রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা
বিশেষ সাক্ষাৎকারে ড. আসিফ নজরুল

নিয়ত ভালো থাকলে নির্বাচন ভালো হবে

নিয়ত ভালো থাকলে নির্বাচন ভালো হবে

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চলছে নানা তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা। ‘সরকার বলছে সংবিধান মেনে তার অধীনে নির্বাচন এবং বিরোধী দল বলছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে। এখন প্রশ্ন ওঠে, আপনার নিয়তটা কেমন? নিয়ত ভালো থাকলে সংবিধান মেনেই নির্বাচন সম্ভব’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিনিয়র রিপোর্টার জয়শ্রী ভাদুড়ীর সঙ্গে নির্বাচন ও বর্তমান রাজনীতি নিয়ে তাঁর আলাপচারিতার চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য-

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে বলে আপনি মনে করছেন?

ড. আসিফ নজরুল : আগামী নির্বাচন যদি দলীয় সরকারের অধীনে হয়, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় নির্বাচন হলে কারচুপি হবে। কিন্তু নির্বাচনে যদি বৃহৎ কোনো দল বিশেষ করে বিএনপির মতো কোনো দল না আসে এবং আওয়ামী লীগ যদি কিছু দুর্বল পার্টি কিংবা তার জোটসঙ্গী নিয়ে নির্বাচন করে, যাদের জনসমর্থন তেমন নেই, তাহলে ভোট কারচুপির তো দরকারই নেই। নির্বাচনে বৃহৎ দলগুলোর অংশগ্রহণ থাকলে তা প্রতিযোগিতামূলক হবে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে অবশ্যই আওয়ামী লীগ প্রচণ্ড কারচুপির চেষ্টা করবে, যেমনটা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনে প্রমাণ করেছে। কেননা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে না। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা যে কোনো ফর্মে হয় তাহলে নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে। আমার ধারণা, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হলে আওয়ামী লীগ পরাজিত হবে। এত দিন আওয়ামী লীগ বলত উন্নয়ন করেছি। কিন্তু এখন বৈদেশিক ঋণ, রিজার্ভের যে অবস্থা, দ্রব্যমূল্যের যে পরিস্থিতি এখন তা বলার আর উপায় নেই।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : নির্বাচন নিয়ে জটিলতা নিরসনে আপনার পরামর্শ কী?

ড. আসিফ নজরুল : সমাধান আসলে নিয়তের ওপর নির্ভর করছে। সরকার বলছে সংবিধান মেনে তার অধীনে নির্বাচন এবং বিরোধী দল বলছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে। এখন প্রশ্ন ওঠে, আপনার নিয়তটা কেমন? নিয়ত ভালো থাকলে সংবিধান মেনেই নির্বাচন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের মধ্যে সেই আস্থাটা তৈরি করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন নির্বাচনকালীন একটি সরকার গঠন করা। যে সরকারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে অন্য কোনো সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রী হবেন, বিরোধী দল থেকে মন্ত্রী হবেন এবং এক-দশমাংশ টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীও থাকবেন। তাহলে হয়তো নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হতে পারে, যদি নিয়ত ভালো থাকে। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই ঝুঁকি নেওয়ার সাহস নেই, বিএনপিরও তত্ত্বাবধায়ক বাদে অন্য কোনো ব্যবস্থার প্রতি কোনো আস্থা নেই। তাই দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, হয়তো আমরা বড় একটি সংঘাতের দিকে যাচ্ছি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না?

ড. আসিফ নজরুল : এ সরকার যদি এমন একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে এবং সত্যিকার অর্থেই নিরপেক্ষ নির্বাচন দেয় তাহলে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে পারে। ২০০৭ সালে আন্দোলনকালে ৩০ বছর আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন দাবি তুলে আওয়ামী লীগ তার অধীনে নির্বাচন করেনি। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক যুগ ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আছেন, এখনো আছেন, তাঁর পুরো সরকারে আওয়ামী লীগের লোক। তাহলে তাঁদের আওতায় বিএনপি নির্বাচন করার আস্থা কেন পাবে? দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যায় না, হলে কারচুপি হয়; দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো এ দাবি প্রথম তুলেছিলেন। উনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতকে নিয়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। উনি বলেছিলেন চিরকালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই। বিএনপি সেটা মেনে নিয়েছিল। এটা একটা সামাজিক চুক্তি ছিল। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, আইনজীবী, সুশীল সমাজসহ সবার রাজনৈতিক ঐকমত্য ছিল। এটা আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতের আন্দোলনের ফল, যা বিএনপি মেনে নিয়েছিল। এখন সামাজিক চুক্তি ভঙ্গ করে একটা রাজনৈতিক দল সিদ্ধান্ত নিলে তা সবাই মেনে নেবে কেন? মেনে নিত যদি ২০১৮ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু হতো। তাহলে আওয়ামী লীগ বলতে পারত যে, দলীয় সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। তখন কেউ আপত্তি তুললে তা ধোপে টিকত না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই আস্থা অর্জন করতে পারেনি।

♦ সরকার বলছে সংবিধান মেনে তার অধীনে নির্বাচন এবং বিরোধী দল বলছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে। এখন প্রশ্ন ওঠে, আপনার নিয়তটা কেমন? নিয়ত ভালো থাকলে সংবিধান মেনেই নির্বাচন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের মধ্যে সেই আস্থাটা তৈরি করতে হবে।

♦ ভিসানীতির কারণে একটা দেশে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়ে গেছে এমন কোনো নজির আছে কি না আমি জানি না। তবে এতে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের অনেকটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : নির্বাচন সামনে রেখে নতুন দল গঠন হচ্ছে। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

ড. আসিফ নজরুল : এ ধরনের গৃহপালিত বিরোধী দল গড়ার রাজনীতি এরশাদ আমলে শুরু হয়েছিল। নির্বাচনের আগে ছোট ছোট দল গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া সেটা দেশে নতুন নয়। লোকদেখানোর জন্য যারা দলছুট আছে তাদের প্রলোভিত করার জন্য নিয়ে এসে এসব দল গড়ে তোলা হয়। নির্বাচন কমিশন যাদের নিবন্ধন দেয়নি তারা আদালত থেকে নিবন্ধন নিয়ে এসেছেন। এটা দলের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য করা হয়েছে। কিন্তু এটা কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি কি নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে?

ড. আসিফ নজরুল : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির কারণে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিসর বড় করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। পুলিশ এবং জনপ্রশাসন ভিসানীতির আওতায় পড়েছে। সরকারি দলের মধ্যে নার্ভাসনেস তৈরি হয়েছে। ভিসানীতির কারণে একটা দেশে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়ে গেছে এমন কোনো নজির আছে কি না আমি জানি না। তবে এতে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের অনেকটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কেননা এ দেশের ক্ষমতাসীন লোকজন বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার করেছে, ব্যাংকগুলো লোপাট হয়েছে। এ সরকারের আমলে আমেরিকা, ইউরোপ, কানাডা, মালয়েশিয়ার মতো দেশে বহু অর্থ পাচার হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তো বিরোধী দল এটা করেনি, তাদের লোকজনই করেছে। এমনকি মন্ত্রী, এমপিসহ বহু জনপ্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তার সন্তান এসব দেশে পড়াশোনা করছে ও স্থায়ী বসবাসের জন্য গেছে। এখন তারা যদি নির্বাচনে অবৈধ হস্তক্ষেপ করেন এবং এ কারণে ওইসব দেশে থাকতে না পারে, তাহলে সেটা তাদের জন্য অবশ্যই শুভ হবে না। তাই এ ভিসানীতি কিছুটা হলেও এ নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিরোধী দল কি এ ভিসানীতির আওতায় আসতে পারে?

ড. আসিফ নজরুল : এর আগে বিভিন্ন দেশে ভিসানীতি আরোপ করা হয়েছে, কিন্তু সেটা নির্বাচনের পরে, আগে নয়। নির্বাচনের আগে ভিসানীতির প্রয়োগ বাংলাদেশে প্রথম। বিরোধী দলও অবশ্যই ভিসানীতির আওতায় আসতে পারে। তবে এখানে বিরোধী দল বলতে আসলে কাকে বোঝানো হয়েছে সেটা বুঝতে হবে। দেশে দুই শ্রেণির বিরোধী দল আছে, প্রথমত সরকারের আনুকূল্য বিরোধী দল যেমন, জাতীয় পার্টি। এ ছাড়া বিএনপি রয়েছে। এখন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে, তাতে যদি জাতীয় পার্টির কেউ বাধার সৃষ্টি করে তবে সে এই নীতির আওতায় পড়বে এবং যদি বিএনপির কেউ করে সেও পড়তে পারে। তবে একতরফা বা কারচুপির নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করলে ভিসানীতির আওতায় পড়বে বলে আমার মনে হয় না। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের দায়িত্ব প্রধানত সরকারের ওপরই বর্তায়।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুই দলের করণীয় কী হতে পারে?

ড. আসিফ নজরুল : আমার মত হচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে কারচুপি করার চেষ্টা করা হয়। এটা এরশাদ করেছেন, খালেদা জিয়া ১৯৯৬- তে করেছেন এবং আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে করেছে। এসব সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। কারণ সবার জানা, এসব সরকার নিজেদের লোকজন দিয়ে জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন সবকিছু সাজায়। যারা সরকারের প্রতি অন্ধভাবে অনুগত নয় বা যারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করেন, তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয় না। এটা বিএনপি আগে করেছিল, আওয়ামী লীগ এখন ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে প্রশাসন সাজিয়েছে। সিনিয়রদের ডিঙিয়ে জুনিয়রদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। কারণ সরকারের অনুগত থেকে তারা কাজ করবে। তাহলে এই সরকার ও প্রশাসন থাকা অবস্থায় কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে? এটা বিএনপি সরকারে থাকলেও হতো না, তারাও এটাই করত। তাও যদি দলীয় সরকার নির্বাচন করতে চায় তাহলে দেশে সংঘাত বাড়বে, বিদেশের হস্তক্ষেপের পথ করে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে। অতীতে সংলাপে কোনো কাজ হয়নি, তারপরও রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপ করতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দলীয় সরকার অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনের বাইরে আর কী কী উপায় আছে সেসব বিকল্প নিয়ে আলোচনা করতে পারে।

সর্বশেষ খবর