শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

বসন্তে রমনা পার্কের ফুল ও পাখিরা

তপন কুমার ঘোষ

বসন্তে রমনা পার্কের ফুল ও পাখিরা

রাজধানী ঢাকার ‘ফুসফুস’ হিসেবে খ্যাত রমনা পার্ক চার শ বছরের পুরনো। গণপূর্ত অধিদফতর ও স্থাপত্য অধিদফতর ঐতিহ্যবাহী এ পার্কটি দেখভাল করে। রমনায় রোজ সকালে প্রাতর্ভ্রমণে যাই। ‘পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল/কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল।’ মদনমোহন তর্কালঙ্কার রচিত এই কবিতাটির সঙ্গে পরিচিত নন এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। পার্কের মনোরম পরিবেশ এই কবিতাটি মনে করিয়ে দেয়। ইট-কাঠ-পাথরের প্রাণহীন এই শহরে একটু হলেও স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দেয় সকালের রমনা পার্ক।

রাত পোহালেই রমনা হাতছানি দেয়। ভোরের সূর্য তখন ওঠার অপেক্ষায়। রমনার সূর্যোদয় মুগ্ধতা ছড়ায়। পাতার ফাঁক গলিয়ে এক মুঠো রোদ এসে মাটি স্পর্শ করেছে। যেন ওপর থেকে টর্চের আলো এসে পড়েছে মাটিতে। সকালের মিষ্টি রোদ। উত্তাপ কম। উপভোগ করার মতোই। গাছের কচি পাতায় রোদের ঝিকিমিকি মনকে সজীব করে। 

এখন বসন্তকাল। ফুল ফোটার ঋতু। প্রকৃতিতে তাই রঙের ছোঁয়া লেগেছে। রমনা পার্কের গাছে গাছে নানা রঙের ফুল উঁকি দিচ্ছে। ফুটেছে লাল পলাশ। গাছ থেকে পলাশ ফুল ঝরে পড়েছে মাটিতে। মহুয়া চত্বরের কাছেই বেশ কয়েকটি অশোকের গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ অশোক ফুল। ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে।’ চোখ ফেরানো যায় না। গোলচত্বরের বৃত্তাকার বেষ্টনীর মধ্যে সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সূর্যমুখী ফুল। হাঁটার পথের ধারে একই গাছে সাদা ও বেগুনি রঙের অসংখ্য ফুল ফুটে আছে। ফুলের নাম ব্রুনফেলসিয়া। নামটি বড্ড কঠিন। গাছও যে মানুষের মতোই সুন্দর করে নিজেকে সাজাতে পারে, তা এটা দেখে বোঝা যায়। সদ্য ফোটা ফুলের মিষ্টি গন্ধ আপনাকে ঠিকই আকর্ষণ করবে। বেগুনি রঙের ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে উঁচু বৃক্ষের ডালে। রাশি রাশি ফুল ঝরে পড়েছে মাটিতে। লাল সিরামিকের ইটের ওয়াকওয়ে ঢেকে গেছে বেগুনি রঙে। কী অপরূপ সে দৃশ্য। অনেকে মুঠোফোনে ধারণ করছেন সেই দৃশ্য। এই ফুলের নাম জানা নেই। যাকে পাই তাকেই শুধাই। ফুলটির নাম মণিমালা, জানালেন প্রাতর্ভ্রমণে আসা প্রকৃতিপ্রেমী নীরা মজুমদার। টগর, কাঞ্চন, রঙ্গন-এমনি চেনা-অচেনা নানা ফুলের সমাহারে মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়। গাছে ফুটে থাকা ফুলের ওপর চঞ্চল মৌমাছিরা ভিড় করেছে। ফুলের মধু আহরণে ব্যস্ত। এদিক-ওদিক ওড়াউড়ি করছে ফড়িং। আম গাছে মুকুল এসেছে। আমের বোলের চেনা গন্ধ শিশুকালের কথা মনে করিয়ে দেয়। হাঁটার পথের পাশে নুইয়ে পড়েছে আম গাছের ডাল। একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে আমের মুকুল।

সবুজ পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোকিলের কুহুতান মনকে আন্দোলিত করে। মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়া হৃদয়ে দোল দেয়। ঘুঘুর ডাক শুনলে ছেলেবেলার কথা খুব মনে পড়ে। ফিরে যাই আমার সেই ছোট্ট গ্রামে। এক জোড়া শালিক মাটিতে নেমে এসেছে। খুটে খাচ্ছে। প্রবাদ আছে, ‘এক শালিকে রাগ, দুই শালিকে ভাব।’ শালিক দেখলে ওই প্রবাদটির কথা মনে পড়ে যায়। আশপাশে তার সঙ্গী খুঁজি। আর মনে মনে ভাবী, কুসংস্কার আমার মনেও বাসা বেঁধেছে।

ছবি কথা বলে। অনেকেই মুঠোফোনে রমনা পার্কের ছবি তুলে রাখেন। আমার দুজন সুহৃদ রমনায় প্রায় নিয়মিত। রমনার বৃক্ষরাজি, পাখপাখালি, ফল ও ফুল, লেক, লেকের পাড় ঘেঁষে কাঠের ডেক, ঘাটে বাঁধা রংবেরঙের ছোট ছোট বোট-কিছুই তাদের চোখ এড়ায় না। বিশেষ কিছু চোখে পড়লে মুঠোফোনের ক্যামেরায় তা বন্দি করে রাখেন। ঘরে ফিরে এসে ফেসবুকে তা শেয়ার করেন। এঁদের একজন সিনিয়র সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার। অপরজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী স্বপন দত্ত। বিভুরঞ্জন সরকারের আগ্রহ মুখ্যত রমনার বৃক্ষরাজি। আর স্বপন দত্তের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রমনার ফুল ও পাখিরা।

যেখানে-সেখানে কাকেদের জটলা দেখে মনে হতেই পারে, কাকেদের স্বর্গ রমনা পার্ক। উঁচু গাছের ডালে বাসা বেঁধেছে কাক। শিশুকালের মতোই কৌতূহল, কখন মা-কাক ঠোঁটের মধ্যে আধার লুকিয়ে এনে ছানার মুখে গুজে দেবে। খাবারের সন্ধানে গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায় কাঠবিড়ালি। কাঠবিড়ালিদের দুরন্তপনা দেখে বাচ্চারা খুব মজা পায়। রমনায় কাঠঠোকরা পাখির দেখাও মেলে।

গাছের শুকনো পাতারা ঝরে পড়েছে মাটিতে। কবিগুরু গেয়েছেন, ‘ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে।’ ন্যাড়া গাছের শূন্যতায় মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায়। আবার নতুন গজিয়ে ওঠা সবুজ কচি পাতায় চোখ জুড়িয়ে যায়। ঝরা পাতা একটা বার্তা দেয়। একদিন আমরাও এ ভাবে। তবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোনো মানে হয় না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে।’ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতায় এই সত্যটি তুলে ধরেছেন। প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়ম খন্ডানোর সাধ্য কারও নেই। যা অনিবার্য তা সহজভাবে গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। বিষণ্ণতা ঘোচাতে খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসতেই হবে। প্রতিদিন ভোরে ফজরের নামাজ আদায় শেষে সরাসরি রমনায় চলে আসেন অনেকে। কিন্তু পবিত্র রমজান মাসে রমনা পার্ক অনেকটাই ফাঁকা। ঈদের পর রমনা আবার হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত।

লেখক : সাবেক পরিচালক পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন

 

 

সর্বশেষ খবর