সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

দূরদর্শী রাজনীতিক কাজী আরেফ আহমেদ

কাজী সালমা সুলতানা

দূরদর্শী রাজনীতিক কাজী আরেফ আহমেদ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম কাতারের যোদ্ধা কাজী আরেফ আহমেদ। ১৯৪২ সালের ৮ এপ্রিল তিনি কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে তিনি রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন। ষাট দশকে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে তার রাজনীতিতে সরব পদচারণ শুরু। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত বাঙালির মুক্তির সনদ ‘ছয় দফা’ এগিয়ে নেওয়া, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত নির্ধারণ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা, বাষট্টির নিউক্লিয়াস (সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে) স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠন তথা মহান মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭০ সালে গঠিত জয় বাংলা বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন কাজী আরেফ। মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরের উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব ছাড়াও বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর চারটি সেক্টরের সঙ্গে হাইকমান্ডের একজন হিসেবে সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন কাজী আরেফ। মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা শাখার প্রধান ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তিনি জনযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে গঠন করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজতন্ত্র গণমানুষের মুক্তির একমাত্র পথ।

সামরিক শাসক স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনেও তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। নব্বই দশক থেকেই কাজী আরেফ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন। সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনায় জাগ্রত করার জন্য তাগিদ দেন। কাজী আরেফ ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার কালিদাসপুরে একটি জনসভায় বক্তব্যরত অবস্থায় নির্মম হত্যার শিকার হন। ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এ হত্যাকান্ডের মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ৯ আসামির মধ্যে তিন আসামি (বারেক, নুরুল মেলেটারি, হাবুল মোল্লা) রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামি রওশন আলী ২০২১ সালে গ্রেফতার হলেও তার ফাঁসির রায় আজও কার্যকর করা হয়নি। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় (১৯৯৯) কাজী আরেফ একটি সাক্ষাৎকার দেন, সেই সাক্ষাৎকারে সতর্কসংকেত দেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘এটা ছোট দেশ, এখানে কে কী করছে সবারই জানা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো এই যে সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এসব অপশক্তির সঙ্গে আপস করে। অপশক্তির সঙ্গে আপস করলে কোনো সরকারই ভালো কাজ করতে পারে না। কেননা তখন নিজেও অপশক্তি হিসেবে চিহ্নিত হতে হয়।’ আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রজন্মকে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, মানুষের চাওয়া-পাওয়ার কিছু অংশ না করতে পারলে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত দেশ না গড়তে পারলে বাংলাদেশে স্বাভাবিকভাবেই বিকল্প শক্তিই ক্ষমতাসীন হবে, তারা শাসন করবে এবং শক্তিশালী হবে।

কাজেই মানুষকে কিছু দিতে হবে। এটাও ঠিক যে, সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু মানুষকে কিছু দেওয়ার চেষ্টা তো করতে হবে। তা না করে ক্ষমতাসীন দল লুটপাট করতে থাকবে। তাদের ব্যাংক ব্যালান্স ফুলে-ফেঁপে বড় হবে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন এই সমাজে ঘটবে না-মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকতে পারবে না।’ আসলে আমরা যে জন্য যুদ্ধ করেছিলাম, জনগণ যে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছিল সেই স্বাধীনতার যুদ্ধ একটি মানচিত্র বা একটি পতাকা পাওয়ার জন্য ছিল না। জনগণের মুক্তি ছিল সবচেয়ে বড় কথা। এই মুক্তি অর্থনৈতিক উপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রীয় মুক্তি।

এই মুক্তির মধ্যে সবকিছুই জড়িত ছিল। এই মুক্তি শুধু সীমানার মুক্তি ছিল না। আমরা তো পাকিস্তান ধর্মরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলাম আরেকটি ধর্ম রাষ্ট্রের জন্য না। আমরা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চেয়েছি। এটি সমাজে যেমন চেয়েছি, তেমন রাষ্ট্রব্যবস্থায়। কাজী আরেফ আহমেদের জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তার জীবন পরিপূর্ণ ছিল এক সংগ্রামী চেতনা নিয়ে, যে চেতনাজুড়ে ছিল মানুষের মুক্তির গান। তার জীবন ছিল দেশ ও মানুষের মুক্তির জন্য নিবেদিত।

                লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

সর্বশেষ খবর