাতিরঝিলের পাশের হাতিরপুলের খালও বন্ধ হয়ে গেল। দয়াগঞ্জ-ধোলাইখালের ওপর দিয়ে রাস্তা হয়ে গেল। ছোট নদী এবং খালগুলোর ওপর দিয়ে প্রচুর রাস্তা বানানো হলো, অর্থাৎ শহরের জলাধারগুলোকে শেষ করে দেওয়া হলো। একটা শহরে যতটা পরিমাণ পানির আধার থাকতে হয় ঢাকা শহরে সে ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। প্ল্যানিং কমিশন থেকে হাতিরঝিলের ব্যাপারে আমরা বললাম, এ পানির আধার ধরে রাখতে হবে, একে গভীরতর করতে সেখানে প্রয়োজন হলে আরও খনন কর। এখানে মগবাজারসহ অন্য এলাকা থেকে যত ড্রেন আছে সেগুলো বন্ধ করে পুরো একটা পরিষ্কার পানির লেক গড়ে উঠুক। সেই মাটি দ্বারা চারদিক দিয়ে সার্কুলার রোড বানিয়ে দিন, ওয়াকওয়ে ও গাছের বেষ্টনী বানিয়ে দিন, তাহলে মানুষ এখানে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারব, পানিটাও ভালো থাকবে, টলটলে পানির লেকে হালকা নৌযানে মানুষ যাতায়াত করতে পারবে। লেক থাকবে এবং আস্তে আস্তে এটি গুলশান ১ ও ২ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হবে। মাত্র ২০-২৫ দিনে বুয়েটের ইঞ্জিনিয়াররা আমাদের ভাবনামতো সুন্দর ডিজাইন নিয়ে এলেন। তাদের সৃজনশীলতা ও নিষ্ঠাকে এখনো সানন্দে অভিবাদন জানাই। লেকের অধিকাংশ জমি ভাওয়াল রাজার কোর্ট অব এওয়ার্ডি, এর সব পাড়ের জমির মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে মাত্র তিন মাসের মাথায় হাতিরঝিল প্রকল্প একনেকে পাস হয়। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে, নিরপেক্ষ সরকারের সময়েই প্রকল্পের ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল। পরিকল্পনামতো কিছু কাজ তখন বাকি থাকলেও ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি এটি উদ্বোধন করা হয়। এখন সবাই এটির সুফল উপভোগ করছে। ওখানে কিন্তু পরিকল্পনা নেওয়া আছে, এটি গুলশান ১, ২ এবং গুদারাঘাট পর্যন্ত যাবে, গুলশান থেকে মানুষ নৌপথে মগবাজারে এসে নামবে। এতে ওপরের রাস্তার ট্রাফিক অনেকটা কমে যাবে। আরেকটা হচ্ছে রামপুরা, মগবাজার যাওয়ার বহুমুখী পথ সৃষ্টি হবে, সে সুযোগ আমরা এখনই লক্ষ্য করছি, দেখতে পাচ্ছি কী সুন্দর হয়েছে। তার ভিতরে আরেকটা পরিকল্পনা ছিল, ওখানে নিবিড় অথচ আলাদা একটা অভয়ারণ্য তৈরি হবে। ঢাকা শহরের পাখিগুলো নীরবে ও নিরিবিলিতে থাকতে পারবে। সেই বনটাও শুরু করা হয়েছে। সেখানে গাছ লাগানো হয়েছে। তবে মূল পরিকল্পনায় আছে এ অভয়ারণ্যে যাওয়ার জন্য কোনো সড়কপথ থাকবে না। এখন দেখা যায় বেশ বড় রাস্তা করা হয়েছে। ঝিলপাড়ে খাবারের দোকান খোলা হয়েছে, গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য বিশাল ভবন নির্মাণ করা হলেও ইতবিক্ষিপ্ত গাড়ি পার্কিং চলে। দেরিতে নয়নাভিরাম থিয়েটার গ্যালারি নির্মিত হলেও তা চালু করতে কী কারণে বিলম্ব হচ্ছে তা বোঝা যায় না। ইদানীং দক্ষিণ পাশের রাস্তার একাংশ কেটে সংযোগ লাইন তৈরি করা হচ্ছে। কেপিআই প্রকল্প এলাকায় সৌন্দর্য ও পরিবেশ বিনষ্টকারী এ ধরনের কার্যকলাপ হয়তোবা স্বার্থান্ধ মহলের ইশারায় হাতে নেওয়া হয়েছে কি না জানার উপায় নেই। নানান সূত্র থেকে জানা মতে, হাতিরঝিলে ৪০টি পিলার বসিয়ে ঝিলের ওপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হবে। এ ব্যাপারে মাঝেমধ্যে সামান্য উদ্বেগ প্রকাশ পাচ্ছে।
শুধু দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতার কারণে যদি সে সময় ঝিলের ওপর দিয়ে একটা ফ্লাইওভার করে দেওয়া হতো, একটা ফ্লাইওভার হয়তো হতো, কিন্তু এখন চারদিকে যে নান্দনিক পরিবেশ এগুলো হতো না। প্রসঙ্গত, হাতিরঝিল প্রকল্প যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (এডরা) ‘পরিসর পরিকল্পনা’ ক্যাটাগরিতে ‘গ্রেট প্লেস অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ লাভ করে।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এবং প্ল্যানিং কমিশনের সাবেক সদস্য