বুধবার, ২০ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

রাজনীতিতে বিরোধিতা বনাম সংঘাত

মেজর আখতার (অব.)

রাজনীতিতে বিরোধিতা বনাম সংঘাত

সংঘাতের রাজনীতির অবসান হওয়ার দরকার। রাজনীতি দেশের জন্য, জনগণের জন্য। আমি বিশ্বাস করি, যারা রাজনীতি করে তারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, সবচেয়ে সচেতন, দেশপ্রেমিক ও চৌকশ সন্তান। রাজনীতিবিদরা যদি শুধু তাদের ব্যক্তিস্বার্থে কাজ করত, তাহলে তারা সব জায়গাতেই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারত। আজ দেশে রাজনীতি নেই বলেই রাজনীতিতে শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অনুপস্থিতি। সেখানে স্থান দখল করে আছে চাটুকার ও সন্ত্রাসীরা যাদের সামনে একটিই লক্ষ্য- ছলে-বলে, কলে-কৌশলে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করা। আমরা সবাই নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত। কিন্তু মূল্য দিতে হয় ভগবানের পরে যার স্থান। আমরা সত্য শুনি না, সত্য কাউকে বলতে দেই না, তবে সময় সময় একপেশে সত্য পছন্দ করি। তাই আমাদের পরিণতি কী তা দেখে যেতে পারি না।

রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবেই-থাকতে হবেই, না হলে গণতন্ত্র থাকবে না। রাজনীতিতে বিরোধিতাকে সাধারণত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুস্থ কাজকর্মের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীন দল বা সরকারকে ভারসাম্য বা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স প্রদানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিছু কারণ যা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলে রাজনীতিতে বিরোধিতা অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয় এমন কিছু উপাদ্য নিম্নে বর্ণিত হলো :

জবাবদিহিতা : বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীন দলকে তার কর্ম ও সিদ্ধান্তের জন্য জনগণের কাছে দায়বদ্ধ রাখে। বিরোধী দল সরকারের নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে, জনগণের সামনে সরকারি ক্রিয়াকলাপ যাচাই করার সুযোগ সৃষ্টি করে এবং ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের তাদের স্বার্থ ও পছন্দমতো কাজ করার জন্য দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।

বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি : বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে বিভিন্নমুখী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে তার বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত এবং ধারণাগুলো উপস্থাপন করার সুযোগে বৈচিত্র্যময় ভালো সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে যা সর্বজন গ্রহণযোগ্য নীতি বাস্তবায়নে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

জনমতের প্রতিফলন : বিরোধী দলগুলো বিকল্প নীতি এবং সমাধান উপস্থাপন করে জনমত প্রতিফলনে অবদান রাখে। এর ফলে সরকারের গৃহীত যে কোনো নীতির উভয় পক্ষের মতামত বা ধারণার একটি পরিষ্কার চিত্র ফুটে ওঠে, যার ফলে জনগণের রাজনৈতিক পছন্দ সম্পর্কে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হয়।

কর্তৃত্ববাদের প্রতিরোধ : একটি শক্তিশালী বিরোধী দল ক্ষমতার সম্ভাব্য অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে। এটি একক দল বা ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে বাধা দেয়, কর্তৃত্ববাদের ঝুঁকি হ্রাস করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাজনৈতিক বিরোধিতা কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার সর্বোত্তম প্রতিরোধ।

সংখ্যালঘু মতামতের প্রতিনিধিত্ব করা : বিরোধী দলগুলো সব সময় সংখ্যালঘু মতামত বা প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে যা সাধারণত ক্ষমতাসীন দল গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে চায় না বা যথোপযুক্ত সমাধান দিতে চায় না। সক্রিয় বিরোধী দল যে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় জনগণের স্বার্থের একটি বিস্তৃত পরিসর বিবেচনায় নিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

জনবান্ধব সরকার : একটি কার্যকর বিরোধী দলের উপস্থিতি ক্ষমতাসীন দলকে জনগণের চাহিদা এবং উদ্বেগের প্রতি আরও সংবেদনশীল বা দায়বদ্ধ হতে অনেক বেশি সহায়তা করে। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে যার ফলে রাজনৈতিক সত্তাগুলোকে জনসমর্থন পেতে ও ধরে রাখতে কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য করে।

গণতান্ত্রিক নিয়ম : একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গণতান্ত্রিক নিয়ম ও মূল্যবোধ রক্ষায় অবদান রাখে। এটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, বাকস্বাধীনতা এবং অন্যান্য মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের নীতিগুলোকে সমুন্নত রাখতে সাহায্য করে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সক্রিয় এবং শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতি কোনো অবস্থাতেই সুষ্ঠু নির্বাচন, বাকস্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখাকে নিশ্চিত করে না। যদিও রাজনীতিতে বিরোধিতাকে সাধারণত অপরিহার্য বলে মনে করা হয় তারপরও রাজনৈতিক সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের শক্তি এবং গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি রাজনৈতিক নেতৃত্বের অঙ্গীকারের মতো কারণের ওপর নির্ভর করে এর কার্যকারিতা পরিবর্তিত হতে পারে। রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষ একটি সুস্থ গণতন্ত্র তথা স্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থার জন্য একটি ভারসাম্য বজায় রাখা যেখানে গুরুত্বপূর্ণ সেখানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি না করে বা শাসন ব্যবস্থাকে বাধা না দিয়ে কার্যকরভাবে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এবং দেশ ও জনগণের স্বার্থে ইতিবাচক পদক্ষেপ রাখতে পারে। রাজনীতিতে বিরোধিতার সুযোগ আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দুটি শর্ত পেলাম যথা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি না করে বা শাসন ব্যবস্থাকে বাধা না দিয়ে- এই শর্ত দুটি পালন সাপেক্ষে রাজনৈতিক বিরোধিতা করা যাবে এবং কোনো অপরাধ বলে গণ্য হবে না। যদিও বাহ্যিকভাবে দুটিই শর্তই এক রকম। তারপরও আমরা দেখে নেই এর বিস্তৃত বা সুদূরপ্রসারী মানে কী?

সরকারে অস্থিতিশীলতা এমন একটি পরিস্থিতিকে বোঝায় যেখানে একটি সরকার তার ধারাবাহিকতা রক্ষায় এবং কার্যকর শাসন প্রদান করতে অক্ষম হয় এবং যা প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। সরকারের অস্থিরতার কিছু সাধারণ সূচকের মধ্যে-

রাজনৈতিক অস্থিরতা : রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাব বা নেতৃত্বে ঘন ঘন পরিবর্তন হলে এমনটি ঘটে থাকে। এটি অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াই, জোট ভাঙন বা সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার অভাবের ফলে হতে পারে।

নীতির অস্থিরতা : নাগরিক এবং ব্যবসার জন্য একটি স্থিতিশীল পরিবেশ প্রদানের জন্য সরকারের ধারাবাহিক সুনির্দিষ্ট নীতি প্রয়োজন। যদি নীতিগুলো ঘন ঘন পরিবর্তিত হয় বা ধারাবাহিকতার অভাব হয়, তবে এটি অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যেতে পারে যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ফলে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে।

সামাজিক অস্থিরতা : সরকারের প্রতি জনগণের অসন্তোষ বিক্ষোভ, রাজপথে অহিংস আন্দোলন বা এমনকি দাঙ্গার দিকে নিয়ে যেতে পারে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো কারণগুলো সামাজিক অস্থিতিশীলতায় অবদান রাখতে পারে।

অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা : সরকার নিজেই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি অর্থনৈতিক নীতিগুলো অসঙ্গতিপূর্ণ হয় বা খারাপভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এর ফলে অর্থনৈতিক মন্দা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা : একটি অস্থিতিশীল সরকার দুর্বল প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যেমন একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অভাব, অকার্যকর আইন প্রয়োগকারী বা দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র। তাই আইনের শাসন ও সুশাসনের জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান অপরিহার্য।

দুর্নীতি : একটি সরকারের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি তার স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে। এটি জনসাধারণের আস্থা নষ্ট করে, প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো থেকে সম্পদকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং অন্যায় ও অসমতার পরিবেশ তৈরি করে।

নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ : সরকারকে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নিরাপত্তা বজায় রাখতে হবে। সন্ত্রাস, বিদ্রোহ বা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের মতো কারণ থেকে অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক : দুর্বল কূটনৈতিক সম্পর্ক বা অসঙ্গতিপূর্ণ বৈদেশিক নীতি সরকারের অস্থিতিশীলতায় অবদান রাখতে পারে। বিচ্ছিন্নতা বা অন্যান্য জাতির সঙ্গে সংঘাত বা যুদ্ধ সরকারের কার্যকরভাবে শাসন করার ক্ষমতার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। সামগ্রিকভাবে সরকারের অস্থিতিশীলতা বিভিন্ন আন্তসংযুক্ত কারণের সঙ্গে একটি জটিল সংমিশ্রণের অন্যতম ফলাফল। স্থিতিশীল সরকার একটি দেশের উন্নয়ন, তার নাগরিকদের মঙ্গল এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে তার অবস্থানের জন্য উল্লেখযোগ্য অবস্থান তৈরি করতে পারে। তাই একটি সরকারের স্থিতিশীলতা মূলত ওই সরকারের নীতি, কার্যকলাপ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, স্বচ্ছতা ও বৈদেশিক নীতি ও কার্যকলাপের ওপর নির্ভর করে যেখানে রাজনৈতিক বিরোধীদের তেমন কিছু করার থাকে না। কাজেই কোনো রাজনৈতিক বিরোধীরা কখনই সরকারের স্থিতিশীলতা বিগ্ন বা বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। যদিও সরকার তার ব্যর্থতা ও অস্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থার জন্য বিরোধী দল বা দলগুলোকেই অব্যাহতভাবে দায়ী করে যাবে। তবে বিরোধী দল চৌকশ হলে সরকারকেই উল্টো বেকায়দায় পড়তে হয়। রাজনীতির সারবত্তাই হলো রাজনীতিতে বিরোধিতা। বিরোধিতা ছাড়া কোনো রাজনীতি জমে না। এবার আলোচনা করা যাক দ্বিতীয় শর্তটি নিয়ে। বিভিন্ন কারণ শাসন ব্যবস্থাকে বাধা বলতে কী বোঝানো হয়। কিছু সাধারণ চ্যালেঞ্জ এবং সরকারের কাজে বাধা বলে বিবেচিত হয় এমন কিছু উপাদান নিয়ে নিম্নে আলোচনা করছি-

দুর্নীতি : সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুর্নীতি সরকারের কার্যকর কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যখন কর্মকর্তারা ঘুষ, আত্মসাৎ বা অন্যান্য দুর্নীতিমূলক অনুশীলনে জড়িত হন, তখন এটি জনগণের আস্থাকে ক্ষুণ্ণ করে এবং দক্ষতার সঙ্গে পরিষেবা প্রদানের সরকারের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে।

স্বচ্ছতার অভাব : সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতার অভাব জনগণের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি করতে পারে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্যের অবাদ প্রবাহ না থাকলে নাগরিকরা সরকারি পদক্ষেপের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।

আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্ম্য : অত্যধিক আমলাতন্ত্র এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে দিতে পারে এবং নীতিগুলোর দক্ষ বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়ার জটিল ও দীর্ঘসময়ের কষ্টকর পদ্ধতি এবং অপ্রয়োজনীয় প্রবিধান সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব এবং অদক্ষতার কারণ হতে পারে যা কার্যত সরকারের কাজে বাধা হিসেবেই দাঁড়িয়ে যায় এবং এর জন্য সরকার নিজেই একমাত্র দায়ী।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : সরকারের ঘন ঘন পরিবর্তন বা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সরকারের নীতি ও কর্মসূচির ধারাবাহিকতা ব্যাহত করতে পারে। নেতৃত্বের অনিশ্চয়তা যা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবের কারণ হতে পারে এবং শাসনের সামগ্রিক কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। এখানে বিরোধী দল বা দলগুলোকে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে, যাতে তাদের অতিমাত্রার বিরোধিতা যেন তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।

অপর্যাপ্ত তহবিল : আর্থিক সম্পদের ঘাটতি সরকারের প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদন এবং প্রয়োজনীয় পরিষেবা প্রদানের ক্ষমতাকে সীমিত করতে পারে। অপর্যাপ্ত তহবিলের ফলে অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও মৌলিক চাহিদা পূরণে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবার অভাব হতে পারে।

দুর্বল অবকাঠামো : যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, পরিবহন ব্যবস্থা এবং জনসেবাসহ অপর্যাপ্ত বা দুর্বল বা পুরনো অবকাঠামো, কার্যকরভাবে নাগরিকদের কাছে পৌঁছানোর এবং পরিষেবা দেওয়া সরকারের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

দক্ষ জনবলের অভাব : সরকারি সংস্থার মধ্যে দক্ষ ও যোগ্য লোকবলের অভাব তাদের কার্যকর নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। দক্ষ শাসনের জন্য একটি যোগ্য এবং প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সামাজিক অস্থিরতা : সামাজিক অস্থিরতা, বিক্ষোভ এবং আইন অমান্য সরকারি কার্যাবলি ব্যাহত করতে পারে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। স্থিতিশীল শাসনের জন্য সামাজিক অসন্তোষের মূল কারণগুলোকে মোকাবিলা করা অপরিহার্য।

বাহ্যিক চাপ : বাহ্যিক কারণগুলো, যেমন আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক মন্দা বা বৈশ্বিক সংকট, সরকারি কার্যাবলিতে  চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। এই চাপগুলোর জন্য সময়োচিত পদক্ষেপ এবং টেকসই শাসন কৌশল অবলম্বন করার প্রয়োজন হতে পারে।

প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ : প্রযুক্তির অপর্যাপ্ত ব্যবহার বা সেকেলে প্রযুক্তিগত অবকাঠামো সেবা প্রদান, ডেটা ব্যবস্থাপনা এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে সরকারের দক্ষতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

আইনি ও নিয়ন্ত্রণমূলক চ্যালেঞ্জ : অতিমাত্রায় জটিল বা পরস্পরবিরোধী আইন ও প্রবিধান কার্যকর শাসনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। আইনি চ্যালেঞ্জ এবং বিচারবিভাগীয় হস্তক্ষেপও সরকারের কার্য সম্পাদনের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

তথ্য দমন : সরকার তথ্যের প্রবাহ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সীমিত করে বা সেন্সরশিপে নির্ভরশীলতা স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, যা নাগরিকদের জন্য সচেতন থাকা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা কঠিন করে তোলে। ফলে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়, বিকল্প তথ্য প্রবাহ এবং গুজব ছড়ানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, স্বচ্ছতামূলক ব্যবস্থা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা জোরদার করার প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা থাকা প্রয়োজন। একটি সক্রিয় এবং জবাবদিহিমূলক সরকার এই চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করতে এবং কার্যকরভাবে তার নাগরিকদের সেবা করার জন্য আরও ভালোভাবে সজ্জিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এখন সরকার যদি তার রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা তার সদিচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, স্বচ্ছতামূলক ব্যবস্থা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা জোরদার করার প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা নিয়ে রাষ্ট্র শাসন করে তাহলে সেখানে তো রাজনৈতিক বিরোধীদের শাসন ব্যবস্থাকে বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। রাজনীতি বলতে আমি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকলাপকে বোঝাতে চাচ্ছি। এখানে বিচ্ছিন্নতাবাদি, আদর্শবাদী, ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রত্যাশী কোনো দল বা গোষ্ঠীর বা বিশ্বাসীদের কথা বলছি না। তারা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বা অস্ত্র ও অর্থের শক্তিবলে তা প্রতিষ্ঠা করতেই পারে। আমার বক্তব্য হলো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল নিয়ে। সরকারের বিরোধিতা করা কোনো পাপ নয়, কোনো অপরাধ নয়। সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী কোনো অপরাধী নয়। রাজনীতির বিরোধিতা করার অধিকার বিবেচনায় নিয়ে সব রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে সরকারের আনা সব অভিযোগ সেই বিবেচনার আলোকে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকেই দায় নিতে হবে রাজনৈতিক কর্মকান্ড নির্ধারণে। যে কোনো রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে যে কোনো ফৌজদারি বা আদালতি মামলা হতে পারে এবং তার জন্য বিচার হতে পারে। তাতে কারও কোনো অভিযোগ থাকার সুযোগ নাই। কিন্তু রাষ্ট্র যদি বিশ্বাস ভঙ্গ করে রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে কোনো রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় তাহলে সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সবার সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। উচ্চ আদালত ক্ষমতা ছিনতাইকে দন্ডবিধির আওতায় আনার ফলে এখন সরকার নিরাপদ হয়েছে কিন্তু নিরাপদ সরকারের আইনবহির্ভূত প্রভাব ও প্রতাপে রাজনৈতিক বিরোধিতা এখন দন্ডবিধির আওতায় অমার্জনীয় অপরাধে পরিণত হয়েছে যার ফলে নিরীহ বিচারকরা রক্তচক্ষুর ভয়ে সাজা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

আমরা বিচারের নামে অনেক প্রহসন দেখেছি। ১৫ আগস্ট ৭৫-এর পর থেকে দেখেছি কীভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নির্বিচারে নিধন করা হয়েছে, আমরা দেখেছি রাজনীতির নামে জাতির পিতা ও তার পরিবারকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করার সমগ্র জাতির কলঙ্ককে, আমরা দেখেছি কীভাবে আইন ও সংবিধানের দোহাই দিয়ে হত্যার বিচারকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে, আমরা দেখেছি কীভাবে বিচারের নামে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়েছে, আমরা দেখেছি কীভাবে রাজনৈতিক বিরোধীদের গুম ও খুন করা হয়েছে। চরম দুর্ভাগ্য হলো, সবই করা হয়েছে রাজনীতির নামে এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করার নামে এবং স্থিতিশীল সরকার ও শাসন ব্যবস্থাকে বাধা মুক্ত রাখার জন্য। কেউ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ইতিবাচকভাবে মোকাবিলা করতে চাই নাই। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। অনেকেই আবার শুধু রাজনীতির নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিধন করতে চেয়েছে-কখনো কেউ সরকারে থেকে আবার কেউ কেউ বিরোধী দলে থেকে। অথচ এই মরণখেলার রাজনীতিতে সমাপ্তি টেনেছে নিজের মৃত্যু বা কারাগারে জীবন কাটিয়ে। সাধু সাবধান।

লেখক : স্বতন্ত্র চিন্তাদর্শী ও কর্মী

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর