বুধবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

মানুষের চিন্তাভাবনায় ইসলামের নির্দেশনা

মুফতি মোহাম্মদ এহছানুল হক মুজাদ্দেদী

মানুষের চিন্তাভাবনায় ইসলামের নির্দেশনা

মানুষ। পবিত্র কোরআনে মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ সৃষ্টির সেরা জীব ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন স্বাধীন করে, স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের জন্মগত অধিকার। মানুষকে তিনি দিয়েছেন বিশ্বাসের স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। তবে এই স্বাধীনতার প্রয়োগ হতে হবে মহান রাব্বুল আলামিনের নির্দেশিত পথে। বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রসরমূলক সৎ মুক্তচিন্তাকে ইসলাম সাধুবাদ জানায়। ইসলাম তার সূচনালগ্ন থেকেই সমগ্র বিশ্বজগৎ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার জন্য মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘(হে রসুল!) আপনি বলে দিন, আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে তা যেন তারা চোখ মেলে দেখে।’ সুরা ইউনুস, আয়াত-১০১

যারা আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে, গবেষণা করে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে ভাবতে চায় না, তাঁর মহান কুদরত সম্পর্কে জানতে চায় না, তাদের তিনি ভর্ৎসনা করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে-‘আমি জাহান্নামের জন্য বহু জিন ও মানব সৃষ্টি করেছি। তাদের অন্তর আছে (কিন্তু) তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চোখ আছে (অথচ) তা দিয়ে তারা দেখে না।’ সুরা আরাফ, আয়াত-১৭৯

মহান আল্লাহ ইমানদার বান্দাদের তার কথা স্মরণ রাখার নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কোরআন শরিফে বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর এবং সকাল বিকাল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা কর।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৪১-৪২) অন্য এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেছেন, আপনি এমন লোকের সঙ্গে অবস্থান করুন যারা আমাকে আহ্বান করে। আমার কথা স্মরণ করে। আমার জিকির করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনি নিজেকে তাদের সঙ্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশে আহ্বান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত : ২৮)

মহান আল্লাহতায়ালার এ পবিত্র বাণীগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহ আমাদের যে চিন্তাশক্তি, বোধশক্তি দান করেছেন, তা অলস ফেলে রাখার জন্য নয়। অন্য সৃষ্টিকে তিনি জ্ঞানদান করেননি, কেবল মানুষকেই তিনি জ্ঞান দিয়েছেন ভালো-মন্দ বিবেচনার জন্য। মানুষ জ্ঞান খাটিয়ে, তার মেধাশক্তি কাজে লাগিয়ে পৃথিবীকে আবাদ করবে, সত্য ও ন্যায়ের পথে নিজেকে পরিচালিত করবে, স্রষ্টার পরিচয় লাভ করে তাঁর আনুগত্য করবে, এটাই হচ্ছে তার প্রধান কাজ। আল্লাহতায়ালা অন্য প্রাণীকুলকে জ্ঞানদান না করার কারণে পরকালে তাদের কঠোর বিচারের সম্মুখীন হতে হবে না। পক্ষান্তরে আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান ও বিবেচনাশক্তি দিয়েছেন বলে তার থেকে হাসরের মাঠে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নেবেন।

ইসলাম বিবেকের সুরক্ষায় অত্যন্ত যত্নশীল। ইসলাম মানবজীবনে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে পাঁচটি বিষয়কে। সেই পাঁচটি বিষয় হচ্ছে-ধর্ম, আত্মা, বিবেক, সম্মান ও সম্পদের সংরক্ষণ। বিবেকের গুরুত্ব এ জন্য যে, বিবেকহারা হলেই মানুষ পশুত্বের কাতারে নেমে যায়।

জীবনকে সাজাতে হবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির ভাবনায়। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশিত পথে মন মস্তিষ্ক বিবেক পরিচালিত করতে হবে। বিবেকের মানুষের হেফাজত দুভাবে হতে পারে। প্রথমত, ইসলাম বিবেককে আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনা করে আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করেছে। দ্বিতীয়ত, অন্ধ অনুকরণ থেকে বিবেককে মুক্ত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে মুশরিক ও কাফেরদের তাদের পূর্বপুরুষের অন্ধ অনুকরণের কারণে নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যখন তাদের বলা হয়, তোমরা অনুসরণ কর, যা আল্লাহ নাজিল করেছেন। তখন তারা বলে, বরং আমরা অনুসরণ করব আমাদের পূর্বপুরুষদের, যার ওপর আমরা তাদের পেয়েছি। যদি তাদের পূর্বপুরুষরা কিছু না বোঝে এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত না হয়, তার পরও কি তোমরা তাদের অনুসরণ করবে?’। সুরা বাকারা, আয়াত-১৭০

একদিকে ইসলাম বিবেককে অন্ধ অনুকরণ থেকে মুক্ত রাখার কথা বলেছে, অন্যদিকে বাড়াবাড়ি ও সীমা লঙ্ঘন করতেও নিষেধ করেছে। আর এটাই বিবেককে কাজে লাগানোর উত্তম পন্থা। মানসিক প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং কল্পনাপ্রসূত মতবাদের অনুকরণ থেকে মানুষ মুক্ত হলেই কেবল তার রব প্রভুকে চিনতে পারবে এবং ইসলামকে জানতে পারবে। বর্তমানে অশ্লীলতা বেহায়াপনা মুক্তচিন্তার নামে শয়তানি নাস্তিকতাকে পরিহার করে আল্লাহতায়ালা সব নরনারীকে কোরআন সুন্নাহর আলোকে, আহলে সুন্নাতের মতাদর্শে অলি আল্লাহদের পথে চলার সঠিক বুঝ দান করুন। সে অনুযায়ী চিন্তাভাবনা করে আমাদের জীবনকে আলোকিত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : বাংলাদেশ শ্রেষ্ঠ ইমাম, খতিব মনিপুর বায়তুল আশরাফ (মাইকওয়ালা) জামে মসজিদ, মিরপুর-২, ঢাকা

সর্বশেষ খবর