শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধ ও ঢাকা ক্লাব এক সূত্রে গাঁথা

হোসেন আবদুল মান্নান

মুক্তিযুদ্ধ ও ঢাকা ক্লাব এক সূত্রে গাঁথা

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গোড়াপত্তন ও ইতিহাস নিয়ে গবেষকগণ নানাবিধ মতামত উপস্থাপন করেছেন। বলা হয়, ঢাকার অন্তত ৪০০ বছর পেছনের ইতিহাস আছে। বাস্তবে এর প্রাচীন তথ্য ও নিদর্শনসমূহ সামনে তুলে আনা কঠিন কাজ হবে। ধরা যাক, ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের আগমন, এদের স্থায়ীভাবে বসবাস, কোম্পানির শাসন চালুকরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, পাশ্চাত্য রীতিনীতির প্রচলন, তাদের সংস্কৃতি, ভাষার ব্যবহার এসব থেকেই আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাসের একটা বাঁক বদল বা পরিবর্তন ঘটে। বাণিজ্যিক সন্ধান ও সম্ভাবনায় এ দেশে একদিন ব্রিটিশ, ডাচ, ওলন্দাজ ও আরবদের আগমন ঘটে। স্বদেশ স্বজাতি ছেড়ে বিভূঁইয়ে এসে এসব বেনিয়ার জীবন যখন কাষ্ঠসম রসকষহীন হয়ে ওঠে, তখনই শ্বেতাঙ্গ শাসকরা ভারতের নানা স্থানে গড়ে তোলে বিচিত্র সব বিনোদন কেন্দ্র, গল্প-আড্ডা, শারীরিক কসরত, ঘোড়দৌড়ের উন্মুক্ত ময়দান। তাদের জন্য অন্তত কার্ড এবং বিলিয়ার্ডের টেবিল সজ্জিত থাকা চাই। মূলত এমন ধারণা থেকেই পৃথিবীর দেশে দেশে ব্রিটিশ শাসিত ও এদের করতলগত উপনিবেশগুলোতে আইসিএস শাসকদের জন্য নিত্য সান্ধ্যকালীন ক্লাবের সোঁদাগন্ধ বা সুরাপানের সংরক্ষিত এলাকা গড়ে ওঠে। আজকের ঢাকা ক্লাবও এর ব্যতিক্রম নয়। উল্লেখ্য, ১৮৫৭ সালের পরে কোম্পানি-উত্তর উপনিবেশিক শাসন শুরু হলে ভারতীয়রা ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে আসতে শুরু করেন এবং কালের বিবর্তনে ক্লাবগুলোও ধীরে ধীরে সর্ব শ্বেতাঙ্গমুক্ত হয়। নেটিভদেরও প্রবেশাধিকার হতে থাকে এবং রাজকর্মচারীসহ স্থানীয় এলিটদের ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে পরিগণিত হয়। সব ক্যাটাগরিতে বর্তমানে ক্লাবের সদস্য সংখ্যা ৪ হাজার ৬৭৮ জন।

২. বর্তমান স্থানটিতে ঢাকা ক্লাব গড়ে ওঠার পেছনে নবাবদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ঢাকার নবাব পরিবারই ছিল এ দেশের সবচেয়ে বড় মুসলিম পরিবার। তাঁদের বিশাল ভূসম্পত্তিতে স্থাপিত হয় ‘শাহবাগ’ বা বাগানবাড়ি, রমনার সবুজ নিসর্গ এবং আবদুল গনি রোডসহ ইডেন বিল্ডিং বা আজকের সচিবালয় ইত্যাদি এলাকা। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬ সালের মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, নবাব স্যার সলিমুল্লাহর রাজনৈতিক উত্থান, ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ, ১৯২১ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ১৮৯০ সাল থেকে চলে আসা পুরান ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্ক-সংলগ্ন থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এসে একটা পূর্ণাঙ্গ নিবন্ধিত ক্লাব হিসেবে ১৯১১ সালেই এর যাত্রা শুরু হয়। তৎকালীন আইসিএস, Sir Lancelot Hare, KCSI, C.I.E. কর্তৃক এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। অবশ্য রমনা এলাকার নকশা প্রণয়নের কাজ মুঘলদের তত্ত্বাবধানেই বিকশিত হয়েছিল। মুঘল সুবাদার ও সেনাপতিদের নিবিড় পরিচর্যায় রমনাপার্ক হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। তবে কথিত আছে, ১৯০২ সাল থেকে ব্রিটিশ নগরবিদরা ২০ বছর ধরে পরিকল্পনামাফিক কাজ করে রমনাকে আজকের আদলে নিয়ে আসেন। তবে রমনাপার্কের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় দেশভাগের পরে ১৯৪৯ সালে। আর রমনার এমন অভূতপূর্ব নৈসর্গিক ছায়ার তলে গা-ঘেঁষেই বিরাট জায়গা নিয়ে ক্লাবটি গড়ে ওঠে। তথ্য মতে, শুরুতে ক্লাবটি ৫২৪ বিঘা জমি ইজারা পেয়েছিল। কালক্রমে ক্লাবের জমিতেই শেরাটন হোটেল, বেতার ভবন, বারডেম, বিরাট উদ্যান সবই একে একে প্রতিষ্ঠা পায়। বর্তমানে ক্লাবের হাতে পাঁচ একরের মতো জমি রয়েছে বলে জানা যায়।

৩. এ কথা সত্য, স্মরণাতীত সময় থেকে ঢাকার মানুষের কৌতূহলের কোনো ইয়ত্তা নেই। এ জাতীয় ক্লাবগুলোতে আসলে কী হয়? নেতিবাচক ধারণা যে নেই তা-ও নয়। সাধারণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত থাকায় এমন প্রশ্ন পথচারীদের মাথায় ঘুরপাক খায়। এটা অমূলক কিছু নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিককার ছাত্র ও শিক্ষক, রবীন্দ্র-উত্তরকালের অন্যতম সেরা প্রতিভাবান কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসুও তাঁর স্মৃতিতে ঢাকা ক্লাবে সর্বসাধারণের নিষেধাজ্ঞা ও ঔৎসুক্যের কথা উল্লেখ করেছেন।

নিজের অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে, আশির দশকের প্রায় পুরো সময়টা (১৯৮০-৮৮) আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে থেকে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলাম। মিছিল, মিটিং, পিকেটিং, গলা ফুলিয়ে স্লোগান সবই করেছি। হাজারো বার এ পথ প্রদক্ষিণ করলেও অপেক্ষাকৃত ঢালু বাম পাশটার অন্তরালের নৈশভুবন নিয়ে একবারও ভাবিনি। তবে কখনো কখনো টেনিস কমপ্লেক্সের গ্যালারি পর্যন্ত গিয়েছি। যদিও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসনের সদস্য হিসেবে দুয়েকজন জ্যেষ্ঠ সহকর্মীর সাক্ষাৎ পেতে শঙ্কিত পায়ে এর অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলাম।

৪. ক্লাব মানে কেবল মদ্যপান বা গেমলিং নয়। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা ক্লাবে মুখরোচক খাবার, পানীয়, নাশতা, বেকারি, ছোট্ট ক্লাব বাজার, লন্ড্রি, সেলুন, ফিটনেস সেন্টার, খেলাধুলা, ব্যায়ামাগার, সুইমিং, মসজিদ, গেস্টহাউস সুবিধাসহ সদস্য তথা পারিবারিক সদস্যেরও চিত্তবিনোদনের নানাবিধ আয়োজন রয়েছে। একটা আধুনিক ও ঐতিহাসিক এলিট শ্রেণির ক্লাবের উপযোগী প্রায় সব উপকরণই এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। নার্সিংসহ সার্বক্ষণিক মেডিকেল অফিসার নিয়োগ, হাইপারটেনশন, ব্লাডগ্রুপ, ব্লাডসুগার চেকআপসহ প্রবীণ সদস্যদের জন্য রয়েছে অতিরিক্ত কিছু সুযোগ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা। ক্লাবে ওয়েলনেস সেন্টার, সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য পার্টি সেন্টার, বারবিকিউ, শিশু কর্নারসহ সবই রয়েছে।

৫. ঢাকা ক্লাবে রয়েছে এক সুবিশাল বিস্তৃত লাইব্রেরি। হাজার হাজার বিরল বইয়ের সমাহার। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত এমন দুষ্প্রাপ্য পুরনো মুদ্রিত অসংখ্য বাংলা-ইংরেজি পুস্তক রয়েছে এখানে। বর্তমানে প্রায় ১৮ হাজার নতুন-পুরনো বইয়ের সংগ্রহ ও প্রতিদিনকার প্রায় সব দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, দেশি-বিদেশি ম্যাগাজিনসহ কয়েক হাজার বর্গফুটের এক মেগা লাইব্রেরি আছে। সঙ্গে অসাধারণ নান্দনিকতার স্পর্শ দিয়ে সাজানো হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ ও স্বাধীনতা জাদুঘর। লাইব্রেরিটি শুরুতে মূল ভবনের পদ্মা লাউঞ্জে অবস্থিত ছিল। বিগত ২০২২ সালের ৬ জুলাই তারিখে স্থানান্তরিত হয়ে স্যামসন এইচ চৌধুরী ভবনের নিচতলায় আসে। লাইব্রেরি ইনচার্জ রিয়াজ আহমেদ জানান, এই সংগ্রহের একটা বিরাট অংশ এসেছে, লেখক, গবেষক ও ক্লাব সদস্যদের কাছ থেকে। অতীতে এ ক্লাবের সঙ্গে নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে অনেক কিংবদন্তি ছিলেন। যাঁরা বাঙালির ভাষা তথা শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যুগে যুগে তাঁরাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজের লেখা গ্রন্থের সৌজন্য সংখ্যা ক্লাবকে দান করে সমৃদ্ধ করেছেন। এসব বরেণ্য লেখক ও সদস্য অনেকে আজ পৃথিবীতে বেঁচে নেই কিন্তু বইগুলো অক্ষয় অনন্ত সুস্থতা নিয়ে আজও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, গত দুই বছরে প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার কোনো না কোনো লাইব্রেরিতে বসে আমার অনেকটা নিবিষ্ট সময় কেটেছে। বিশেষ করে পাঠক সমাবেশ কেন্দ্র, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বাতিঘর, বাংলা একাডেমি লাইব্রেরি, এশিয়াটিক সোসাইটি লাইব্রেরি, বেঙ্গল বইঘর, শিল্পকলা একাডেমি লাইব্রেরি ইত্যাদির সংস্পর্শে বারবার গিয়েছি। বইয়ের সংগ্রহ, বিন্যাস এবং কোয়ালিটি পরখ করে দেখার চেষ্টা করেছি। তবে পড়াশোনা বা গভীর অভিনিবেশ নিয়ে সৃষ্টিশীল কিছু করার জন্য ঢাকা ক্লাবের লাইব্রেরির তুলনায় অন্যসব ধারে-কাছেও নেই। বলাবাহুল্য, সংরক্ষিত এলাকা বলে এ লাইব্রেরির পাঠক সংখ্যা খুবই সীমিত। কিছু অবসরপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষিত বয়োবৃদ্ধ, অশীতিপর সদস্যই এর নিয়মিত পাঠক। দেশের প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যেক, গবেষক ও লেখকগণ তাঁদের বই প্রেরণ করে একে আরও সমৃদ্ধ করার আহ্বান থাকল।

৬. ২০১১ সালে ঢাকা ক্লাবের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে প্রকাশিত Dhaka Club Centennial স্মারক গ্রন্থে দেখা যায়, ১৯৩১-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ক্লাব প্রেসিডেন্টগণের নামের তালিকা রয়েছে। এঁদের সবাই ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় আইসিএস। পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে ক্লাব প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেশ কজন বিচারপতির নাম এবং দেশের অতি অভিজাত শ্রেণির সদস্যের নাম দেখা যায়। স্বাধীন বাংলাদেশেও তদানীন্তন সিএসপি অফিসার, বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং স্বনামধন্য শিল্পপতি বা প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ীদের নামই শোভা পাচ্ছে। বলা যায়, ঢাকা ক্লাব ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা নিয়ে আজও বহমান। তবে সুদূর পেছনে তাকালে ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব জ্ঞানী, গুণী ও ধ্রুবতারার মুখ দেখতে পাওয়া যায়, মনে হয় তাঁরা প্রত্যেকই ছিলেন এক একটি প্রতিষ্ঠানতুল্য মানুষ।

৭. ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ঢাকা ক্লাব যেন একসূত্রে গাঁথা। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন ক্লাবের সাবেক সম্মানিত প্রেসিডেন্ট আবদুল আহাদসহ একাধিক কর্মচারী। তবে ঢাকা ক্লাব যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে, অবিচ্ছেদ্য গল্পে ভাস্বর হয়ে আছে তা হলো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে রেসকোর্স মাঠে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পশ্চিম পাকিস্তানের ৯৩ হাজার হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিল। জনশ্রুতি নয়, বাস্তবতা হলো, যে ছোট্ট টেবিলের ওপর হাত রেখে লে. জে. আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি এবং মিত্রবাহিনীর প্রধান লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা স্বাক্ষর করেন, সে মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী টেবিলটি পার্শ্ববর্তী ঢাকা ক্লাব থেকে নেওয়া হয়েছিল। মূল টেবিলটি এখন জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। ক্লাবের বঙ্গবন্ধু কর্নারে এর চমৎকার একটা রেপ্লিকা স্থাপিত আছে। অর্ধশতাব্দীর অধিককাল পরেও আজকের বিজয়ের মাসে আমরা আরেকবার স্মরণ করতে পারি, বাঙালির সেই স্মৃতিময় ও গীতিময় পর্বটাকে।

লেখক : গল্পকার, কলামিস্ট এবং ক্লাবের একজন সাম্মানিক সদস্য

সর্বশেষ খবর