শিরোনাম
শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আনসারকে গ্রেফতার ও তল্লাশির ক্ষমতা

এ কে এম শহীদুল হক

আনসারকে গ্রেফতার ও তল্লাশির ক্ষমতা

২৩ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে মহান জাতীয় সংসদে ব্যাটালিয়ন আনসার সংশোধনী অ্যাক্ট-২০২৩ উত্থাপিত হয়েছে। আমার খসড়া আইনটি দেখার সুযোগ হয়নি। তবে বিভিন্ন মিডিয়ার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে যা জানতে পেরেছি তার ওপর ভিত্তি করেই এ লেখা। জানা যায়, এই সংশোধনী আইনের ৮ ধারায় ব্যাটালিয়ন আনসারকে গ্রেফতার ও তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়ার বিধান আছে। সংসদে ব্যাটালিয়ন আনসার অ্যাক্ট-২০২৩ উত্থাপনের পর পুলিশ বাহিনীর মধ্যে চরম অসন্তোষ পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা আইজিপির নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিধানের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছেন। রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের অনেকেই এ উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক পূর্বমুহূর্তে ব্যাটালিয়ন আনসারকে গ্রেফতার ও তল্লাশির ক্ষমতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ায় জনমনে কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তা হলো-

১. কী কারণে ব্যাটালিয়ন আনসারকে এ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে?

২. কার প্রয়োজনে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে? এতে কি রাষ্ট্র ও জনগণের কোনো স্বার্থ আছে?

৩. পুলিশের ক্ষমতার কোনো ঘাটতির জন্য কি এই ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে?

৪. ব্যাটালিয়ন আনসারকে এ ক্ষমতা দিলে সমাজে কি পরিবর্তন আসতে পারে?

৫. পুলিশ কেন আনসারকে গ্রেফতার ও তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়ার বিরোধিতা করছে? ইত্যাদি।

কী কারণে ব্যাটালিয়ন আনসারকে এ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর আমার কাছেও নেই। তবে ধরে নিতে পারি আনসারকে খুশি করার জন্য এ উদ্যোগ। আনসারকে খুশি করলে অন্যরা যে অখুশি হতে পারে এটা কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনুধাবন করতে পারেন? আনসার খুশি হলো কিন্তু পুলিশ অখুশি হলো। এ পরিস্থিতিতে বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ দমনে কি কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না? এ বিষয়গুলো কি বিবেচনায় এনে আইনটি সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে? আমি মনে করি দেশে এমন কোনো কারণ সৃষ্টি হয়নি যার জন্য ব্যাটালিয়ন আনসারকে গ্রেফতার ও তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। এটা নেহায়েতই অপ্রয়োজনীয় উদ্যোগ যা মাঠপর্যায়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি হবে।

কার প্রয়োজনে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে? এতে কি রাষ্ট্র ও জনগণের কোনো স্বার্থ আছে?

কার প্রয়োজনে আনসারকে এ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে তার জবাবও আমার কাছে নেই। আইন তৈরি হয় জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থে। আনসারকে পুলিশের ক্ষমতার ভাগ দেওয়া হলে জনগণ ও রাষ্ট্রের কারওই কোনো কল্যাণ বা স্বার্থরক্ষার কোনো লক্ষণ আমি দেখতে পাই না যদিও বলা হয় জনস্বার্থে এ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছে উল্টোটা ঘটার।

পুলিশের ক্ষমতার কোনো ঘাটতির জন্য কি এই ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে?

বাংলাদেশ পুলিশ বর্তমানে পেশাদার, চৌকশ ও কার্যকর পুলিশ বাহিনীতে উন্নীত হয়েছে। এ বাহিনীর সক্ষমতা উঁচুমাত্রায় পৌঁছেছে। জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ পুলিশ পৃথিবীতে একটি রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। হলি আর্টিজানের ঘটনার পর জঙ্গিরা দেশে কোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে পারেনি। পুলিশ জঙ্গিদের সব আস্তানা খুঁজে বের করে সফল অভিযানের মাধ্যমে আস্তানাগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে। অনেক জঙ্গিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। কাজেই পুলিশের ক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট যেমন- স্পেশাল ব্রাঞ্চ, সিআইডি, পিবিআই, র‌্যাব, ডিবি, থানা পুলিশ, নৌপুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, শিল্প পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত অপরাধীদের গ্রেফতার করে তাদের আইনের আমলে আনছে। অপরাধীদের গ্রেফতার ও মামলা তদন্তে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের জন্য পুলিশ সম্পূর্ণভাবে সক্ষম। তাদের সক্ষমতার তেমন কোনো ঘাটতি নেই। এ কাজে অন্য বাহিনীর হস্তক্ষেপ বা সম্পৃক্ততার প্রয়োজন নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সরকারের নির্দেশে অন্য বাহিনীর সহায়তা নেওয়ার যে আইনগত বিধান আছে তা প্রয়োজনে পুলিশ অনুসরণ করে যাচ্ছে।

ব্যাটালিয়ন আনসারকে এ ক্ষমতা দিলে সমাজে কি পরিবর্তন আসতে পারে?

পুলিশের গ্রেফতার ও তল্লাশির ক্ষমতা আনসারকে দিলে তার নির্বিচার ব্যবহারের আশঙ্কা থাকবে। সাধারণ জনগণ ধৎনরঃৎধৎু ধৎৎবংঃ বা যথেচ্ছ গ্রেফতার ও হয়রানির শিকার হতে পারে। পুলিশের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে ভুল বোঝাবুঝি, বিতর্ক কিংবা রেষারেষি হতে পারে। দুই বাহিনীর মধ্যে এ নিয়ে সম্পর্ক তিক্ত হতে পারে- যা সমাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজকে বিঘ্নিত করতে পারে।

পুলিশ কেন আনসারকে গ্রেফতার ও তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়ার বিরোধিতা করছে?

ব্যাটালিয়ন আনসারকে আটক ও তল্লাশির ক্ষমতা দিলে কি পুলিশের ক্ষমতা কমে যাবে? না, পুলিশের ক্ষমতা ও দায়িত্ব কিছুই কমবে না। তবে কেন পুলিশ বিরোধিতা করছে? পুলিশের ক্ষমতা না কমলেও ক্ষমতায় ভাগ তো বসাবে আনসার। কে চায় যুগ যুগ ধরে যে ক্ষমতা যারা এক্সারসাইজ করছে সে ক্ষমতায় অন্য কেউ অংশীদার হোক। এ ধারণা সাধারণ মানুষ করতেই পারে। কিন্তু আসলে তা নয়। ক্ষমতা ভাগাভাগির বিষয় নয়। পুলিশ মনে করে আনসারকে পুলিশের কিছু ক্ষমতা দিলে মাঠপর্যায়ে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। ভুল বোঝাবুঝি রেষারেষি ও বৈরিতা সৃষ্টি হতে পারে। এতে দুই বাহিনীর মধ্যে বিরাজমান সুসম্পর্ক ও সমন্বয়তা নষ্ট হতে পারে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। পুলিশ নিয়োগ পাওয়ার ক্ষণ হতেই আইন ও বিধিবিধান শেখে ও চর্চা করে। আইনের প্রয়োগে পুলিশের সঙ্গে আনসারের মতামত ও পারসেপশনে অবশ্যই ভিন্নতা থাকবে। তখনই বিরোধ ও বিপত্তি দেখা দিতে পারে। পুলিশ দায়িত্ব পালনে কেন এ অপ্রয়োজনীয় বিড়ম্বনা নেবে। তাই পুলিশ নিজের ক্ষমতায় অন্য কেউ ভাগ বসাক তা চায় না। এটাই স্বাভাবিক প্রবণতা। পুলিশ সেনাবাহিনীর ক্ষমতা চাইলে নিশ্চয়ই সেনাবাহিনী তা দেবে না। প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা চাইলে পুলিশকে তা কেউ দেবে না। তাই কোনো প্রতিষ্ঠিত ও মীমাংসিত ইস্যুকে অস্থির ও সমস্যাসংকুল পরিস্থিতিতে ফেলে দেওয়া মোটেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।

আইন কী বলে?

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় পুলিশ ও আদালত দুটি প্রধান কম্পোনেন্ট। অন্যান্য দেশেও একই ব্যবস্থা। পুলিশ ও আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হয় ফৌজদারি কার্যবিধি আইন ১৮৯৮ মোতাবেক। ফৌজদারি কার্যবিধিতে মামলা বা অভিযোগের তদন্তের ক্ষমতা কেবল পুলিশকেই দেওয়া হয়েছে। অন্য কোনো সংস্থাকে দেয়নি। গ্রেফতার ও তল্লাশি তদন্তেরই অংশ। সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের জন্যই গ্রেফতার ও তল্লাশি করা হয়। তদন্ত একটি জটিল ও টেকনিক্যাল বিষয়। এর সঙ্গে আইন, বিধি, আদালতে বিচার্য সাক্ষ্য সংগ্রহ, তল্লাশি প্রক্রিয়া, মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার, ব্যক্তির মর্যাদা ইত্যাদি জড়িত। পুলিশ নিয়োগ প্রাপ্তির ক্ষণ হতে একজন পুলিশ অফিসার আইন, বিধিবিধান, তদন্ত, গ্রেফতার, তল্লাশি, তদন্ত প্রতিবেদন লিখন ইত্যাদি বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ ও ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে শিক্ষা গ্রহণ করে দক্ষ ও পেশাদার হয়ে ওঠে। অন্য কোনো সংস্থার সদস্যদের এ বিষয়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করা কঠিন। তাই পুলিশই ফৌজদারি অপরাধের প্রধান তদন্ত সংস্থা। আনসার কোনো তদন্তকারী সংস্থা নয়। কাজেই আনসারকে গ্রেফতার ও তল্লাশির ক্ষমতা দেওয়া আইনের চোখে সিদ্ধ নয়। ব্যাটালিয়ন আনসার অ্যাক্ট ১৯৯৫-এ আনসারের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথার্থভাবে বর্ণিত আছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ কতিপয় সংস্থাকে চাহিদা মোতাবেক ধীঁরষরধৎু ভড়ৎপব হিসেবে সহায়তা করাই আনসারের মূল দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব ও কর্তব্য ব্যতীত আনসারকে অন্য কোনো দায়িত্ব বা ক্ষমতা প্রদান করলে তা আইনি জটিলতার মধ্যে পড়বে। মূল আইন ফৌজদারি কার্যবিধির সঙ্গে অসামঞ্জস্য ও সাংঘর্ষিক হবে। আইন প্রয়োগে জটিলতা তৈরি হবে। কাজেই ফৌজদারি কার্যবিধি মোতাবেক আনসারকে আইন ও তল্লাশির ক্ষমতা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সব বাহিনীর সদস্য এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণের কল্যাণ ও দেশের উন্নয়নের জন্যই কাজ করে থাকে। যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে জনগণকে সেবা দেওয়াই প্রত্যেকের লক্ষ্য হওয়া উচিত। একজনের কাজে অন্যজনের হস্তক্ষেপ দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে নাগরিকদের সেবা দেওয়াই মুখ্য বিষয়।

পুলিশ একটি গণমুখী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। সবার সঙ্গে সমন্বয় ও সুসম্পর্ক রেখে পুলিশ কাজ করে। এটাই পুলিশের সংস্কৃতি। আনসার বাহিনীর সঙ্গেও পুলিশের সুসম্পর্ক রয়েছে। একসঙ্গে চলা, একসঙ্গে কাজ করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আনসার যখন পুলিশের সঙ্গে পুলিশের কমান্ড সার্টিফিকেটে দায়িত্ব পালন করে তখন সে পুলিশের কাজই করে থাকে। অপ্রয়োজনীয় কোনো ইস্যুকে সামনে এনে দুই বাহিনীর সুসম্পর্ককে নষ্ট না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। একজন সাবেক পুলিশ অফিসার হিসেবে আমি সংশ্লিষ্ট সবার কাছে সে আবেদনই রাখছি।

লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ

সর্বশেষ খবর