রবিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ও বাংলাদেশের স্বার্থ

মেজর আখতার (অব.)

মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ও বাংলাদেশের স্বার্থ

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি খুবই জটিল এবং বহুমুখী, যা গতি ও পরিবর্তনশীল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রয়োগ ও গতি কোথাও কোথাও বেগমান বা স্তিমিত হয় এবং এর বাহ্যিক প্রয়োগও পরিবর্তিত হয়। যদিও এর মূল নীতি আবর্তিত হয় তাদের জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রচারের মতো নীতি দ্বারা। কূটনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য চুক্তি, সামরিক জোট এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পেছনেও নীতিমালার প্রতিফলন ঘটে। সামরিক হস্তক্ষেপ, মানবিক প্রচেষ্টা এবং বাণিজ্য চুক্তিগুলোও মার্কিন বিদেশনীতির গতিশীল ল্যান্ডস্কেপকে চিহ্নিত করে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থে আপসহীন। পৃথিবীর এমন কোনো স্থান বা এলাকা নেই, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ উপস্থিতি নেই। বিশ্বের প্রতিটি দেশকেই তাদের প্রতিবেশীর সঙ্গে বিবাদে ব্যস্ত রেখেছে তারা। এতে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে। সব রাষ্ট্র তাদের সীমান্ত নিরাপদ রাখতে গিয়ে পারস্পরিক সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে। আবার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নামে নিজেরা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কলহে জড়িয়ে পড়ছে; ফলে তাদের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হচ্ছে। তখন বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চাঙা করতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হাত পেতে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এবং মহাদেশীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে মার্কিনিদের লগ্নি করার পথ সুগম করে দিচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও সংঘাত, সন্ত্রাস বা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে দিচ্ছে। তাতে মার্কিন অস্ত্র বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক পণ্য হলো যুদ্ধাস্ত্র। যদি কোনো দুই বা অধিক রাষ্ট্রের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়। তাই বছরের পর বছর ধরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধে তার হস্তক্ষেপের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ অত্যন্ত ভোগবাদী। তাই তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা আকাশচুম্বী। সেই চাহিদা মার্কিন সরকার যদি অব্যাহতভাবে মেটাতে না পারে, তাহলে তাদের রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। যার ফলশ্রুতিতে তাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় বা ফেডারেল কাঠামো হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই যুক্তরাষ্ট্র তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সামাজিক কাঠামোর ভারসাম্য ধরে রাখার জন্য বিশ্বব্যাপী আগ্রাসি অর্থনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে থাকে। তাদের লক্ষ্যই থাকে, স্বল্পমূল্যে বিশ্ববাজার তাদের শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি, বিভিন্ন খনিজ সম্পদ এবং তাদের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ও সেবার জোগান দেবে। আবার নিজেদের কাঁচামাল, খনিজ সম্পদ, কৃষি, শিল্পজাত ও ভোগ্যপণ্য চড়া মূল্যে তারা রপ্তানি করে। তাদের সরবরাহকৃত সেবার মূল্য অন্যান্য দেশ থেকে অনেক বেশি। যার ফলে তারা বিভিন্ন দেশের দুর্বল ও অজনপ্রিয় সরকারের ওপর নির্ভর করে। তারা কখনই কোনো জনপ্রিয় ও শক্তিশালী সরকারকে টিকে থাকতে দেয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তারা বিশ্বব্যাপী সামরিক সরকারদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিকশিত হতে দেয়নি তারা। আশির দশকে সোভিয়েত রাশিয়াকে ভেঙে টুকরা টুকরা করে দিয়েছে। আরব বিশ্বকে এক মুহূর্তের জন্য শান্তিতে থাকতে দেয়নি। নব্বই দশকের পর বিশ্বের নতুন অর্থনৈতিক দানবকে রুখতে চীনের চারপাশে নতুন নতুন বলয় সৃষ্টি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৯-এর ডিসেম্বরে সোভিয়েত রাশিয়ার আফগানিস্তান দখলের পর ইসলামী মৌলবাদের নামে নতুন এক সন্ত্রাসী সৃষ্টি করে তারা বিশ্বে শান্তিকে চরম হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। যার রাহুগ্রাস থেকে এখনো বিশ্ব মুক্ত হতে পারেনি।

পশ্চিমা কিছু দেশের সরাসরি প্ররোচনা, উসকানি ও সহায়তায় আরব বসন্ত বলে গণতন্ত্রপন্থি বিদ্রোহ এবং বিক্ষোভের একটি সিরিজ তৈরি করেছিল; যা ২০১০ সালের শেষদিকে আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের মাধ্যমে উৎখাত হয় তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া এবং ইয়েমেনের দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী সরকারগুলো। যদিও প্রাথমিকভাবে আরব বসন্তের তরঙ্গ ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য আশা জাগিয়েছিল, কিন্তু ফলাফলগুলো ভিন্ন ছিল। যার ফলে ওইসব দেশে এখনো অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজমান। ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ার স্বৈরশাসক কর্নেল গাদ্দাফির পতন হয়েছে সত্য; কিন্তু এখনো গণতন্ত্রের স্বাদ পায়নি, বরং সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক অগ্রগতির সম্মুখীন হয়েছে। আরব বসন্ত মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকাজুড়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক উন্মুক্ততা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য চাপসহ বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য সুবিধা নিয়ে এসেছিল। এটি জনগণকে নিপীড়ক শাসনের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগের কথা বলার অনুমতি দেয়, ক্ষমতায়নের বোধ জাগিয়ে তোলে এবং জবাবদিহিতা দাবি করার পথ শুরুতে উন্মুক্ত করে। এর কাক্সিক্ষত ফলাফল হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময় এবং কিছু দেশ ইতিবাচক পরিবর্তন অনুভব করলেও অন্যরা বিশেষ করে ইরাক ও লিবিয়া দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা এবং সংঘাতের সম্মুখীন হয়। মিসরে নব্যস্বৈরাচার তৈরি হয়। আরব বসন্তের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব জটিল এবং বহুমুখী রয়ে গেছে এবং গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু, অবাধ বা নিরপেক্ষ নির্বাচন এখনো অধরাই রয়ে গেছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ও ইউরোপের যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সহযোগিতায় সংঘটিত আরব বসন্তের লক্ষ্যই ছিল স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আজ তাই বিশ্ববাসীর প্রশ্ন উঠেছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ও ইউরোপের যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্র কি তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া এবং ইয়েমেনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে? নাকি এসব দেশ থেকে সম্পদ লুট করার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহির্বিশ্বে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচারের ওপর জোর দিয়ে থাকে। তবে তাদের এই পররাষ্ট্রনীতি পক্ষপাতদুষ্ট। যেসব সরকার তাদের অনুগত থেকে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে, সেসব দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তেমন ঘাঁটায় না। বর্তমান সরকারের সঙ্গে যেহেতু সুসম্পর্ক নেই, তাই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দিকে তাদের দৃষ্টি পড়েছে। তবে আগে দেখে নিই গত ১৫ বছরে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান।

২০০৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাপক বিক্ষোভ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার দ্বারা চিহ্নিত একটি রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়। নির্বাচনি কারচুপির অভিযোগে তফসিল, জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্থগিত করা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। ফলশ্রুতিতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে যায় এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে দুই বছরের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে। জরুরি শাসন প্রায় দুই বছর অব্যাহত ছিল, সেই সময়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ড সীমিত ছিল। অবশেষে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বেসামরিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপি রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে গুরুতর সংকটের সম্মুখীন হয়। কিন্তু বিএনপি সেদিন সর্বমহলের অসহযোগিতার কারণে শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে পারেনি। সেদিন সবাই বিএনপির বিরুদ্ধে শাসনসংক্রান্ত সমস্যা, দুর্নীতির অভিযোগ এবং জনগণের অসন্তোষের নামে ঝাঁপিয়ে পড়ে; যার কারণে দেশব্যাপী অশান্তি দেখা দেয়। পরবর্তীতে প্রতিবাদ আন্দোলন ও বিরোধীদের চাপ তীব্র হয়। এই সংকট শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার দিকে নিয়ে যায়। যার ফলে নির্ধারিত সংসদ নির্বাচন স্থগিত হয় এবং দুই বছরের জন্য একটি অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ সময়ের মধ্যে এবং পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে, যা বিএনপির গতিপথ এবং দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে প্রভাবিত করেছে।

২০০৭ সালের রাজনৈতিক সংকট ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের একটি উল্লেখযোগ্য অস্থিরতার সময়, যা দেশের শাসন ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করে। রাজনৈতিক সংকট থেকে সুস্পষ্ট সুবিধা চিহ্নিত করা চ্যালেঞ্জিং। কারণ এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই বাধা, অনিশ্চয়তা এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। বাংলাদেশে ২০০৭ সালের রাজনৈতিক সংকট একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং ২০০৮ সালের পরবর্তী নির্বাচনসহ কিছু ফলাফলের দিকে পরিচালিত করেছিল। এখন কেউ কেউ যুক্তি দেন যে, এই রূপান্তর পরবর্তীকালে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে অবদান রেখেছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন ক্ষমতার ভারসাম্য নেই। সরকার প্রবল পরাক্রমশালী। পক্ষান্তরে সরকারবিরোধী শক্তি অতিশয় দুর্বল এবং পর-মুখাপেক্ষী। তার ওপর তাদের নেতৃত্বের অনুপস্থিতি যা এক ধরনের জটিল শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। অপ্রিয় হলেও চরম সত্য যে, দেশে কোনো রাজনৈতিক এবং এমনকি অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করার বাস্তব শক্তি বা ক্ষমতা কোনোটাই সরকার বিরোধীদের নেই। তবে তাদের আস্ফালন আছে এবং তীর্থের কাকের মতো তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু মাঠে-ময়দানে সংকট সৃষ্টি করতে না পারলে তাদেরও কিছু করার থাকবে না। তবে হয়তো জেল-জুলুম, নির্যাতন বা গুম ও খুন থেকে রক্ষা করতে পারে।

৮ জানুয়ারি ২০২৪ মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় (ইন্দো-প্যাসিফিক) অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করা, বাংলাদেশে মানবাধিকার সুরক্ষা ও নাগরিক সমাজের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যে ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ বিষয়টি শুভঙ্করের ফাঁকিতে ভরা। কারণ তারা স্পষ্ট করেই বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করবে; যার পরিষ্কার মানে হলো তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অবাধ ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় (ইন্দো-প্যাসিফিক) অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করবে। এখানে সরকারবিরোধীদের সঙ্গে কাজ করার কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে তারা বলেছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার সুরক্ষা করবে। যার মানে হলো বিরোধীদের প্রতি হয়রানি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবে, যা ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক। আবার বলছে, নাগরিক সমাজের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে, যা একটি অর্থহীন বক্তব্য। কারণ বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ খুবই ক্ষুদ্র এবং প্রায় সবাই দ্বৈত-নাগরিক। সবশেষে বলেছে, দুই দেশের জনগণের মধ্যে ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জনগণ তাদের এই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। তবে এখানে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে কিছু উপাদান তুলে ধরা হলো তাদের বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের জন্য। (প্রথম আলো অনলাইন ৯-১-২০২৪; বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয় নাই)।

১। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুদান দিয়ে হলেও আরএমজির দ্রব্যের ক্রয়মূল্য অন্তত ২৫% বৃদ্ধি করা হোক; যাতে আমাদের পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়। বিনিময়ে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করার জন্য শুল্ক ও বিনিয়োগ প্রত্যাবর্তনের বিশেষ ও বাড়তি সুবিধা দেব।

২। যুক্তরাষ্ট্রের তুলার রপ্তানি মূল্যে বাংলাদেশের জন্য ৪৫% ডিসকাউন্ট বা মূল্যছাড় দেওয়া হোক; যাতে পোশাকশিল্পের কাঁচামালের মূল্যহ্রাস করা যায়। এর পরোক্ষ সুবিধা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণই পাবে।

৩। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বৃত্ত গম থেকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য ৪৫% মূল্যছাড়ে প্রতি বছর ৫০ লাখ টন গম বাংলাদেশে রপ্তানি করা হোক। বিনিময়ে আমরা তাদের আমাদের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি ভাবব।

৪। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বৃত্ত সয়াবিন তেল, চিনি, সয়াবিন কেক ও ভুট্টা থেকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য ৪৫% মূল্যছাড়ে অন্তত ৪ লাখ টন সয়াবিন তেল, ৫০ লাখ টন ভুট্টা, ২০ লাখ টন সয়াবিন কেক ও ২০ লাখ টন পরিশোধিত বা অপরিশোধিত চিনি বাংলাদেশে রপ্তানি করা হোক। বিনিময়ে আমাদের তেল ও গ্যাস সম্পদ আহরণে তাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করব।

৫। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরব বন্ধুদের কাছ থেকে ৪৫% মূল্যছাড়ে প্রতি বছর ৫০ লাখ টন ক্রড ওয়েল সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।

৬। বাংলাদেশের শিক্ষার উন্নতির জন্য দক্ষ শিক্ষক, আধুনিক প্রযুক্তির শিক্ষা উপকরণ ও কম্পিউটার সামগ্রী অনুদান হিসেবে অন্তত ১০ বছর সময়কাল পর্যন্ত দেওয়া হোক। বিনিময়ে আমরা তাদের দক্ষ জনশক্তি দেব। যদি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের জন্য এই প্যাকেজগুলো দিতে পারে তাহলে বাংলাদেশের জনগণ তাদের মনমতো গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের মনমতো সরকার নির্বাচিত করে দেবে যার অঙ্গীকার জনগণ অবশ্যই করতে পারে।

যাই হোক, এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, রাজনৈতিক সংকটের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও হতে পারে, যার মধ্যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক অস্থিরতা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়। এ ধরনের ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব জটিল এবং বিভিন্ন কারণের ওপর নির্ভর করে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই থাকতে পারে। তাই যে কোনো দেশপ্রেমিক ব্যক্তি বা শক্তির প্রচেষ্টা থাকে যেন নিজেদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা দলের স্বার্থে দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক অস্থিরতা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি সাধিত হয় এমন কোনো কাজ থেকে নিজেরা বিরত থাকি, অন্যকে বিরত রাখি এবং কাউকে উসকানি বা প্ররোচনা না দিই। বর্তমান অবস্থায় বা প্রেক্ষাপটে দেশে শাসনসংক্রান্ত কোনো সংকট সৃষ্টি হলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেবে, যার ফলশ্রুতিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হবে এবং দেশে জনগণবিবর্জিত পোশাকি সরকারের উদ্ভব হবে; যা রাজনৈতিক সংকটকে আরও তীব্রতর করবে। তার চেয়ে সময়ের জন্য অপেক্ষা করে নিজেদের আরও শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করলে যথাসময়ে কাক্সিক্ষত ও ইতিবাচক পরিবর্তন নিজেদের পক্ষে আসবে বলে জনগণ বিশ্বাস করে। ধৈর্য সব সময় ভালো এবং সুমিষ্ট ফল দেয়।

পরিশেষে বিনয়ের সঙ্গে বলব, আমরা সবাই বিশ্বাস করি, আমাদের সবার কাছে দেশ বড় এবং তার পরে দল ও ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নবগঠিত সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চায়; যা সবার জন্য সুযোগ ও মঙ্গল বয়ে আনবে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে স্মার্ট বাংলাদেশ হতে বেশি সময় লাগবে না।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

সর্বশেষ খবর