শনিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বহু জল্পনার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচনি তফসিল

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

বহু জল্পনার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচনি তফসিল

১৫ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বহু প্রতীক্ষিত তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন তাদের ওপরে অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্বটি পালন করলেন। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষ নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনগুলো ছাড়াও সাধুবাদ জানিয়েছে মহাজোটের অন্যান্য শরিক এবং জাতীয় পার্টির নেত্রী, যিনি সংসদে বিরোধী দলেরও প্রধান, রওশন এরশাদ। তৃণমূল বিএনপিও স্বাগত জানিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা বলেছে। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত এবং চরমোনাই পীরের নেতৃত্বে আরও একটি ধর্মান্ধ, ধর্ম ব্যবসায়ী দল তফসিল প্রত্যাখ্যান করে অবরোধ এবং হরতালের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে।

তফসিল ঘোষণা সাংবিধানিক এবং আইনের আলোকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুধু প্রারম্ভিক পদক্ষেপই নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে সংবিধান এবং রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপলস অ্যাক্টের বিধান মতে, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দায়িত্ব এবং ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের ওপর চলে যায়। তফসিল ঘোষণার পর থেকে সব কর্মচারী-কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ চলে যায় নির্বাচন কমিশনের ওপর। এককথায় নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকেই সরকার বলা যায়। সংবিধান এবং আইন কমিশনের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান করেছে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের। নির্বাচন বিধি এবং নীতিমালা ভঙ্গকারীদের, তারা যত উঁচুমাপের হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতাও থাকবে কমিশনের ওপর।

নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইবেন তারা সংবিধান এবং আইন অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্য কি না, তা প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করবেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। কমিশনই সিদ্ধান্ত নেবে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে কাদের নিয়োগ করা হবে। তবে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী জেলার ডিসিদের ওপরই সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়, যার ব্যত্যয় এ নির্বাচনেও হবে না বলে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে রিটার্নিং অফিসাররাই প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে উৎসুক ব্যক্তিদের যোগ্যতা নির্ধারণ করে থাকেন। তাদের দেখতে হয় উৎসাহী ব্যক্তি ঋণখেলাপি কি না, অপ্রকৃতিস্থ কি না, দেউলিয়া কি না, তিনি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দুই বছর বা ততোর্ধ্ব সময় কারাবাসের জন্য দণ্ডিত হওয়ার পর পাঁচ বছর সময় অতিবাহিত হয়েছে কি না, তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত আছেন কি না। এ ছাড়াও যেসব ব্যক্তি অতীতে সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তাদের অবসর বা চাকরি শেষ হওয়ার পর নির্ধারিত সময় পার হয়েছে কি না। যেসব ব্যক্তি কোনো নিবন্ধিত দলের না হয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান, তাদের দালিলিকভাবে প্রমাণ করতে হয় যে, এলাকার নির্ধারিত সংখ্যক ভোটার তার প্রতিদ্বন্দ্বিতার দাবি সমর্থন করেন।

রিটার্নিং কমিশনার হিসেবে সংশ্লিষ্ট ডিসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষ পূর্ণাঙ্গ কমিশনে আপিল করতে পারেন। কমিশনের আদেশে অসন্তুষ্ট পক্ষ কোনো কোনো অবস্থায় হাই কোর্টে রিট করতে পারেন, যদিও রিট করতে হলে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এর ওপর সরকারের কোনো তদারকি, খবরদারি, নিয়ন্ত্রণ বা আধিপত্য থাকে না। প্রধান এবং অন্য কমিশনারদের অপসারণের ক্ষমতা মহামান্য রাষ্ট্রপতিসহ কারও নেই। কোনো অভিযোগ থাকলে তাদের শুধু সেই পদ্ধতিতেই অপসারণ করা যায় যে পদ্ধতিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা অপসারণযোগ্য। এ পদ্ধতি মোটেও সহজ নয়।

তফসিল ঘোষণার পর যে দল এবং ব্যক্তি ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে জ্বালাও-পোড়াও, খুন-জখমের কথা প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা রয়েছে কঠোর হাতে তাদের দমন করা এবং বিচারের জন্য সোপর্দ করার। গোটা সময়টা পুলিশ, র‌্যাব, বিজেবি এবং এমনকি সেনাবাহিনীও কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকবেন বিধায় তারা কমিশনের নির্দেশে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ মানতে বাধ্য থাকেন। প্রয়োজনীয় পরিস্থিতিতে কমিশন সেনাবাহিনীও নামাতে পারেন।

এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশ প্রধান হাবিবুর রহমান এবং ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ দ্বিধাহীন ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, যারা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করবে, আইন প্রয়োগকারীরা তাদের সহায়তা করবে। কিন্তু যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মানুষের জীবন এবং সম্পদ রক্ষা করা আইন প্রয়োগকারীদের দায়িত্ব। তাই তারা যে ঘোষণা দিয়েছেন তার মধ্যে তাদের আইন অর্পিত দায়িত্ব পালনের প্রতিফলন রয়েছে। ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় ধর্মান্ধ চরমোনাই পীরের দল ঘোষণা দিয়েছিল তফসিল ঘোষণা হলে তারা নির্বাচন কমিশন আক্রমণ করবে। কিন্তু সেখানে প্রচুর সংখ্যক বিজেবি এবং পুলিশ মোতায়েন করায় তারা আর সে পথে অগ্রসর হওয়ার সাহস পায়নি।

আমাদের নির্বাচনে বিদেশি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানো কোনো দেশপ্রেমিকই সহ্য করতে পারে না, কারণ প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন, ভিয়েনা কনভেনশন, জাতিসংঘ সনদ বলছে প্রতিটি রাষ্ট্র সমানভাবে সার্বভৌম, যে কথা আন্তর্জাতিক আদালতও বলেছেন তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে হামলার বিষয়ে রায় প্রদানকালে। সেই নির্দেশনা যারা ভঙ্গ করছে, তাদের অপচেষ্টা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। এ কথাই সম্প্রতি ভারত সরকার স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে। ঢাকায় কর্মরত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কর্তৃক আমাদের নির্বাচনে নাক গলানো নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। অপচেষ্টার সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে তিনি মার্কিন এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ডোনাল্ড লুর চিঠি বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির কাছে হস্তান্তর করেছেন, যেটিও আমাদের ঘরোয়া ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানোর শামিল। আমাদের নির্বাচনে ডোনাল্ড লুর মাথাব্যথা থাকার কথা মেনে নেওয়া যায় না। প্রশ্ন উঠেছে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে নেওয়া যায় কি না। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপ করবেন। বেশ কিছু সময় থেকে বিএনপির সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ, নির্বাচন কমিশন এবং এমনকি মহামান্য রাষ্ট্রপতি। কিন্তু সে দলটি আলাপে রাজি নয়। আলাপে যারা রাজি নয়, তাদের তো আর জোর করে আলাপে বসানো যায় না। তারা চাইলে এখনো আলোচনায় বসতে পারে। যদিও হাতে সময় খুবই কম। বল এখন তাদের পালিয়ে থাকা নেতা তারেক জিয়ার হাতে। এটা কারও অজানা নয় যে, পলাতক তারেক জিয়ার কথা মতোই বিএনপি পরিচালিত। কিন্তু যেহেতু তিনি নিজে নির্বাচন করতে পারবেন না, তাই এ নির্বাচনে তার আগ্রহ নেই, আর তাই তিনি দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে অসাংবিধানিক পন্থা এবং বিদেশিদের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টায় লিপ্ত, যে পন্থা তার পিতা জিয়াউর রহমান অবলম্বন করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক সবারই কাম্য। কিন্তু সুসম্পর্ক রক্ষায় তাদের রাষ্ট্রদূতের আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী ভূমিকা অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ওয়াশিংটন গমন করেছেন। কারণ জানা না গেলেও আঁচ করা যাচ্ছে মার্কিন সরকার তাকে নতুন নির্দেশনা দেওয়ার জন্যই ডেকে পাঠিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার যদি ভারতের অনুসরণে তাকে নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশের ঘরোয়া ব্যাপারে নাক না গলাতে, তা হলে সেটি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের জন্য মঙ্গলকর হবে। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশও একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম সার্বভৌম নয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সেই আঠারো শতকে যুক্তরাষ্ট্র লর্ড সেকভিল নামক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে বহিষ্কার করেছিল। পরবর্তীতে দেশটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য বহু কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। বাংলাদেশও একই কারণে পাকিস্তানের এক উপ-রাষ্ট্রদূতসহ তিন কূটনীতিককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে বহিষ্কার করেছে।

আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে ভিয়েনা কনভেনশন, প্রতিটি দেশকে সে ক্ষমতা দিয়েছে। পিটার হাস তার সরকারের কাছ থেকে কী নির্দেশনা নিয়ে আসেন, সেদিকে সবাই তাকিয়ে থাকবেন। একইভাবে তাকিয়ে থাকবেন এটি দেখার জন্য যে, অবশেষে বিএনপির শুভবুদ্ধির উদয় হয় কি না। বিএনপি নির্বাচনে না এলেও জাতীয় পার্টির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দলসহ অন্যান্য দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে, তেমন কোনো সংকট দেখা দেবে না। তবে যে কোনো অবস্থায় বিএনপি এবং অন্যান্য ধর্ম ব্যবসায়ী দলগুলোকে আইন মেনে চলতে হবে, নয়তো জনগণ আইন প্রয়োগকারীদের দিকে তাকিয়ে থাকবে তাদের ব্যক্তিগত এবং সম্পদের নিরাপত্তার জন্য। ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় সম্প্রতি বেশ কিছু উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সিসিটিভি বসানো হয়েছে বিধায় ত্রাস সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারে সোপর্দ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

বিএনপি যে ২৮ অক্টোবর নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য দায়ী, প্রেস ক্লাবের সেক্রেটারি শ্যামল দত্তের কাছে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বক্তব্যই তা নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণ করে। বিএনপি এবং ধর্মান্ধ দলগুলোর কোনো অবস্থায়ই ভাবা উচিত নয় যে, তারা জ্বালাও-পোড়াওসহ অন্যান্য অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে। সুতরাং সাধু সাবধান।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর