শুক্রবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

নির্বাচন নিয়ে কিছু বিশ্লেষণ

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

নির্বাচন নিয়ে কিছু বিশ্লেষণ

নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে বিশ্বের গণতন্ত্রকামী সব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের নজর ছিল জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের অষ্টম ও মুসলিম অধ্যুষিত বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ রাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর। সপ্তাহের শেষ দিন (৭ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত হলো এ দেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সবাই জানতেন এই নির্বাচনে ক্ষমতার বলয়ে কিংবা দেশের নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। নির্বাচনের পরপরই বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন, রাশিয়া, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শুভেচ্ছা লাভ করবেন, এমনটাই অবধারিত ছিল এবং ঘটেছেও তাই। তবে অনিশ্চিত ছিল আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি। ইতোমধ্যে আমেরিকার পররাষ্ট্র দফতর এই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে বিবৃতি দিয়েছে। তাদের মতে, অন্যান্য পর্যবেক্ষকের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রও একমত যে, এই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ না করায় আমেরিকা হতাশ বলে জানিয়েছে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র। অন্যদিকে জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্রের কার্যালয়ে ৮ জানুয়ারি সোমবার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সংস্থা প্রধানের সহযোগী মুখপাত্র ফ্লোরেন্সিয়া সোতে নিনো বলেন, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে, তার দিকে জাতিসংঘ মহাসচিবও নজর রাখছেন। বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তের বিষয় এবং ভিন্নমত ও সমালোচনা দমনসহ বিরোধী নেতাদের গ্রেফতারের সব অভিযোগের বিষয়েও মহাসচিব অবগত। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৮ জানুয়ারি তারিখে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে উল্লেখ করেছে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন নির্ভর করে গ্রহণযোগ্য, অবাধ, যথাযথ ও সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতার ওপর। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায়ও আইনের শাসন অপরিহার্য উপাদান। নির্বাচনের সময় এসব মানদন্ড ধারাবাহিকভাবে মেনে চলা হয়নি এবং ভোটের আগে বিরোধী দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা নিয়ে যুক্তরাজ্য উদ্বিগ্ন।

জাতিসংঘ ও দুটি শক্তিশালী দেশের এমন প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে অন্য প্রভাবশালী দেশ জাপানের পর্যবেক্ষক দল ও ঢাকাস্থ জাপানি রাষ্ট্রদূত নির্বাচনের পর দিন (৮ জানুয়ারি) নির্বাচন কমিশনে উপস্থিত হন। তারা সুন্দর নির্বাচন ব্যবস্থাপনার জন্য নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বলেও জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার। পশ্চিমা বেশ কিছু দেশ থেকে আসা পর্যবেক্ষকগণ এই নির্বাচন নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। সবচেয়ে বড় সন্তুষ্টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এবং এই দলের প্রাণভোমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তার নেতৃত্বে দলটি পাঁচবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে বিধায় এক অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী এই প্রধানমন্ত্রী। সারা বিশ্বে নারী সরকারপ্রধান হিসেবে তিনিই সম্ভবত সর্বোচ্চ মেয়াদের রেকর্ড স্থাপন করতে চলেছেন।

২০২৪ সালের নির্বাচন নানা বিচারে একটি মাইলফলক, শিক্ষণীয় রাজনৈতিক ঘটনা এবং ভবিষ্যৎ গবেষণার বিষয় হয়ে থাকবে। চীন, রাশিয়া, ভারত, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর বহু দেশে আজ গণতন্ত্র এমনকি বহুদলীয় গণতন্ত্র আছে, তবে ক্ষমতাসীন দল পরিবর্তনের কোনো রকম সম্ভাবনা ছাড়া। কোনো কোনো দেশ দলীয়প্রধান পরিবর্তনের কথা চিন্তাও করতে পারে না। উত্তর কোরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশ এবং যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষপীড়িত আফ্রিকা অঞ্চলে আজ গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। ফিলিস্তিনসহ অসংখ্য দেশে নেই মানবাধিকারের ন্যূনতম উদাহরণ। তবুও দেশগুলো টিকে আছে! কোনো কোনো দেশ অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে এগিয়েও আছে। সেই বিচারে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে বহির্বিশ্ব কতটা চিন্তিত, তা তর্কসাপেক্ষ। বিশেষত গণতন্ত্রের সংজ্ঞাকে একেক দেশে একেক রকম বলে প্রমাণ করেছে গণতন্ত্রের ধারক-বাহক ও প্রচারকরূপে দাবিদার বহু দেশ। গণতন্ত্র নয়, আধিপত্যবাদের বিস্তৃতিই আজ এসব দেশের মূল প্রতিপাদ্য। ইসরায়েলের প্রতি নগ্ন সমর্থন দিয়ে ফিলিস্তিনে নির্বিচার নারী-শিশু ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের হত্যার পথ সুগম করে অনেক দেশই প্রমাণ করেছে, গণতন্ত্রের প্রতি তাদের কান্না তাদের স্বার্থসিদ্ধির অভীষ্টে একপ্রকার অভিনয় মাত্র।

এমনি এক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি দ্রুত অগ্রসরমান দেশ হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদেরই ভাবতে হবে। ইসরায়েলের ন্যক্কারজনক ভূমিকার বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) কী অর্জন করেছে তা বোঝা না গেলেও এটুকু বোঝা গেছে যে, তারাও যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতা ধরে রাখার দল, আদর্শের দল নয়। ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে পেয়েও যে নেতৃত্ব একটি বৃহৎ জোট বা বিএনপি নামক দলকে ক্ষমতায় নেওয়া দূরে থাক, সুবিধাজনক অবস্থানে কিংবা সংসদে বিরোধীদলীয় আসনে স্থান দিতে পারেনি, তাদের যোগ্যতা, আন্তরিকতা কিংবা সীমাবদ্ধতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বাংলাদেশে শক্তিশালী বিএনপি নেতৃত্ব গড়ে উঠলে লন্ডনের নেতৃত্ব মূল্যহীন হয়ে পড়ার ভীতি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে বলে প্রায়ই শোনা যায়। সম্প্রতি বিএনপির অনেকে জেলে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন বলেও মন্তব্য পাওয়া যায়। কারণ বাইরে থাকলে লন্ডনের চাপে তাদের মাঠে নামতে হতো এবং আরও কিছু মামলায় আসামি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এর ফলে অনেকেই নির্বাচনের আগে নিজ থেকে জামিন নিতে উৎসাহী ছিলেন না- এমনটাও শোনা যায়।

২০২৪ সালের নির্বাচনে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। এসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অধিকাংশ তথাকথিত প্রতিদ্বন্দ্বীরা জামানত হারিয়েছেন। এই জামানত হারানোর তালিকায় আছেন কিংস পার্টির তকমা পাওয়া দলের নেতারাও। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও ৫০ শতাংশের কিছু বেশি নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে হাস্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে অধিকাংশ আসনের বিপরীতে। এমতাবস্থায় ঘুরে-ফিরে উচ্চারিত হচ্ছে জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক সংস্কারক কার্ল হাইনরিশ মার্ক্সের (১৮১৮-১৮৮৩) একটি অমর বাণী। কার্ল মার্কস বলেছিলেন যে, ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে, প্রথমটি ট্র্যাজেডি হিসেবে, দ্বিতীয়টি প্রহসন হিসেবে।

এবারের নির্বাচনে নিজেদের প্রহসনের পাত্র প্রমাণ করেছেন ১৯ জন প্রার্থী, যেখানে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী না থাকা সত্ত্বেও তারা করুণভাবে এবং ব্যাপক ব্যবধানে হেরেছেন। জোটবদ্ধ নির্বাচন ও বিরোধী দল সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ ৩২টি আসনে দলীয় প্রার্থী দেয়নি। এ ক্ষেত্রে ২৬টি আসনে লাঙল প্রতীক নিয়ে জাতীয় পার্টির ২৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জয় পেয়েছেন মাত্র ১১ জন, হেরেছেন ১৫ জন। ছয়টি আসনে নিজ দলের প্রতীক ছেড়ে নৌকা নিয়ে লড়লেও জয় পেয়েছেন মাত্র ২ জন তথাকথিত বামদলীয় নেতা, হেরেছেন ইনু ও বাদশাসহ চারজন। হেরে যাওয়া ১৫ জন নৌকাদলীয় প্রতীক না থাকায় খেলেছিলেন রাজনীতির মাঠের বি-টিমের সঙ্গে। হেরে যাওয়া বামদলীয় চারজন নৌকা নিয়েই খেলেছিলেন স্বতন্ত্র নামক আওয়ামী লীগের বি-টিমের সঙ্গে। এরপরও তাদের (১৫+৪)=১৯ পরাজয় তাদের রাজনৈতিক দৈন্য প্রমাণ করেছে। আর আওয়ামী লীগ কাদের নিয়ে জোট করে কিংবা জোটের আর কী প্রয়োজন- এমন প্রশ্ন সামনে এনেছে।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে নৌকা, উত্তরাঞ্চলে লাঙল এবং বগুড়া ফেনীসহ অন্য কিছু অঞ্চলে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করলে কলাগাছও পাস করে, এমনটাই ভাবতেন অনেকে। সেই ভাবনার অবসান হয়েছে এবার। এবারের নির্বাচনে বিজয়ী ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে ৫৮ জনই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত। তারা জাতীয় পার্টির জন্য ছেড়ে দেওয়া ১৫টি আসনে ও বামদের জন্য ছেড়ে দেওয়া চারটি আসনের পাশাপাশি নৌকা পাওয়া ৩৯ জনের বিরুদ্ধেও জিতেছেন। বিভিন্ন জরিপের পর কেনইবা তারা মনোনয়ন পেলেন এবং মনোনয়ন পাওয়া এই ৩৯ জন কেন হারলেন, তা দলের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরাই ভালো বলতে পারবেন। বিশেষত, বিগত সরকারের তিন প্রতিমন্ত্রী ও বিগত সংসদের তিন ডজন এমপি কেন নৌকা ডোবালেন তা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। রাজনীতি যে আজ ধনী ও ব্যবসায়ীদের দখলে, তা আবারও প্রমাণ হয়েছে এই চব্বিশের নির্বাচনে। ১৯৭৩ সালে ১৮ শতাংশ ব্যবসায়ী নিয়ে যাত্রা করা সংসদে আজ ব্যবসায়ী আছেন ৬৭ শতাংশ (১৯৯ জন)। এত ব্যবসায়ী মিলেও যদি দেশের রিজার্ভ বাড়াতে না পারেন এবং যৌক্তিক মূল্যে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে না পারেন, তবে তা হবে লজ্জাজনক। প্রাক্তন সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের মনোনয়ন, বিজয় ও মন্ত্রিত্ব লাভ প্রশাসন ও পেশাদারিত্বে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রমাণ উৎসাহিত করতে পারে, যা প্রকৃত মেধাবীদের প্রতি সুবিচারের অন্তরায় হবে। বিরোধী দলের ক্রম সংকোচন ভয়ের সংস্কৃতি চালু করবে। প্রায় ৫৯.২ শতাংশ মানুষ, যারা ভোট দেয়নি, তারা যেন রাজনীতিবিমুখ না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বলেছেন, জনপ্রশাসনের তথা রাজনীতির প্রতি অনীহায় শেষ বিচারে মন্দলোকের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। আর আইনস্টাইন বলেছেন, মন্দলোকের দ্বারা পৃথিবী ধ্বংস হবে না। পৃথিবী ধ্বংস হবে তাদের দ্বারা, যারা কিছু না করে কেবল এই মন্দলোকদের দেখে।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

email : [email protected]

সর্বশেষ খবর