শুক্রবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

সন্তানের প্রতি এক আল্লাহর ওলির শেষ অসিয়ত

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

সন্তানের প্রতি এক আল্লাহর ওলির শেষ অসিয়ত

যারা আল্লাহপাগল, তাদের চিন্তা-চেতনা-ধ্যান-ধারণা সবকিছুই আল্লাহকে ঘিরে। এমনকি তারা যখন অসিয়ত করেন তখনো আল্লাহর কথাই ঘুরেফিরে বলেন। এমনই এক আল্লাহর ওলির শেষ অসিয়তনামা হাতে আসে। অর্ধশতেরও বেশি পৃষ্ঠাব্যাপী অসিয়তনামায় বারবার তিনি শুধু আখেরাতের জীবনের প্রস্তুতির কথাই লিখেছেন। আজকাল অসিয়ত বলতে ব্যাংক-ব্যালান্স-ঋণ ও সম্পদের বিবরণই বুঝে থাকি আমরা। কোথায় কী সম্পদ আছে, কার কাছে পাওনা আর কে পাবে এসব বলে যাওয়াটা আমাদের মতো সাধারণ দীনদারদের কাছে অনেক বড় বুজুর্গি মনে হয়। কিন্তু যারা সত্যিকার অর্থেই বুজুর্গ তাদের চিন্তা একেবারেই ভিন্ন রকম। ওই আল্লাহর ওলি মারা যান ১৯৯৬ সালে। মৃত্যুর বছরখানেক আগে তিনি অসিয়তনামাটি লিখেন। পরিবার ও সন্তানদের উদ্দেশে তিনি লিখেছেন, ‘আমি একজন দায়ী। আল্লাহর রাস্তায় মানুষকে ডাকা, হেদায়াতি লেখা ও আলোচনা বক্তৃতাই আমার একমাত্র কাজ। যদিও এখন আমার বয়স ৬৪ বছর এবং আমার হার্টের অপারেশন হয়েছে, অন্যান্য অসুখও আমাকে পেয়ে বসেছে। হতে পারে লেখালেখি অবস্থায় কিংবা কোনো আলোচনা অথবা সভায় থাকাকালীন মৃত্যুর দূত আমার কাছে চলে আসতে পারে। সাবধান! হে আমার পরিবার! তোমরা আমার মৃত্যুর জন্য কখনো দীনি কাজকে দায়ী কর না। আমার দীনি ভাইদের তোমরা দোষারোপ কর না। এ ধরনের কোনো চিন্তাই যেন মনে না আসে। বাহ্যিকভাবে মনে হতে পারে রাতজাগা কিংবা বেশি পরিশ্রমের কারণেই আমার মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহ করার অবকাশ নেই যে, আমার মৃত্যু এভাবেই লেখা ছিল। যদি তোমরা এ বিষয়ে ন্যূনতম সন্দেহ কর তাহলে নিশ্চিত জেনে রাখ ইমানের দিক থেকে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ দীনের জন্য যখন কোনো মানুষ নিজেকে ওয়াক্ফ করে দেয় তখন এভাবেই তার চিন্তা গড়ে ওঠে। ৩০ বছর আগের প্রথম হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন তিনি। তারপর থেকেই চলাফেরা ও স্বাস্থ্যের বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়ার জোর নির্দেশ দেন ডাক্তার। এরপর আরও কয়েকবার হার্টে অপারেশন হয়। পরিবারের লোকজন ওই আল্লাহর ওলিকে বারবার বলছিলেন, আপনার শরীর অনেক খারাপ। এখন একটু রেস্ট নিন। দাওয়াতের কাজ থেকে অবসর নিন। এভাবে বারবার বলার কারণে তিনি বিষয়টি অসিয়তনামায় তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, ‘তোমরা আমাকে দীনি কাজ থেকে অবসর নিতে বল। বিরতি দিতে বল। কিন্তু আমি যদি দীনের কাজের চাপে মারা যেতাম তাহলে অনেক আগেই মারা যেতাম। খুব কম মানুষেরই আমার মতো এতবার হার্টের অপারেশন হয়েছে। বরং তোমরা শোকরিয়া আদায় কর এ কারণে- প্রথম হার্ট অ্যাটাকের পর গত ৩০ বছর বেঁচে আছি মূলত দীনি কাজের আনজাম দেওয়ার জন্যই। আল্লাহ আমাকে এ কারণেই বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাই নিজের চিন্তাকে ভুলপথে পরিচালিত কর না।’ আল্লাহপাগলদের চিন্তা থাকে আল্লাহকে ঘিরেই। আমরা ভাবি আমাদের লাভের কথা। আগে দুনিয়ার লাভ পরে দীনের লাভ। আর আল্লাহপাগলরা আগে দীনের লাভ দেখেন, তারপর দুনিয়া করেন। এর ফলে দেখা যায় তারা দুনিয়াতেও বাদশাহি করেন, আখেরাতেরও বাদশাহ হন। আসলে আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর বিদ্রোহ চলে না। ওই আল্লাহর ওলি লিখেন, ‘হে আমার আপনজনরা! আমার মৃত্যুর পর যখন তোমরা আমার থেকে বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়বে তখন আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অন্তরের মলম হিসেবে ব্যবহার কর। যা হওয়ার হয়ে গেছে। মৃত্যু আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে। এখন যত চেষ্টাই করা হোক আমি আর ফিরে আসব না। পৃথিবীর এমন কোনো প্রযুক্তি নেই, এমন কোনো আবিষ্কার নেই যে আমাকে আবার তোমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিতে পারবে। তাই তোমাদের জন্য কল্যাণজনক বিষয় হলো আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা। তার মানে এটা বলছি না যে, তোমরা আমার মৃত্যুতে কাঁদবে না বা আমার স্মৃতি এক লহমায় ভুলে যাবে। আমি বলতে চাচ্ছি, তোমরা এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট থাকবে আব্বার এতটুকুই হায়াত ছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি হাসপাতালে নিলেও, পৃথিবীর সেরা চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে থাকলেও আব্বাকে আর একমুহূর্তও বাঁচিয়ে রাখা যেত না। এটার নামই ইমান। আর যারা বিপদের সময় এমন দৃঢ় ইমানের পরিচয় দেয় তারাই আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আশা করি আমার মৃত্যুর পর তোমরা নিজেদের আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারবে।’ আসলেই তো যে প্রিয়জন আমাদের কাঁদিয়ে চলে গেছে, বিনিময়ে দোয়া ও সন্তুষ্টি প্রকাশ ছাড়া আমাদের আর কী করার আছে! তাই আসুন! আমরা প্রিয়জনকে হারানোর ক্ষতে আল্লাহর সন্তুষ্টির মলম বুলিয়ে দিই। হে আল্লাহ! আপনি সব প্রিয়জনহারাদের ধৈর্য ধরার তৌফিক দিন। আখেরাতে সবাইকে জান্নাতের বাগানে একসঙ্গে হেসে-খেলে বেড়ানোর স্বপ্ন বুকে লালনের তৌফিক দিন। আর মৃত্যুর পর সে স্বপ্ন বাস্তব করে দিন। আমিন।

                লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি          পীরসাহেব, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর