শিরোনাম
শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আশরাফুল মাখলুকাতের দায়িত্ব

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

আশরাফুল মাখলুকাতের দায়িত্ব

মানুষ আল্লাহপাকের সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। এ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি হলো, একে অন্যের প্রতি হিংসা না করা, অপর ভাইয়ের গিবত না করা, নিজেকে বড় মনে করে অপরকে ছোট মনে না করা। যে নিজেকে বড় মনে করে এবং অপরকে ছোট মনে করে, বুঝতে হবে তার মধ্যে অহংকার আছে। অন্তরে অহংকার সৃষ্টির বহু কারণের মধ্যে একটি হলো- অর্থসম্পদ। যার যত মাল বেশি তার মধ্যে অহংকার বেশি, তবে যারা হালাল পন্থায় মাল উপার্জন করে তাদের মধ্যে অহংকার কম। তাই উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল হারামের বাছ-বিচার করা খুবই জরুরি। হালাল মালের রিজিক পাওয়ার মতো বড় নেয়ামত আর নেই। এ কথা হাদিসে পাকেও বর্ণিত হয়েছে।

হারাম মাল উপার্জন ও দান : বর্তমান জমানায় হালাল মাল উপার্জন করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। যে কোনো পন্থায়ই সম্পদ উপার্জন করা হোক তা সম্পূর্ণরূপে হারামের মিশ্রণমুক্ত হতে পারছে না। আজ যারা হারাম পন্থায় উপার্জিত অর্থ দ্বারা দান-খয়রাত, কোরবানি ও হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত করছে তাদের এসব ইবাদত যে সমূলে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে সে খবর কি তাদের আছে? দুনিয়ার তুচ্ছ সম্পদ উপার্জনে মানুষ আজ দিশাহারা হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। কামানো আর জমানো; এটাই যেন এ জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। মৃত্যু-পরবর্তী প্রকৃত জীবনের ব্যাপারে কোনো ফিকির নেই।

মালের মহব্বতের অনিষ্টতা : বর্তমান যুগে দীনদার হওয়ার পথে বড় একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মালের মহব্বত। আমরা যারা ইমামতি, মুয়াজ্জিনি, শিক্ষকতা এবং দীনের অন্যান্য খেদমত করছি, সেগুলো করার পেছনে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়ার কথা ছিল আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি। কিন্তু তা না হয়ে হয়েছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত, অর্থাৎ আমরা আজ এসব দীনি খেদমতকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছি। যার দরুন আমাদের খেদমতের তাছির বা প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর প্রত্যাশিতভাবে পড়ছে না। আগের যুগের বুজুর্গরা এমন ছিলেন যে, তাঁদের পেছনে যদি কেউ নামাজ পড়ত তাহলে তার দিলের হালাত পরিবর্তন হয়ে যেত। এক বুজুর্গের জীবনীতে পাওয়া যায় যে, একবার তাঁর মুরিদরা তাঁকে খুব অনুনয়-বিনয়ের সঙ্গে ফজরের নামাজের ইমামতি করতে আবেদন করল। বহু আবেদন-নিবেদনের পর পীরসাহেব নামাজ পড়ানোর জন্য সামনে দাঁড়ালেন। আর মুরদিরাও খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে পেছনে দাঁড়াল। সবাই এখলাসের সঙ্গে পীরসাহেবের পেছনে দুই রাকাত নামাজ সম্পন্ন করল। পরে দেখা গেল যে, তাদের এখলাসের বরকতে আল্লাহর সঙ্গে তাদের নিসবত হাসিল হয়ে গেছে।

আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে নামাজ পড়াচ্ছি তারা কি চিন্তা করে দেখেছি যে, আমাদের মুসল্লিদের অবস্থা কী? আসলে আমাদের মুসল্লিদের অবস্থা পরিবর্তন কেমন করে হবে? আমাদের ইমামতির লক্ষ্যবস্তু তো হয়ে গেছে শুধু টাকা উপার্জন করা। যদি আমরা নিজেরা নিজেদের অবস্থা যাচাই করে দেখি তাহলে এ কথার সত্যতা পেয়ে যাব।

ইমাম আবু হানিফা ও নাপিতের ঘটনা : একটি সুন্দর ঘটনা মনে পড়ে গেল। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হজ করার পর মাথার চুল কর্তন করার জন্য নাপিতের কাছে গেল। বসার পর বললেন, হে নাপিত, তুমি আমার চুল কেটে দিলে বিনিময়ে তোমাকে কত দিরহাম দিতে হবে? নাপিত উত্তর দিল, হে আবু হানিফা! আপনার ওপর আমার আশ্চর্যবোধ হচ্ছে এজন্য যে, আপনার কি জানা নেই, ইবাদতের বিনিময় নেওয়া জায়েজ নেই? হজের পর চুল কাটা একটি ইবাদত এবং কেটে দেওয়াও ইবাদত বলে গণ্য হবে। অতএব কী করে আমি এর বিনিময় গ্রহণ করব? আমি তো এখানে বসেছি হাজিদের খেদমত করার লক্ষ্যে।

নববী দাওয়াতের বৈশিষ্ট্য : দুনিয়াতে যত নবী-রসুল এসেছিলেন তাঁদের দাওয়াতি মিশনের ক্ষেত্রে কথা একটাই ছিল যে, ‘দাওয়াতের বিনিময়ে তোমাদের কাছে আমরা কোনো বিনিময় চাই না। এর বিনিময় একমাত্র আল্লাহর কাছে চাই। আমরা তো তাঁর ওপরই ভরসা রাখি, আর সবাই তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’

নবীগণের এ কথা দ্বারা এটাই বোঝা যায় যে, ইমামতি, মুয়াজ্জিনি, তারাবি, খতমে কোরআন ইত্যাদির পর যতই মহব্বত-ভালোবাসা ও আন্তরিকতার সঙ্গে বিনিময় নেওয়া- দেওয়া হোক না কেন তা দীনের জন্য ক্ষতি ছাড়া লাভ হয় না।

হাদিয়ার হুকুম : তবে নবীরাও অনেক সময় হাদিয়া গ্রহণ করেছেন। সুতরাং আমরাও হাদিয়া নিতে পারি। আবু বকর (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিছু হাদিয়া দিয়েছিলেন, তিনি তা গ্রহণ করেন। এভাবে অন্য সাহাবিদের হাদিয়া গ্রহণ করার কথা হাদিসে পাওয়া যায়। আল্লাহপাক আমাদের দেশের আলেমদের হালাল সম্পদ উপার্জনের তৌফিক দান করুন!

দানের সওয়াব কখন পাওয়া যাবে? : বর্তমান সমাজের অনেকে হারাম টাকা উপার্জন করে চলছে, আর তা হতে সামান্য কিছু মসজিদ-মাদরাসায় দান করে। রাস্তাঘাটে অনেক সময় শুনতে পাওয়া যায় মাইকে বলে- ‘কত টাকা কত পয়সা অকারণে চলে যায়, আল্লাহর ঘরে দান করলে আখেরাতে পাওয়া যায়।’ এখন আমরা যদি হারাম মাল মসজিদ-মাদরাসায় দান করি তাহলে আখেরাতে সওয়াব পাব, না গুনাহ পাব? আখেরাতের শান্তি অর্জন করতে হলে হালাল মাল উপার্জন ও ভক্ষণ করতে হবে এবং হালাল মাল দান-খয়রাত করতে হবে। তবেই আখেরাতের জীবন হবে আনন্দময়।

ভালো কাজের সূচনা কোন দিক থেকে করতে হবে? : যাই হোক ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর চুল কাটার ঘটনা বলছিলাম। পূর্বোক্ত কথোপকথনের পর তিনি চুল কাটার জন্য বসলেন এবং নাপিতের দিকে প্রথমে মাথার বাম পাশ এগিয়ে দিলেন। নাপিতের কণ্ঠে আবারও অনুযোগ, হে আবু হানিফা! কী আশ্চর্য লাগে! একজন ইমাম হয়েও আপনি বাম দিক থেকে চুল কাটা আরম্ভ করতে বলছেন? আপনার কি জানা নেই যে, সব কাজ ডান দিক থেকে আরম্ভ করা সুন্নত? এখানেই শেষ নয়, নাপিতের দৃষ্টি এবার পড়ল ইমাম সাহেবের বসার সুরতের প্রতি। বলে উঠল, হে আবু হানিফা! কী ব্যাপার কেবলার দিকে মুখ না করে অন্যদিকে ফিরে বসেছেন যে? আল্লাহর রহমত সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয় বায়তুল্লাহ শরিফে। এরপর তা ডানে ও বামে তারপর মানুষের অন্তরে ছড়িয়ে পড়ে। হে আবু হানিফা! এখানে আগমন তো বায়তুল্লাহর বরকত নেওয়ার জন্য, যদি তা নিতে চান তাহলে সিনাকে কেবলার দিকে রাখুন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) নাপিতের একের পর এক অনুযোগ ও উপদেশ শ্রবণ করে ভীষণ আশ্চর্যান্বিত হলেন।

তিনটি সহজ সুন্নত : নাপিতের উপদেশকৃত সুন্নতের সঙ্গে আরও দুটি বিশেষ সুন্নত রয়েছে। ‘বাগানে থানভীর’ শেষ ফুল মুহিউস সুন্নাহ শাহ আবরারুল হক (রহ.) বলেন যে, তিনটি সুন্নতের ওপর আমল করতে পারলে অধিকাংশ সুন্নতের ওপর আমল সহজ হয়ে যায়।

সেগুলো হলো- ১. বেশি বেশি সালাম দেওয়া। আগে আগে সালাম দেওয়া এবং বিশুদ্ধভাবে সালাম দেওয়া।

২. প্রত্যেক ভালো কাজ ডান দিক থেকে শুরু করা এবং তুলনামূলক নিম্ন মর্যাদার কাজ বাম দিক থেকে শুরু করা।

একটি জরুরি জ্ঞাতব্য

এখানে একটি বিষয় জানা থাকা একান্ত প্রয়োজন যে, অনেকে দ্বিতীয় অংশকে এভাবে বলে, যে, ‘আর প্রতিটি মন্দ কাজ বাম দিক থেকে শুরু করা।’ এরূপ বলা ঠিক নয়। কারণ যে কাজ মন্দ হয় তা তো শরিয়ত করতেই অনুমতি দেয় না, সেখানে তা আরম্ভ করার নিয়ম শেখায় কী করে? যেমন ধরুন, মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় বাম পা আগে দেওয়া সুন্নত। তাহলে কি আমরা বলব যে, মসজিদ থেকে বের হওয়া একটি মন্দ কর্ম? কখনো না। কারণ, নামাজের পর মসজিদ থেকে বাইরে বের না হয়ে ভিতরে বসে থাকতে শরিয়ত নির্দেশ করেনি। বরং নামাজের পর পরিবারের জীবিকা সন্ধানে বের হওয়া কিংবা দাওয়াতের কাজে বের হওয়ার নির্দেশ রয়েছে। অতএব বের হওয়াটা মৌলিকভাবে মন্দ কাজ নয়। তবে মসজিদের জায়গার তুলনায় বাইরের জায়গা সম্মানের দিক দিয়ে নিম্ন স্তরের, তাই বাইরের মাটিতে পা রাখার কাজটাকে তুলনামূলক নিম্ন স্তরের বলা যায়। দ্বিতীয় নম্বরে এভাবেই বলা হয়েছে।

৩. সব সময় জিকিরের হালতে থাকা। উত্তম হলো ওপরে ওঠার সময় ‘আল্লাহু আকবার’ নিচে নামার সময় ‘সুবহানাল্লাহ’ এবং সমতল ভূমিতে চলার সময় ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর জিকির করা। একাধিক মানুষ একসঙ্গে থাকতে যদি কেউই আমল না করে তাহলে উত্তম হলো একজন স্মরণ করিয়ে দেবে। যে স্মরণ করিয়ে দেবে সে আমলকারীর সমান সওয়াব পাবে।

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর