সোমবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

৫২ বছরের বাংলাদেশ- বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

৫২ বছরের বাংলাদেশ- বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

পৃথিবীতে এখন রাষ্ট্রের সংখ্যা প্রায় ২০০। তার মধ্যেও ১৯৩টি দেশ জাতিসংঘের সদস্য। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের জন্ম ও স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস আছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস বহু দিক থেকে অনন্য এবং অসাধারণ। কারণ, মাত্র ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে দেশ শত্রুমুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। শুধু তাই নয়, এমন ঘটনাও নেই যেখানে প্রায় ৯৩ হাজার পেশাদার সেনাসদস্য বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। আরও বিরল ঘটনা যে, ওই রকম একটা আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা লাখো জনতার সামনে খোলা আকাশের নিচে ঘটেছে। এরকম বিরল গৌরবের ইতিহাস যে কোনো জাতির জন্য অমূল্য শ্রেষ্ঠ জাতীয় সম্পদ। প্রাকৃতিক এবং অন্যান্য সম্পদ যতই থাকুক, ঐতিহাসিক জাতীয় অর্জনের যে সম্পদ তার সঠিক ব্যবহার ব্যতিরেকে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই কখনো সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়নি, এর অনেক চাক্ষুষ উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে আছে। বাংলাদেশের জাতীয় শ্রেষ্ঠ অর্জন ও ইতিহাসের মহান স্থপতি হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার পরপর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্রীয় দর্শন ও মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে তিনি নতুন দেশ গড়ার যাত্রা শুরু করেন। এটাও নজিরবিহীন এক ঘটনা যে, ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়েও মাত্র ৯ মাসের মাথায় বিশ্বনন্দিত একটি সংবিধান তিনি প্রণয়ন করতে সক্ষম হন। রাষ্ট্র দর্শন এবং তার লক্ষ্য ও ভিশন তৈরিতে বঙ্গবন্ধুর সময় লাগেনি। কারণ, এর সবকিছুই এসেছে নিজের হৃদয় থেকে যার উৎসমূলে ছিল সাড়ে ৭ কোটি মানুষের হৃদয়। সুতরাং সাড়ে ৭ কোটি মানুষের হৃদয়ের কথাই প্রতিফলিত হয় বাহাত্তরের সংবিধানে। একজন মানুষের ভালো-মন্দ, উন্নতি-সমৃদ্ধি যেমন তার নিজের মনমানসিকতা, অর্থাৎ নিজস্ব মানসতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল, তেমনি সামষ্টিকভাবে রাষ্ট্রীয় মানসতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে একটা দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি, যার ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে দেশের বৃহত্তর মানুষ। অর্থাৎ গড়পড়তায় বৃহত্তর মানুষের মনমানসিকতা যখন রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়- রাষ্ট্রের সব সেক্টর ও অঙ্গনে তার প্রতিফলন ঘটে। তাই বৃহত্তর মানুষের মনমানসিকতাই রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষ যদি ধর্মান্ধ, উগ্রবাদী, যুক্তিহীন একগুঁয়ে এবং নৈতিকতাহীন ও আদর্শহীন হয় তাহলে রাষ্ট্রের পরিস্থিতি একরকম হবে, আর মানুষ যদি উদার গণতান্ত্রিক ও নৈতিকতাপূর্ণ মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন হয় তাহলে সেটা অন্যরকম হবে। একটা জাতীয় মনমানসিকতা তৈরিতে নতুন যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য কম করে হলেও ২৫-৩০ বছর নিরবচ্ছিন্ন সময় লাগে। প্রতিবেশী ভারতে আজ আমরা যে টেকসই গণতান্ত্রিক ভিত্তি এবং রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শে ঐকমত্য দেখি তার কারণ, ১৯৪৭ সাল থেকে নতুন দেশটি স্বাধীনতার মৌলিক দর্শনের ওপর নিরবচ্ছিন্নভাবে ৩০ বছর চলেছে, যার নিরবচ্ছিন্ন নেতৃত্বে ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল কংগ্রেস। সুতরাং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রণীত রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের ওপর যদি একটানা কমপক্ষে ২৫-৩০ বছর বাংলাদেশ পরিচালিত হতো তাহলে আমাদের আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হতো না। রাষ্ট্রকে কখনো কলঙ্কিত সামরিক স্বৈরশাসনের কবলে পড়তে হতো না। সামরিক শাসকের ঔরসজাত রাজনীতির জোয়াল বাংলাদেশকে আজও গ্রাস করে রাখতে পারত না। হত্যাকান্ডের রাজনীতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেত না। ধর্মীয় রাজনীতি এবং তার থেকে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সশস্ত্র জঙ্গিবাদের উত্থান বাংলাদেশে কখনো হতো না। ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় শিরোনাম হতো না যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বাঁচতে হলে দেশত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কেউ কখনো বলতে পারত না পরবর্তী আফগানিস্তান হবে বাংলাদেশ। সামরিক শাসকের ঔরসজাত রাজনীতি আর দীর্ঘ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত রাজনীতি একসঙ্গে চলতে পারে না বলেই রাজনীতিতে আজও অনাকাক্সিক্ষত সংকট বিদ্যমান। বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনার সুযোগ পান মাত্র সাড়ে তিন বছর। এই স্বল্প সময়ে তিনি যেসব কঠিন বাধা ও সংকট উতরিয়ে বাংলাদেশকে যেখানে এনেছিলেন সেটিও ছিল এক অসাধ্য সাধনের কাজ। বঙ্গবন্ধুর উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে আত্মঘাতী ও দেশঘাতী এক রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটে। তাদের ধ্বংসাত্মক ও নৈরাজ্যপূর্ণ রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় জড়ো হয় এ দেশীয় একাত্তরের সব পরাজিত পক্ষ। তার সঙ্গে যুক্ত হয় উগ্র চীনপন্থিদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াত নেতা গোলাম আযম লন্ডনে বসে পূর্ব-পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন শুরু করে। নৈরাজ্যের কোনো সীমা থাকে না। শুধু ১৯৭৩ সালে ৭০টি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি লুট হয়। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে এক দিনে নারায়ণগঞ্জের ২৭টি পাটের গুদামে আগুন দেওয়া হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছয়জন সংসদ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিন্তু এত বড় হিমালয়সম বাধা বঙ্গবন্ধুকে থামাতে পারেনি। এর ভিতরেই রাষ্ট্রের সব সেক্টরের জন্য একেকটি শক্তিশালী ভিত তৈরি করে ফেলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, মানুষের মানসকাঠামোকে বাংলাদেশের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য বহুল প্রশংসিত কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরি এবং তা চালু করে দেন। বাংলাদেশ বিমান চালুসহ সব যোগাযোগ সেক্টরকে চালু করেন। প্রায় ১ কোটি শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে আনা শুধু নয়, তাদের পুনর্বাসনের সব ব্যবস্থা করা হয়। কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প, ভূমি সংস্কার ও প্রতিরক্ষা নীতিসহ সব রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন করেন। জাতীয় সমুদ্র নীতিমালা প্রণয়ন করেন, যার সূত্রেই ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলেন এবং বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্রের ওপর সার্বভৌম অধিকার ফিরে পায়। প্রতিরক্ষা নীতি অনুসারে সশস্ত্র বাহিনীকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার কাজে হাত দেন। সেনাবাহিনীর মর্যাদার প্রতীক বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। বৈদেশিক সম্পর্কে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, নীতির ঘোষণা দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১২১টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক প্রায় সব সংস্থার সদস্য হয়ে যায় বাংলাদেশ। ধ্বংসস্তূপ থেকে যাত্রা শুরু করে বঙ্গবন্ধুর আমলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গিয়ে দাঁড়ায় শতকরা ৭.৫ ভাগ হারে, যা ওই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। পর্বতসম বাধা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু সবকিছু ভালোভাবে গুছিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সব শেষ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু নিহত হন।

দেশ সামরিক শাসনের কবলে পড়ে। সামরিক স্বৈরশাসকের আবির্ভাব ঘটে। মানুষ ভয়ার্ত চোখে আইয়ুব খানের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়, যা থেকে মুক্ত হওয়া ছিল স্বাধীনতার প্রধান এক লক্ষ্য। ১৫ আগস্টের আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার বন্ধ করার ব্যবস্থা শুধু নয়, খুনিদের রাষ্ট্রীয় পদে চাকরি ও পদোন্নতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে হত্যাকান্ডের রাজনীতি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। বঙ্গবন্ধু প্রণীত সংবিধান, রাষ্ট্র দর্শন, রাজনৈতিক মূল্যবোধ, সবকিছুকে সামরিক আদেশ দ্বারা বাতিল করে দেওয়া হয়। সর্বজন প্রশংসিত এবং বাংলাদেশের উপযুক্ত মানসকাঠামো তৈরির বাইবেল খ্যাত কুদরত-ই-খুদা কমিশনের শিক্ষানীতিকেও বাতিল করে দেওয়া হয়। একাত্তরে পরাজিত ও পরিত্যক্ত সবকিছুকে রাষ্ট্রের সব অঙ্গনে ফিরিয়ে আনা হয়। বাংলাদেশ নামে আরেকটি পাকিস্তান বানানোর সব ব্যবস্থা নেন দুই সামরিক শাসক। অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রের অগ্রযাত্রা মুখ থুবড়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর সময় যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল শতকরা ৭.৫ হারে সেখানে ১৫ বছরের সামরিক শাসনে তা নেমে আসে শতকরা ৫ ভাগেরও নিচে। রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজের সর্বত্র ধর্মীয় উগ্রবাদের বিস্তার ঘটে। ভূতের মতো রাষ্ট্র চলতে থাকে পেছনের দিকে। এরকম এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আবার উজ্জীবিত হয়। একসময়ে এসে সামরিক শাসক ও শাসনের পতন ঘটে। কিন্তু ১৫ বছর একটানা ওই পাকিস্তানি পরিত্যক্ত পথে রাষ্ট্র চলায় ইতোমধ্যে মহাসর্বনাশ হয়ে যায়, কয়েকটি নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ এবং তার থেকে উৎপত্তি রাষ্ট্র দর্শন সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। এই সর্বনাশের কালোছায়া এখনো বাংলাদেশকে তাড়া করে ফিরছে। এটাই আজকের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সংকট। এই সংকটকে উপেক্ষা করে রাজনীতি বলেন, আর নির্বাচন বলেন, কোনো সংকট থেকেই রেহাই পাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর মতো তাঁর মেয়েও অকুতোভয়। ২১ বার হত্যার চেষ্টাও তাঁকে থামাতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে এবং প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু যেমন মাত্র ৯ মাসের মধ্যে অভূতপূর্ব দর্শনসংবলিত একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে পেরেছিলেন, তেমনি ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এবং প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা মাত্র দেড় বছরের মাথায় ২১ বছরের ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভূতপূর্ব এক শান্তিচুক্তি করতে সক্ষম হন। আরেকবার প্রমাণ হয় দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি রাজনৈতিক নেতৃত্বের খাদহীন ভালোবাসা থাকলে কোনো সমস্যাই আর সমস্যা হয়ে থাকে না। বঙ্গবন্ধু যেমন ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে নতুন যাত্রা শুরু করেছিলেন, তেমনি শেখ হাসিনাও ২১ বছরের পুঞ্জীভূত রাষ্ট্রীয় জঞ্জালের ওপর দাঁড়িয়ে নবযাত্রা শুরু করেন। মানুষের মধ্যে আবার আশার সৃষ্টি হয়। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে দেশি ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বুঝতে না পারায় আওয়ামী লীগ ভূমিধস পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকা একাত্তরের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হয়ে যায়। বিএনপি-জামায়াত সরকারের শুরুতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, জিয়া-এরশাদ কর্তৃক বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণের অসমাপ্ত মিশন এবার তারা সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর। পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশকে শুধু একটি ধর্ম অবলম্বনকারী মানুষের রাষ্ট্র করার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে শুরু হয় সুপরিকল্পিত আক্রমণ, যার সূত্রেই দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় তখন শিরোনাম হয়- বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বাঁচতে হলে দেশত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ধর্মীয় উগ্রবাদী জঙ্গি সন্ত্রাসের সীমাহীন উত্থানে রাষ্ট্র নীরব ভূমিকা পালন করে। শঙ্কিত হয় আঞ্চলিক ও বিশ্বসম্প্রদায়। ২০০২ সালের ২ এপ্রিল ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে শিরোনাম হয় ‘পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ইসলামিস্ট জঙ্গি।’ ২০০২ সালের ৪ এপ্রিল ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক পত্রিকায় বার্টন লিটনার লেখেন, ‘বাংলাদেশ হতে সাবধান, সেখানে এখন জঙ্গিগোষ্ঠীর আস্তানা’। আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসে তখনকার জামায়াত-বিএনপি সরকার পাকিস্তানের প্রক্সি হয়ে কাজ করতে থাকে, যা মানুষের সামনে চলে আসে ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চোরাচালান ধরা পড়ার পর। আগামীতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাজনৈতিক পক্ষ যেন আর কখনো ক্ষমতায় আসতে না পারে তার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটানো হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণ। দেশের অভ্যন্তরে নজিরবিহীন নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। সেই পথ ধরেই বিরাজনীতিকরণের প্রকল্প ২০০৭-০৮ মেয়াদের তথাকথিত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমন ঘটে। কিন্তু মানুষের ধাক্কায় তারাও টিকতে পারেনি। ২০০১-০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপির সীমাহীন ব্যর্থতার পরিণতিতে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন পায়। ভূমিধস বিজয় পায় আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনরায় দেশের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা। এবার তিনি আরও ধীরস্থির, অভিজ্ঞ, পরিপক্ব ও পোড় খাওয়া এক নেত্রী। রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রসহ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর সুদৃঢ় ছাপ গত ১৫ বছরে পড়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন ও জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনে রোল মডেলের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। ব্রিটিশ শাসনের ঐতিহাসিক সূত্রে সাত দশক ধরে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে জিইয়ে থাকা প্রায় সব সমস্যার সমাধান করেছেন, যার প্রত্যেকটি দেশের অগ্রায়ণের জন্য মাইলফলক অর্জন। আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস পুরোপুরি নির্মল করতে সক্ষম হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা কতখানি তা সম্প্রতি ব্রিকস ও জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের সময় দেখা গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার ভূমিকা এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি। ইতিহাস পথ দেখায়, ইতিহাস কথা বলে। তাই আজকের লেখায় গত ৫২ বছরে বাংলাদেশের চলমান ধারায় একটা ছোট সারসংক্ষেপ চিত্র তুলে ধরলাম। বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে আমাদের তরুণ প্রজন্ম ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে শিখেছে। সুতরাং বাংলাদেশ আর পেছনে নয়, সামনে যাবে।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর