শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সততার অনন্য উপমা যিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

আবদুল্লাহ আল মামুন আশরাফী

সততার অনন্য উপমা যিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

সততা। মানবীয় গুণাবলির অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি দিক। পবিত্র কোরআন মাজিদে অনন্য এ গুণটি নিজের মাঝে পরম মমতায় ধারণ করতে মুমিনদের বিশেষভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো (সুরা তাওবা-১১৯)।

আয়াতের বার্তা পরিষ্কার। কোরআন মাজিদ মুসলিম সমাজকে আহ্বান করছে সততার মতো এই সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি, সৎ ব্যক্তিদের সঙ্গী হওয়ার প্রতি। কেননা, সততাই হলো সব কল্যাণের চাবিকাঠি।

সততার মতো এই মহান গুণের ক্ষেত্রে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন উত্তম দৃষ্টান্ত ও আদর্শ। সততার সর্বোচ্চ চূড়ায় ছিল তাঁর অবস্থান। নবুওয়াত প্রাপ্তিরও বহু আগে মক্কার কুরাইশদের পক্ষ থেকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আস-সাদিক (সত্যবাদী) এবং আল-আমিন (আমানতদার) উপাধি প্রদান করা হয়েছিল। এই বিশ্বস্ততার বিমল গুণে মুগ্ধ কুরাইশরা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তাদের মূল্যবান সম্পদ গচ্ছিত রাখত। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইসলামের দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন তখন তাঁর আত্মীয়স্বজন ও তাঁর বংশের লোকেরা শত্রুতা, বিদ্বেষ, ঘৃণা ও বিরোধিতা শুরু করে। এমন ভয়াল প্রতিকূল মুহূর্তেও তিনি সততা ও আমানতদারির প্রকাশ ঘটিয়ে তাদের গচ্ছিত সম্পদ যথাযথভাবে তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে যান। আল্লাহতায়ালা যখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের নিকটাত্মীয়দের আখিরাতের প্রতি সতর্ক করার নির্দেশনা প্রদান করেন, তখন তিনি সাফা পর্বতে আরোহণ করে সবাইকে ডেকে বলেন,

‘বলো তো, আমি যদি তোমাদের বলি, অশ্বারোহী শত্রুসৈন্য উপত্যকায় এসে পড়েছে, তারা তোমাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে উদ্যত, তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে? তারা বলল, হ্যাঁ, আমরা সর্বদা তোমাকে কথা ও কাজে সত্যবাদী পেয়েছি (সহিহ বোখারি)।

এভাবে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সততার ঘোষণা দিয়েছে। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে তা লিপিবদ্ধ। হাজার বছর ধরে মানবসভ্যতা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সততার সৌরভে সুরভিত। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সততার ব্যাপারে সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক স্বয়ং আল্লাহতায়ালা সাক্ষ্য রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি সত্য কথা নিয়ে এসেছে এবং নিজেও তা বিশ্বাস করে এরূপ লোকই মুত্তাকি (জুমার-৩৩)। ইমাম ইবনে আশুর (রহ.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, যিনি সত্য নিয়ে এসেছেন তিনি হলেন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর সত্য হলো মহাগ্রন্থ আল কোরআন (আত তাহরির ওয়াত তানবির ২৪/৮৬)। সততার অনন্য উপমা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা কথা ও কাজে অন্যদেরও সত্য ও সততার প্রতি উৎসাহিত করতেন। তিনি বলেন- আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত :

তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা মিথ্যাচার বর্জন করো। কেননা মিথ্যা পাপাচারের দিকে ধাবিত করে এবং পাপাচার জাহান্নামে নিয়ে যায়। কোনো ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা বলতে থাকলে এবং মিথ্যচারকে স্বভাবে পরিণত করলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট তার নাম মিথ্যুক হিসেবেই লেখা হয়। আর তোমরা অবশ্যই সততা অবলম্বন করবে। কেননা সততা নেক কাজের দিকে পথ দেখায় এবং নেক কাজ জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। আর কোনো ব্যক্তি সর্বদা সততা বজায় রাখলে এবং সততাকে নিজের স্বভাবে পরিণত করলে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে তার নাম পরম সত্যবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয় (সুনানে আবু দাউদ)। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের সম্বোধন করে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় আরও বলেন- তোমরা নিজেদের ব্যাপারে ছয়টি জিনিসের দায়িত্ব নাও, তাহলে আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের দায়িত্ব নেব। ১. তোমরা যখন কথা বলবে সত্য বলবে। ২. ওয়াদা করলে পূরণ করবে। ৩. আমানত রাখলে তার যথাযথ সংরক্ষণ করবে। ৪. নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে। ৫. তোমাদের দৃষ্টি (হারাম দৃশ্য থেকে) অবনত রাখবে। এবং জুলুম থেকে নিজেদের বিরত রাখবে (মুসনাদে আহমাদ)। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, তিনি সন্দেহপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে চলতেন। এ ব্যাপারে তিনি নিজে যেমন সচেতন ছিলেন, অন্যদেরও এ ব্যাপারে সচেতন থাকার শিক্ষা দিতেন। সত্য ও সততার প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি এমনটা করতেন এবং বলতেন।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য ও সততার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করতেন। কাউকে ইসলামের অনন্য আদর্শের শিক্ষাদানকালেও তিনি বিশেষভাবে সত্য ও সততার বিষয়ে যত্নবান হওয়ার নির্দেশনা দিতেন। হাওয়াজিন গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণকালে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ইসলামের সুমহান আদর্শ সততার মূল্য শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন, কথার মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হলো সত্য কথা... (সহিহ বোখারি)।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া গাফুরিয়া মাখজানুল উলুম, টঙ্গী, গাজীপুর। খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর