সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

অলস পুঁজির বৃত্ত ভাঙে জাকাত

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

অলস পুঁজির বৃত্ত ভাঙে জাকাত

মুজামুল ওয়াসিত প্রণেতার মতে, জাকাত শব্দের অর্থ ক্রমশ বাড়তে থাকা ও পরিমাণে বেশি হওয়া, প্রবৃদ্ধি লাভ করা, পরিচ্ছন্ন হওয়া, পবিত্র ও শুদ্ধ হওয়া। বিখ্যাত আরবি অভিধান লিসানুল আরবের লেখক বলেন, ‘জাকাত অর্থ পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ও প্রশংসা। এ চারটি অর্থেই কোরআন ও হাদিসে জাকাত শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়।’ ইমান নববী (রহ.) বলেন, ‘ধন-সম্পদ থেকে আল্লাহর নির্ধারিত সম্পদ বের করে দেওয়াকে জাকাত বলার কারণ হলো, এর বিনিময়ে সম্পদ ক্রমশ বাড়তে থাকে আর জাকাতদাতা অনেক বিপদ-আপদ থেকে পবিত্র থাকে।’ (ফিকহুজ জাকাত)।

ইবনে কুদামা (রহ.) আল মুগনিতে জাকাতের সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছেন-‘হাক্কু ইয়াজিবু ফিল মাল। অর্থাৎ সম্পদে এমন একটি অধিকার যা দিয়ে দেওয়া আবশ্যক।’ ইমাম শাওকানি নাইলুল আওতারে লিখেছেন- ‘নেসাব থেকে একটি অংশ এমন কোনো অভাবীকে দান করা, যার মাঝে জাকাত নেওয়ার কারণগুলো বিদ্যমান থাকে।’ আল মাজহাবিল আরাবায়ার লেখক বলেছেন, ‘সম্পদের একটি বিশেষ অংশ বিশেষ শর্তমতে তার প্রাপককে বুঝিয়ে দেওয়াকে শরিয়তের পরিভাষায় জাকাত বলা হয়।’

জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া শর্ত। জাকাতের নেসাব হলো, সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা বা সমমূল্যের নগদ অর্থ, বন্ড, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, ব্যাংকে জমাকৃত যে কোনো ধরনের টাকা, ফিক্সড ডিপোজিট হলে মূল জমা টাকা অথবা সমমূল্যের ব্যবসার পণ্য থাকলে জাকাত আদায় করতে হবে। স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ ও বুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিম নর-নারী যার কাছে ঋণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও প্রয়োজনীয় খাদ্যবস্ত্রের অতিরিক্ত সোনা, রুপা, নগদ টাকা, প্রাইজবন্ড, সঞ্চয়পত্র, ডিপিএস, শেয়ার ও ব্যবসায়িক সম্পত্তির কোনো একটি বা সবকটি রয়েছে, যার সমষ্টির মূল্য উল্লিখিত নেসাব পরিমাণ হয়, তিনিই সম্পদশালী। এই পরিমাণ সম্পদ এক বছর স্থায়ী হলে বা বছরের শুরু ও শেষে থাকলে বছর শেষে জাকাত দিতে হবে।

অপ্রাপ্তবয়স্ক অথবা এতিম বালক-বালিকা কিংবা পাগল কেউ যদি সাহেবে নেসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হয় তাহলে ফকিহদের একাংশের মত হলো তাদের সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ নয়। দ্বিতীয় একদল আলেমের মতে, অপ্রাপ্তবয়স্ক সাহেবে নেসাব যখন বড় হবে, এতিম যখন নিজের সম্পদ বুঝে পাবে এবং পাগল যখন সুস্থ হবে তখন সে হিসাব করে নিজের সম্পদ থেকে বিগত বছরের জাকাত একবারে আদায় করে দেবে। ফকিহদের তৃতীয় দল বলেন, এ ধরনের সাহেবে নেসাবের অর্থ-সম্পদ যদি কোনো ব্যবসায় খাটানো হয় আর তা থেকে লাভ আসতে থাকে তাহলে যাদের দায়িত্বে সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে তারা হিসাব করে জাকাত দিয়ে দেবেন। চতুর্থ মতটি হলো- এতিম-অপ্রাপ্তবয়স্ক ও পাগলের সম্পদের ওপর জাকাত আবশ্যক। অভিভাবকরা হিসাব করে এদের সম্পদ থেকে জাকাত দিয়ে দেবেন। আসলে অর্থ-সম্পদ অলস ফেলে রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংকট সৃষ্টি করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সম্পদ কুক্ষিগত রাখা ইসলাম একেবারেই পছন্দ করে না। তাই তো রসুল (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান! কেউ যদি এতিমের অর্থ-সম্পদের অভিভাবক হয় তার উচিত সে সম্পদকে ব্যবসায় খাটিয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা। পুঁজি ফেলে রেখে বছরে বছরে জাকাত দিয়ে সম্পদের পরিমাণ কমিয়ে ফেলা অভিভাবকের জন্য উচিত নয়।’ (তিরমিজি ও বায়হাকি শরিফ)। সম্পদশালী যদি জেলবন্দি হয় তার সম্পদেরও জাকাত আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে যিনি কয়েদির অনুপস্থিতি সম্পদ বা ব্যবসা দেখাশোনা করছেন তিনিই জাকাত আদায় করে দেবেন। ইবনে কুদামা লিখেছেন- ‘নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক যদি কারারুদ্ধ হয়ে পড়ে, তবুও তাকে সম্পদের জাকাত দিতেই হবে। কেননা যদিও সে কারারুদ্ধ কিন্তু আইন তাকে ব্যবসায় পরিচালনা করতে কিংবা কেনাবেচা ও লেনদেন করতে নিষেধ করেনি। ফলে সে জাকাতের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে পারে না।’ (আল মুগনি)। একইভাবে কোনো সম্পদশালী যদি মুসাফির হন তবু তাকে জাকাত দিতে হবে। সম্পদশালী যদি এমন পরিস্থিতিতেও পড়েন যে, সফরে সে অসহায় হয়ে পড়েছে এবং নিজেই জাকাতের অর্থ দিয়ে খরচ জোগাচ্ছেন, তবু সে জাকাতের ফরজিয়াত থেকে বাঁচতে পারবে না। সফর শেষ হলেই কিংবা তার অবর্তমানে যে সম্পদ দেখাশোনা করছেন তিনি জাকাত আদায় করে দেবেন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীরসাহেব, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর