বুধবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

শিলিগুড়ি করিডোর : পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সেতুবন্ধ

হর্ষবর্ধন শ্রিংলা

শিলিগুড়ি করিডোর : পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সেতুবন্ধ

বৈচিত্র্যে ভরা বিশাল দেশ ভারতকে বলা হয় ভারতীয় উপমহাদেশ। উপমহাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি এবং কখনো কখনো ভাগ্যের পরিক্রমায় অঙ্কিত হয়েছে আমাদের রাজনৈতিক সীমানা। এ একই নিয়ামক অঞ্চল বিশেষের ওপর রেখেছে বিশেষ প্রভাব। এ অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে সরু এক ভূখন্ড, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোকে যুক্ত করেছে পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে।

এ অঞ্চলগুলোর একটি অংশকে কোনো কোনো সময় ‘শিলিগুড়ি করিডোর’ বলে উল্লেখ করা হয়। এ শুধু ভারতের দুই অঞ্চলের মধ্যকার যোগসূত্রই নয়; এটি সেই ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক সংযোগস্থল যার সীমানা রয়েছে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গেও। এটা সেই করিডর, যা ভারতকে মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করেছে।

এর সামরিক তাৎপর্যও সুবিদিত। আয়তনে অত্যন্ত সরু হওয়ায় এ স্থানটি ঝুঁঁকিপূর্ণ, তাই সামরিক ভাষায় বলা হয় ‘মুরগি গলা’ (চিকেন নেক)। দেশের এ অঞ্চলটির সুরক্ষার ওপর ভারত অত্যন্ত জোর দিয়ে থাকে। সে জন্য এ অঞ্চলে সামরিক শক্তির সক্রিয়তা ও প্রসারণের ক্ষেত্রে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়, তেমনি দেওয়া হয় রসদ সরবরাহ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রেও।

ভারতের এ অংশটি ভৌগোলিকভাবে যুক্ত ভিন্ন চারটি দেশের সঙ্গে। তাই এ আন্তর্জাতিক সীমানা ও সংযোগ, এ অঞ্চলের মানুষের জন্যও খুলে দিচ্ছে সম্ভাবনার দুয়ার। ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এখানেই একসূত্রে সংবদ্ধ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দুই নীতি ‘পড়শি প্রথম’ ও ‘সক্রিয় পূর্ব এশিয়া’। দক্ষিণ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের দেশগুলোর সঙ্গে বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ও সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশনভুক্ত দেশগুলোকে (বিমসটেক) যুক্ত করেছে এ অঞ্চল। সুতরাং বলা যায় এখানেই শুরু ইন্দো-প্যাসিফিকের!

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে নতুন রূপদান করতে চাচ্ছেন, সেদিক থেকে বিবেচনা করলেও দেশের এ অংশটির অবস্থান অনন্য। তাঁর সেই প্রচেষ্টাগুলো সবার সামনে দৃশ্যমান, যার মধ্যে রয়েছে অবকাঠামোগত চমৎকার উন্নয়ন, হোক সেটা সেতু, সড়কপথ, রেলপথ, আকাশপথের যাত্রার উন্নয়ন বা অন্য কিছু। আর উন্নত আর্থ-সামাজিক কার্যকলাপের ফলাফল হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি, চিকিৎসা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়া এবং সামাজিক মূলধনের সম্প্রসারণ সেই প্রচেষ্টাগুলোকে দৃশ্যমান করে রেখেছে।

এ এলাকা এখন এমন একটি অবস্থানে যেখান থেকে এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাসমূহের যোগসূত্র হিসেবে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন- শিলিগুড়িতেই ভারতের ‘সোনালি চতুর্ভুজ’-এর ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক ও ভবিষ্যতে বিমসটেকে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর ভূখন্ডকে সংযোগের প্রচেষ্টার সঙ্গে।

শিলিগুড়ি-বাগডোগরা এলাকা বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালানোর উপযুক্ত এলাকা। নেপাল-ভুটান সীমানার কাছে অবস্থিত এর কৌশলগত অবস্থান জোরদার করবে আন্তসীমান্ত বাণিজ্য। আর এর উর্বর সমতলভূমি বেগবান করবে কৃষিক্ষেত্রকে। দক্ষ ও সুনিপুণ কারিগররা অবদান রাখবে হস্তশিল্প খাতের সম্প্রসারণে এবং এর শিক্ষা খাত থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরবরাহ করা হবে মেধাবী জনশক্তির। তার ওপর তিস্তা নদীর অবস্থানের কারণে এ অঞ্চলে প্রচুর জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা। এ ছাড়া বাগডোগরায় বিমানবন্দর থাকায় সুবিধাজনক যোগাযোগ গড়ে তোলা যাবে।

সীমান্ত ও শুল্ক অবকাঠামো থাকায় বাংলাদেশের সঙ্গে এ এলাকার সড়ক ও রেল যোগাযোগ বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। এতে মানুষ ও পণ্যের চলাচল এবং পরিবহনের অর্থনৈতিক সুবিধা সূচিত হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনে শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত উচ্চগতির ডিজেল প্রবাহ কার্যকর। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনা পাইপলাইনের উদ্বোধন করেছেন। এ এলাকার ভৌগোলিক বিশেষত্ব কীভাবে দারুণ এক সম্পদ হিসেবে কাজ করছে, এটি হলো তার চমৎকার উদাহরণ।

ভারত ও বাংলাদেশ এবং নেপাল ও ভুটানের ভিতর যোগাযোগে আরও উন্নতি সম্ভব। এ যোগাযোগ অবশ্যই হয়ে থাকে শিলিগুড়ি এবং এর সন্নিকটবর্তী দার্জিলিং বা এর কাছাকাছি এলাকা দিয়ে। এতে পরিবহন অর্থনীতির একটি কেন্দ্র ও ট্রান্সশিপমেন্ট পয়েন্ট হয়ে ওঠার সম্ভাবনা জোরদার হয়েছে এ এলাকার। আর এটা তো নিশ্চিত যে যোগাযোগের সুবিধাই হচ্ছে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তি। 

দার্জিলিং বরাবরই শিক্ষার এক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। এখানের স্কুল এবং কলেজগুলোর ভারত এবং এর পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে দারুণ খ্যাতি রয়েছে। এ সুযোগ-সুবিধাকে এই দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য একটি শিক্ষাগত, প্রশিক্ষণগত এবং দক্ষতার কেন্দ্র তৈরি করতে কাজে লাগানো যেতে পারে।

ভারতের চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়ছে। ২০১৪ সালে ভারতে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ছিল ৩৮৭, যা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কৃতিত্বে বর্তমানে ৬৫৪-তে উন্নীত। পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে আমার মেয়াদকালে, কভিড-১৯-এর সময় ভারতীয় ভ্যাকসিন, ওষুধপণ্য এবং চিকিৎসা সুবিধা বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাঁর নেতৃত্বে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমি নিশ্চিত যে, ভারত থেকে বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভুটানে চিকিৎসা পরিষেবার সম্পূর্ণ স্পেকট্রামের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষাগত এবং চিকিৎসা সুবিধা প্রায়শই একসঙ্গে কামনা করা হয় এবং এ অঞ্চলের জন্য একটি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসেবে শিলিগুড়ি এবং দার্জিলিংয়ের গড়ে ওঠারও দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে।

এ প্রক্রিয়ায় অবদান রাখবে বাগডোগরা বিমানবন্দর আধুনিকায়নে এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়া গৃহীত প্রকল্প। একটি উন্নত বিমানবন্দরের উপস্থিতিতে, ডুয়ার্স এবং হিমালয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ, তাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মিশেল পর্যটনশিল্পে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত এবং সম্প্রসারিত করবে। দার্জিলিংয়ে অনুষ্ঠিত জি-২০ ইভেন্ট নিশ্চিত করেছে ভ্রমণ ও পর্যটনশিল্পে বিদ্যমান বিপুল সম্ভাবনার বিষয়টি।

তার ওপর শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক পর্যন্ত উত্তর-পূর্ব গ্রিড প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন ঘটলে, শিল্পায়নের ঢেউ এ অঞ্চলটিতে ঘটাবে এক নতুন রূপান্তর। এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এক অত্যাবশ্যকীয় ধমনির মতোই জ্বালানি শক্তির একটি অবিচ্ছিন্ন প্রবাহের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা কারখানাগুলোকে জ্বালানি জোগায় এবং ত্বরান্বিত করে উন্নয়নের প্রবাহকে।

সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের এক প্রতিনিধি দলকে সম্প্রতি দার্জিলিং নিয়ে গিয়েছিলেন ইউএস-ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ ফোরাম। তারা জোর দিয়েছিলেন ‘চা ও পর্যটনশিল্পের শক্তি’ এবং ‘কৃষিক্ষেত্র, অবকাঠামো, এবং পুনর্নবায়নযোগ্য শক্তির অনাবিষ্কৃত সুযোগ এবং অব্যবহৃত সম্ভাবনা’তে। 

একইভাবে নতুন সুযোগ আবিষ্কার, স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সমন্বয় করতে এবং এ অঞ্চলের চা বাগানের শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যে গত মাসে দার্জিলিং সফরে এসেছিলেন বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের একটি উচ্চপর্যায়ের ডেলিগেশন। 

এই হিমালয় এবং উপ-হিমালয় অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে তৈরি হচ্ছে উচ্চমানের মানবসম্পদ। মানবিক পুঁজি এবং অবস্থানের এই সংমিশ্রণ এখানে যখন একটি উপযুক্ত পরিবেশ, বিনিয়োগ এবং সুযোগের আবিষ্কারের বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত, তখন এই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরটির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমৃদ্ধির এক করিডোরে রূপান্তরিত হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা। কৌশলগত এই করিডোরটিকে শুধু পূর্ণ সম্ভাবনার উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্যই নয়, জাতির নিরাপত্তা স্বার্থকেও রক্ষা করার জন্যও সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সম্পূর্ণরূপে সেই সম্ভাবনা উপলব্ধি করার এখনই সময়।

লেখক : ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব এবং ভারতের জি২০ প্রেসিডেন্সির প্রধান সমন্বয়কারী

সর্বশেষ খবর