৮ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনাড়ম্বরভাবে নিজ নির্বাচনি এলাকা এবং জাতির জনকের সমাধিস্থল টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন। এ দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসেন তিনি। ২১ নভেম্বর সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব চ্যানেল আইয়ের সাগর ভাই ও শাইখ সিরাজ ভাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হেঁটে হেঁটে উপস্থিত সবার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় আমাদের সামনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। সাগর ভাইয়ের শরীরের খবর নিলেন এবং পায়ে ব্যথা নিয়ে কেন দাঁড়িয়ে আছে-জিজ্ঞেস করলেন। নিরাপত্তারক্ষী ও সেনা কর্মকর্তাদের বললেন ব্যারিকেডের ওপারে তাকে ভিভিআইপি শামিয়ানার নিচে আয়োজিত সোফায় বসার ব্যবস্থা করতে। আর শাইখ সিরাজ ভাইকে বললেন গোপালগঞ্জ ও বাগেরহাটে তার জমিতে তারই তত্ত্বাবধানে বোনা ফসলের মাঠ দেখে আসতে। সাগর ভাই অভিযোগ দিলেন, তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত খামারে উৎপাদিত ধানের চাল, মুড়ি, চিড়া কিংবা দেশি মুরগির ডিম কিছুই পাননি। প্রধানমন্ত্রী হেসে শাইখ সিরাজ ভাইকে দেখিয়ে বললেন, ওই তো সব নিয়ে আসছে, ওকে জিজ্ঞেস করো তোমার ভাগ গেল কই? মাটি ও মানুষের সঙ্গে এমন সম্পর্ক থাকা প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে এ ঘটনার ১৭ দিন পর (৮ ডিসেম্বর) গোপালগঞ্জে উচ্চারিত হলো দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা। টুঙ্গিপাড়ার কোটালীপাড়ায় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, বিএনপি ‘মার্চের দিকে দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটাবে। এটা হচ্ছে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা। শুধু দেশের নয়, বাইরের দেশেরও পরিকল্পনা। যেভাবেই হোক দুর্ভিক্ষ ঘটাতে হবে।’
দুর্ভিক্ষ শব্দটির সঙ্গে পরিচয় আমার কৈশোরে। ১৯৭৪ সাল। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার জন্য শূন্য হাতে নতুন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিন্তু দেশের তথাকথিত বাম শক্তি একদিকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অরাজকতা শুরু করে দেয়, অন্যদিকে তাদের মিডিয়া তথা বেশকিছু দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা আংশিক সত্য ও মিথ্যা সংবাদের ভিত্তিতে দেশের সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে তোলে। আড়তদার, মজুদদার ও সিন্ডিকেটকারীরা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও চোরাচালান করে নাজুক পরিবেশ সৃষ্টি করে। এরই মাঝে এক খোঁড়া যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশমুখী এক জাহাজভর্তি খাদ্যপণ্য আসার পথ বন্ধ করে দেয়। ফলে দেশে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাসামগ্রী প্রভৃতির প্রবল সংকটের সঙ্গে খাদ্য সংকটের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। অভিশপ্ত সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে আজও শিউরে উঠতে হয়। আমার বাবা তখন মফস্বল শহরের এক সরকারি ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2023/12.%20December/22-12-2023/BD-Pratidin_2023-12-22-14.jpg)
বাংলাদেশ জলবায়ুজনিত ঝুঁকিতে থাকলেও এ দেশের অবস্থা অন্য বহু দেশের চেয়ে অনেক ভালো। এ দেশের মাটি পশ্চিমা দেশের মতো বরফে ঢেকেও যায় না, আবার মরুভূমির বালুর মতো উত্তপ্তও হয় না। সমুদ্র উপকূলীয় কিছু এলাকা বাদ দিলে লবণাক্ত জমিও তেমনটা নেই দেশের অন্য কোথাও। একটি বীজ মাটিতে পড়লেই এই মাটির আশীর্বাদে তা গাছ হয়ে জন্মে। আর মরুর দেশে দেখেছি একটি চারার জন্য বা গাছ বাঁচাতে ড্রেনের পানি জীবাণু ও দুর্গন্ধ মুক্ত করে পাইপ দিয়ে সারা দিন টিপ টিপ করে পড়ার ব্যবস্থা করতে হয়। সুতরাং কেবল বিরূপ জলবায়ুর কারণে এ দেশে দুর্ভিক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। অন্যদিকে, দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েন থাকলেও আফ্রিকার বহু দেশ, সিরিয়া কিংবা আফগানিস্তানের মতো তা সশস্ত্র সংঘাতের রূপ ধরেনি। গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়লেও রোহিঙ্গা বা ফিলিস্তিনিদের মতো শরণার্থী হয়নি কেউ। এ দেশের মানুষের খাদ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ও পুষ্টির মান বিশ্বের অনেক দেশের চেয়েও ভালো। এমনি এক প্রেক্ষাপটে মার্চে ঠিক কীভাবে দুর্ভিক্ষ ঘটানো সম্ভব- তা নিয়ে ভাবতে হবে।
এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকেই উচ্চারণ করেন একটি শক্তিধর দেশের নাম। এই দলভুক্তরা মনে করেন, অনেক দৌড়ঝাঁপ করা একটি দেশের দূতাবাস এবং সে দেশের রাষ্ট্রদূতের হঠাৎ নীরবতা কোনো বড় ঝড়ের পূর্বাভাস। আর এই ঝড় হতে পারে নির্বাচন, গণতন্ত্র, কিংবা মানবাধিকার প্রশ্নে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে নিষেধাজ্ঞা কিংবা শ্রমনীতি ও অন্যান্য ইস্যুর ভিত্তিতে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা। আরেকটি হতে পারে জাতিসংঘে প্রভাব খাটিয়ে শান্তিরক্ষা মিশন সংকুচিত করা বা বন্ধ করা। এ তিনটি পদক্ষেপের প্রত্যেকটি বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ সীমিত করা তথা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তথা দুর্ভিক্ষের পটভূমি তৈরি করতে সক্ষম। এ তিনটি অস্ত্র ব্যর্থ হলে যা হতে পারে, তার প্রতি অতি সম্প্রতি ইঙ্গিত করেছে মস্কো। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখের ব্রিফিং চলাকালে সেদেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও কূটনীতিবিদ মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, জনগণের ভোটের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সন্তোষজনক মনে না হলে আরব বসন্তের মতো করে বাংলাদেশকে আরও অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরব বসন্ত বলতে রাশিয়া ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছে- তা স্পষ্ট নয়। কারণ ২০১০-১১ সালে আরব অঞ্চলে তথা মধ্যপ্রাচ্যে ও উত্তর আফ্রিকার কিছু দেশে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে একেক ধরনের সরকারবিরোধী আন্দোলন, বিক্ষোভ ও সশস্ত্র সংঘাত হয়। সরকারের দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ায়। এর ১১ দিন পর ২৯ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে তা ছড়িয়ে পড়ে আলজেরিয়ায়। এভাবে মাত্র দুই মাসের মধ্যে (১৮ ডিসেম্বর ২০১০ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১) আরব বসন্ত নামে পরিচিত এরকম বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে আরও ২৭টি দেশে, যেখানে কোথাও রাজতন্ত্র, কোথাও স্বৈরতন্ত্র, কোথাও জরুরি অবস্থা, আবার কোথাও গণতন্ত্রের নামে দীর্ঘদিন ধরে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির বা দলের বা পরিবারের শাসন কায়েম ছিল। এ আন্দোলনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, ২৭ দিনের মধ্যে তিউনিসিয়ার শাসক বেন আলী সৌদি আরবে পালিয়ে যান, ১৩ দিনের মধ্যে আলজেরিয়ায় ১৯ বছর ধরে চলা জরুরি অবস্থার অবসান ঘটে, ১৮ দিনের মধ্যে মিসরের ৩০ বছরের শাসক ও রাষ্ট্রপতি হোসনি মোবারকের ক্ষমতাচ্যুতি হয়, এক মাসের মধ্যে ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি আলী আবদুল্লাহ সালেহ ক্ষমতা ছাড়েন এবং সিরিয়ায় পূর্ণমাত্রায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। অন্যান্য দেশেও শুদ্ধি অভিযানসহ নানা রকমের সংস্কার ও ভবিষ্যতে নিজে নির্বাচন না করার অঙ্গীকার দিতে বাধ্য হন আরব নেতা বা সরকারপ্রধানরা।
গবেষণায় দেখা যায়, এসব দেশের মধ্যে এমন বিপ্লব, সংঘাত, সংগ্রাম বা আন্দোলনের নেপথ্যে কোথাও সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক শক্তিশালী বাহিনী, কোথাও রাজনৈতিক শক্তি, কোথাও বিচ্ছিন্নতাবাদী, আবার কোথাও জঙ্গিগোষ্ঠীকে কাজে লাগায় আমেরিকা ও তার দেশীয় কুশীলবরা। আরব বসন্তের ফলে পট-পরিবর্তনের কল্যাণে অস্ত্র ব্যবসায়ী ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লাভবান হলেও তা গণতন্ত্র বা গণতন্ত্রকামীদের উন্নয়নে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং বিধ্বস্ত হয়েছে হাজারো জনপদ।
আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন আর রাশিয়া আরব বসন্তের কথা বলছে, তখন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাণ্ডারী হুশিয়ার কবিতা ও গানের কয়েকটি লাইন স্মরণ করছি- “গিরি-সঙ্কট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ, পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ! কাণ্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ? করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!”
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
Email: [email protected]