সোমবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

মোদি ভারতকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মোদি ভারতকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন

একদা অযোধ্যার রাজা দশরথের প্রথম স্ত্রী কৌশল্যার গর্ভে প্রথম পুত্র রাম জন্মেছিলেন। বহুদর্শী জ্যোতিবসু অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙার পর সাংবাদিকদের প্রায়ই বলতেন, এ কোন রাম? আমাদেরও তো একজন রাম আছেন। সৎ মা কৈকেয়ী চেয়েছিলেন, রামকে ১৪ বছরের জন্য বনবাসে পাঠাতে। সেই দাবি মেনে নিয়েই পিতা তাকে বনবাসে যাওয়ার হুকুম দিয়েছিলেন। বনবাসে রামের সঙ্গে ছিলেন দশরথের তৃতীয় স্ত্রীর পুত্র লক্ষ্মণ।  পত্নী সীতাকে সঙ্গে নিয়েই তিনি বনবাসে যান। সীতাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, লঙ্কার রাবণ।  এরপরে রামের সঙ্গে রাবনের যুদ্ধ হয়। এসব ঘটনাই আমাদের জানা।

রামায়ণকান্ড নিয়ে ভারতবর্ষকে হিন্দুত্ববাদের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা সেই নয়-এর দশক থেকেই। ১৯৯৬ সালে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভেঙে টুকরো টুকরো করে বিজেপির নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি এবং তৎকালীন আরএসএস নেতা দেশজুড়ে হিন্দুত্ববাদের স্লোগান নিয়ে আসরে নেমে পড়েন। লালকৃষ্ণ আদভানি পারেননি। তার উত্তরসূরি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভগবত রামমন্দির তৈরি করেছেন। প্রায় ৩ হাজার কোটি সরকারি টাকা খরচ করে এই মন্দির বানানো হয়েছে। গত বছর ৩০ ডিসেম্বর মন্দিরের তদারকি করতে প্রধানমন্ত্রী সেখানে হাজির হয়েছিলেন। সারা দিন অযোধ্যায় ঘুরে তিনি এ বছরের এপ্রিলে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারই করেছেন। উসকানি দিয়েছেন হিন্দু জাগরণের। একই সঙ্গে তিনি একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি চ্যানেলে তার প্রথম সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ বছরে নির্বাচনে তার দলের প্রথম এবং প্রধান ইস্যু হলো হিন্দুত্ববাদ। ভারতবর্ষের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। মোদি ওই সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তার রাজত্ব মানেই রামরাজত্ব। রামরাজত্ব কী ছিল। তা তিনি খুলে বলেননি। বোধহয় তিনি তা জানেনও না।

রামকথা নিয়ে কয়েক বছর আগে একটি হিন্দি ধারাবাহিক হয়েছিল। সেই সময় মোদি ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। তখন বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়ি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। অটল বিহারি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, মোদি রাজধর্ম পালন করছেন না। বাজপেয়িজি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন মোদিকে ওই মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরাতে। কিন্তু আরএসএস এবং লালকৃষ্ণ আদভানি তাকে ক্ষমতায় রেখে দেন। আরএসএস স্কুলে ১১ ক্লাস পর্যন্ত পড়ার পর মোদি প্রচারক হিসেবে ভারত এবং আমেরিকা ঘুরে বেড়ান। কথা প্রসঙ্গে এক দিন আদভানি আমাকে বলেছিলেন, ১৪ বছর বয়সে তিনি করাচিতে আরএসএসের শাখা প্রচারক হন। মোদি সম্প্রতি অযোধ্যায় বলেছেন, তিনি যা বলেন, তাই করেন। আদভানি সেদিন কথা প্রসঙ্গে স্বীকারও করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস ভেঙে মমতা ব্যানার্জিকে তিনিই বিজেপির শরিক করেছিলেন। এজন্য অবশ্য অনেক...। তাহলে দেখা যাচ্ছে এ বছর ভারতের সংসদ নির্বাচনে একটিই স্লোগান- রাম... রাম... রাম।

এই রাম নাম নিয়ে মোদি আবার তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসতে চান। ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় তিনিই রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবেন। প্রশ্ন উঠেছে, তিনি তো একজন ক্ষত্রীয়। ব্রাহ্মণ নন। তাহলে তিনি কীভাবে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবেন। কার্যত গ্যাং অব থ্রি... মোদি, মোহন ভাগবত এবং অমিত শাহ এই তিনজনই এখন ভারতের ভাগ্য বিধাতা। শুধু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মোদির আমলে শিল্প হয়নি। কিন্তু নতুন শিল্প তিনি এনেছেন। সেটি হলো অসত্য, অসত্য, অসত্য... মিথ্যা...মিথ্যা...মিথ্যা।

এই মিথ্যা দিয়ে তিনি ভারতবর্ষ জয় করতে চাইছেন। সম্প্রতি তা অযোধ্যা সফরের সময় দেখা গেছে। শুধু সাধুসন্তরা তাকে ঘিরে রেখেছেন। সাধুসন্তরাই কি দেশ চালাবেন? সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত জাতিসংঘ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ভারতে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ পেট ভরে খেতে পায় না। শিশুরা স্কুলে টিফিন পায় না। দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য গ্যাং অব থ্রি অহরহ সারা দেশ ঘুরে বর্তমান অবস্থার জন্য জওহরলাল নেহরু ও কংগ্রেসকে দায়ী করছে। বিরোধীরা তা মানতে চাইছে না। তারা পাল্টা আক্রমণ করছে। মোদির দক্ষতার অভাব ওপেন সিক্রেট। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে যা কিছু হয়েছে তার সবই কংগ্রেস আমলে। ’৬৫-৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে দুটি যুদ্ধে কংগ্রেস সরকার জয়ী হয়েছে। চাকরি দেওয়া থেকে শুরু করে এহেন প্রতিশ্রুতি নেই, যা মোদি দেননি। তার একটাও তিনি পালন করেননি। তার একমাত্র শত্রু কংগ্রেস। সব মিটিংই তিনি শুরুই করেন- ভারত মাতা কি জয় বলে। দ্বিতীয় লাইনটি বলেন, কংগ্রেসওয়ালো কো হাম খতম কর দেগা। সেই সঙ্গে বলেন, মোদি যা বলেন, তা করেন। যেমন অযোধ্যায় রামমন্দির করে দিয়েছি।

রামমন্দির তো আর ভোট দেবে না। তাহলে কি মোদি ধরেই নিয়েছেন স্বয়ং রাম এসে তাকে ভোটে জিতিয়ে দেবেন? এ প্রশ্ন শুধু বিরোধীরা নয়, তুলতে শুরু করেছেন ইতিহাসবিদরাও। জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ইতিহাসবিদ প্রশ্ন তুলেছেন-নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে আমরা যাচ্ছি কোথায়? আমরা কি অষ্টপ্রহর রাম নাম ভজনা করব? নাকি দেশের নিরন্ন মানুষের পেটে ভাত জোগানোর ব্যবস্থা করব? এবারে মোদির রামমন্দির একমাত্র ইস্যু বলে বছরের শেষ দুই দিন কলকাতায় এসে কাটিয়ে গেছেন গ্যাং অব থ্রির অন্যতম সদস্য মোহন ভগবত।  তিনি একাধিক শিল্পপতির সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন। বৈঠক করেছেন ১০-১২ বছর আগে অবসর নেওয়া সিবিআই প্রধান উপেন বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি মমতার আমলে শুরু হওয়া ৮ হাজার আরএসএস স্কুলের কর্তাদের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেন। এসব গোপন আলোচনায় উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি কোটি কোটি লিফলেট তৈরি করে বাড়ি বাড়ি রাম-মহিমা প্রচার করবে। অনেকেই মনে করছেন, তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর উদ্যোগ নেবেন মোদি। এর আগের দুবার কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ এবং রামমন্দির তৈরি করে ফেলেছেন। এবার ক্ষমতায় এলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করে দেবেন। অনেকেই এ ব্যাপারে তাকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করছেন।  কারণ হিটলারও বিরোধীশূন্য করে একাধিক আইন প্রণয়ন করেছিলেন। কী হবে তা দেখার জন্য আমাদের ২২ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

               

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর