শনিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের কৃষিযন্ত্রের বাজার : সমস্যা ও সম্ভাবনা

শাইখ সিরাজ

বাংলাদেশের কৃষিযন্ত্রের বাজার : সমস্যা ও সম্ভাবনা

দুটি বড় চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে পারলে আজকের দিনে কৃষি বেশ লাভজনক। চ্যালেঞ্জ দুটির একটি হচ্ছে- ‘জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত’ আর দ্বিতীয়টি ‘কৃষি শ্রমিকের সংকট’। এ দুটি চ্যালেঞ্জকেই অতিক্রম করতে প্রয়োজন কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, তথা কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার। অথচ কৃষি যান্ত্রিকীকরণে আমাদের দেশ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পেছনের সারিতে। তারপরও যেটুকু যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে, সিংহভাগই আমদানিনির্ভর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বিভিন্ন সূত্র বলছে, বাংলাদেশে কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের বার্ষিক বাজার প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। যার প্রায় পুরোটাই বিদেশিদের দখলে। ফলে যন্ত্রপাতি আমদানি বাবদ বড় অঙ্কের টাকা চলে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলোর হাতে। স্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্বল্প পরিসরে ছোট ছোট কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করছে।

গত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে চীনের আন্তর্জাতিক কৃষি যন্ত্রপাতি মেলায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়। ২০১৬-২০১৭ সাল থেকে প্রায় প্রতি বছরই আমি চীনের এ মেলায় যাই এশিয়া ও বিশ্বকৃষির স্বরূপটা বোঝার জন্য। বৃহৎ কৃষিযন্ত্রের পাশাপাশি ক্ষুদ্রকৃষি যন্ত্রপাতিও ছিল এবারকার মেলার মূল কেন্দ্রে। চীনে যন্ত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন তাদের বাণিজ্য পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়েছে, কুটিরশিল্পের মতো অনেক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানও নিজেদের মতো করে অনেক চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর যন্ত্র উৎপাদন করে চলেছে। বলে রাখি, চীনের কোনো কোনো প্রদেশ রয়েছে যেখানে কৃষির জমি আমাদের মতো খণ্ড খণ্ড। তারা সেসব ক্ষুদ্র কৃষির কথা মাথায় রেখে যন্ত্রপাতি যেমন তৈরি করে, তেমনি বাংলাদেশের মতো এশিয়ার যে দেশগুলোতে ক্ষুদ্র কৃষকের সংখ্যা বেশি তাদের কথাও চিন্তা করে বিস্তৃত করছে ক্ষুদ্র কৃষি যন্ত্রপাতির বাজার। এবার মেলায় ক্ষুদ্র কৃষি যন্ত্রপাতির প্রতি আমার বিশেষ খেয়াল ছিল। কারণ প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশের কৃষি খাত টিকিয়ে রেখেছেন প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় পরিবারগুলো ক্রমেই ভেঙে যাচ্ছে, ফলে বড় ও মাঝারি শ্রেণির কৃষক পরিবারগুলো পরিণত হচ্ছে ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ বছরে বড় ও মাঝারি শ্রেণির কৃষক পরিবারের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। দেশের কৃষক পরিবারগুলোর মধ্যে ৯১ দশমিক ৭ শতাংশই ক্ষুদ্র কৃষক পরিবার। পরিবারের মতো কৃষিজমিও খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়ায় এ দেশে বড় কৃষিযন্ত্র ব্যবহার কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে নতুন প্রজন্ম কৃষিবিমুখ এবং শহরমুখী হওয়ায় গ্রামে কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আমাদের মতো দেশে ক্ষুদ্র কৃষিযন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে।

আবার গত কয়েক দশকে বেড়েছে কৃষিবৈচিত্র্য। বেড়েছে নতুন নতুন ফসলের চাষ। চীনের কৃষি যন্ত্রপাতি মেলায় রকমারি ফসলের বাহারি সব যন্ত্র। ঘুরে ঘুরে মানুষ নিজের প্রয়োজনীয় যন্ত্রটি খুঁজে নিচ্ছে। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে দেখা মেলে অনেক বাংলাদেশি উদ্যোক্তার সঙ্গে। তাদের একজন চুয়াডাঙ্গার জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. ওলি উল্লাহ। অতি সাধারণ একজন লোক। কিন্তু অসাধারণ তার উদ্যোগ। নিজের অদম্য চেষ্টায় তিনি দাঁড় করিয়েছেন তার কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। চীনের বিশাল মেলায় ওলি উল্লাহ বাজারের একটা থলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার সাক্ষাৎ পেয়ে জানতে চাইলাম, ‘ভাই, থলের মাঝে কী?’ উত্তর দিলেন, মুগ ডাল। বিস্মিত হলাম, কৌতূহল জন্মাল। এত বড় একটা যন্ত্রপাতির মেলায় ছোট বাজারের ব্যাগে করে কেজিখানিক মুগডাল নিয়ে ওলি উল্লাহ কী খুঁজছেন? কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। তারপরও তার কাছ থেকেই জানতে চাই, মুগডাল কেন? বললেন, ‘আপনার একটা অনুষ্ঠানে দেখলাম বরিশালে প্রচুর মুগডাল হয়, কিন্তু ভাঙানোর জটিলতার কারণে কৃষক দাম পায় না। চীনারা তো বহু যন্ত্রপাতি বানায়। দেখি মুগডাল ভাঙানোর ছোট কোনো যন্ত্র পাওয়া যায় কি না। এরা তো ওদের ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা বোঝে না, তাই সহজে বোঝাতে ডালই নিয়ে আসছি।’ ডাল ভাঙার মেশিন খুঁজতে আমিও সাথী হলাম ওলি উল্লাহর। অনেক খোঁজাখুঁজি শেষে সত্যিকার অর্থেই একটা প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেল, যারা মুগডাল ভাঙানোর ক্ষুদ্র মেশিন তৈরি করেন। তবে মেলার যে জায়গায় তাদের স্টল সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার মতো সুবিধা নেই বলে হাতে-কলমে দেখতে পারলাম না। কিন্তু ওলি উল্লাহ সাহেব রয়ে গেলেন। বোঝা গেল তিনি এর শেষ না দেখে ছাড়বেন না।

একটা স্টলে বাংলাদেশের অনেক উদ্যোক্তার দেখা পেলাম। সবার সঙ্গে বসে গেলাম। চীনে বসে চীনাদের মেলায় এক টুকরো বাংলাদেশ বানিয়ে মেতে উঠলাম আড্ডায়। আলিম মেশিনারিজের আলিমুল এহসান চৌধুরী, অ্যাগ্রো মেশিনারিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শেখ সাদীসহ বেশ কয়েকজন। আড্ডার বিষয় বাংলাদেশে দেশীয়ভাবে কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরিতে কী কী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

জানা গেল দেশীয় উৎপাদকরা নানা সংকটের ভিতর আছেন। তাদের জন্য সরকারি সহায়তা তেমন নেই। সরকার মাড়াই মেশিনে ভর্তুকি তুলে দিচ্ছে। ভর্তুকি যেসব যন্ত্রে সেসব যন্ত্র শতভাগ আমদানিনির্ভর। ফলে বিকাশমান এ শিল্প অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে। তাই তারা কৃষিযন্ত্র তৈরিতে ভর্তুকি চান।

এ জন্য একটি নীতিমালা তৈরির দাবিও তাদের রয়েছে। এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা, প্রচলিত ঋণের সুদহার কমানো ও দেশেই যেসব যন্ত্র উৎপাদন করা সম্ভব, সেগুলো আমদানি বন্ধ করার দাবিও জানান তারা।

আলিমুল এহসান চৌধুরী বলেন, বেসরকারি পর্যায়ে ছোট-বড় মিলে দেশে প্রায় ৭০টি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে কৃষিযন্ত্র তৈরি ও সংযোজনের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে মাঝারি ও বড় কারখানা ১০ থেকে ১২টি। কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের জন্যও বর্তমানে মুনাফার ওপর কর দিতে হয়। করের হার কমাতে হবে। এ খাতে সুদমুক্ত দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করা উচিত। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি তৈরির কর্মীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। সে জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। চীন সরকার সুপরিকল্পিত নীতিমালায় কৃষিযন্ত্র উদ্ভাবন ও বাজারজাতকরণকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে কাক্সিক্ষত দূরত্বে। আমাদেরও তেমন উদ্যোগ নিতে হবে।

আমাদের বেশ কিছু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আছে কৃষি প্রকৌশলবিষয়ক ইনস্টিটিউট ও কলেজ। প্রতি বছর সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা শেষ করে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বের হয়ে আসছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন জাগে, তারা কোথায়? তাদের কি আমরা কাজে লাগাতে পারছি না? নাকি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি আছে! চীনে কুটিরশিল্পের মতো গড়ে উঠেছে কৃষিযন্ত্র তৈরির প্রতিষ্ঠান। সরকার তাদের নীতিগত সহায়তার পাশাপাশি করছে প্রাথমিক বিনিয়োগ। ফলে নতুন নতুন মেশিন যেমন উৎপাদনে তারা আগ্রহী হয়ে উঠছে, সেই মেশিন বিদেশে বিক্রি করে আয় করছে বৈদেশিক মুদ্রা। আগামীর কথা ভেবে আমাদেরও এমন উদ্যোগী হতে হবে।

আগামীর অর্থনীতি বিকশিত হবে কৃষি শিল্পকে ভিত্তি করে। উন্নত দেশগুলো সে সত্যকে উপলব্ধিতে এনে যথাযথ নীতিকৌশল অবলম্বনে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। বিস্তৃত করছে কৃষি বাণিজ্যের নানান বাজার। কৃষিপণ্যের পাশাপাশি কৃষিযন্ত্র ও প্রযুক্তি রপ্তানি করে আয় করছে বৈদেশিক মুদ্রা। এ ক্ষেত্রে আমাদের তেমন অগ্রসরতা নেই। অন্য দেশগুলো যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত ডিজিটাল প্রযুক্তির কৃষি নিয়ে ভাবছে জোরেশোরে, সেখানে আমরা কৃষির সর্বস্তরে যন্ত্রের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি। আশার কথা, কৃষিতে নতুন দিন আসছে। প্রযুক্তির কৃষিতে বাড়ছে বিনিয়োগ। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কৃষি যন্ত্রপাতির খাতকে সম্ভাবনাময় করে তোলার এখনই সময়।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর