রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

রাজনীতিবিমুখ প্রজন্ম : দায় কার

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

রাজনীতিবিমুখ প্রজন্ম : দায় কার

একটা জেনারেশনকে রাজনীতিবিমুখ আর স্বার্থপর করে গড়ে তুলে জাতির যে সর্বনাশ করছি- তার দায় কে নেবে। ছাত্র-সমাজের মধ্যে রাজনীতিবোধ জন্মাতে না দিয়ে আমরা একটি স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক প্রজন্ম তৈরি করছি। আপনার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন আত্মকেন্দ্রিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার মহাপ্রতিযোগিতায় নিমগ্ন অভিভাবকরাও। কে কার আগে ভোগবিলাসের জীবন ভাসাতে পারবে, শুধু নয়নভরে তা-ই দেখবেন। সর্বনাশা পরিণতি ভেবে অশ্রু ফেলে হতাশায় ভুগবেন। এ প্রজন্মকে নিছক ক্যারিয়ার সচেতন করতে গিয়ে তাদের সমাজ-সচেতনতায় ব্যাপক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালের ঘটনাগুলো ছাত্রছাত্রীদের মনে কোনো প্রভাব ফেলে না। ফলে এ প্রজন্ম সুস্থ-সচেতন চিন্তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এদের মনে দয়ামায়া সহানুভূতির ইন্দ্রিয় ম্রিয়মান। স্বার্থের বণ্টনে তারা নিজের ভাইবোনকেও সহ্য করতে পারে না।

আমাদের যৌথ পরিবারে অনেক ভাইবোন একসঙ্গে চলেছি। খেলনা ভাগ করে খেলেছি, অল্প খাবার অনেক ভাইবোন ভাগ করে খেয়েছি। একজন খেতে গেলে অন্যজনের কথা ভেবেছি। এখনকার জেনারেশন ভাগ দেওয়া সহ্য করতে পারে না। আপনজনের সঙ্গে তুচ্ছ স্বার্থ নিয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে। সচ্ছল পরিবারে প্রবণতা বেশি। বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা লেগেই আছে, মুখ দেখাদেখি বন্ধ। আমার মা এখনকার মায়েদের মতো উচ্চশিক্ষিত নন। সন্ধ্যায় চেরাগ হারিকেনের পাশে মাদুরের ওপর বসে শিক্ষা দিতেন মারামারি করবা না সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরবা। কারও গাছের ফল পাড়বা না। মুরুব্বিদের মান্য করবা। দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াবা। যা খাবা বাড়ির সবাই মিলে খাবা। কাজের লোক, মৌলভী সাহেব, জাইগির, ভাইবোন সবাই একই খাবার খেতাম।

বাড়িতে মেহমানের আগমন হলে রীতিমতো আনন্দের উৎসব হতো। পুকুরে জাল ফেলে বড় রুই-কাতলা, পাঙ্গাশ মাছ ধরা হতো। দড়া জাল দিয়ে মাছধরা সে এক মহা ফুর্তির কর্ম। মাছ লাফিয়ে শূন্যে লেজ আঁকাবাঁকা করে পানিতে আছাড় খেয়ে পড়ত, সঙ্গে সবাই শিহরিত হয়ে কণ্ঠে আওয়াজ তুলত উপ! ওই যে! আরও কত আনন্দ প্রকাশের অভিব্যক্তি। মোরগ ধরা হতো। বড় কুটুম হলে খাসি জবাই হতো। প্রতিবেশীরা মিলে রান্নার আয়োজন করত। কেউ মাছ কাটে, কেউ গোস্ত কাটে, কেউ মসলা বাটে, কেউ পুকুরের ঘাটে বড় হাঁড়ি-কড়াই ছাই দিয়ে বালু দিয়ে ঘষে মেজে পরিষ্কার করত। সেই সময়ের হরেক রকমের পিঠা তৈরির দৃশ্য আজও চোখে ভাসে।

দেখতাম মা-চাচিরা সংসারের কাজে হাড়ভাঙা খাটুনির পর নিজে সবার পরে খাবার খেতেন। সেই মা-চাচিরা তরকারির তলানিতে পানি আর মসলার উচ্ছিষ্ট লবণ মিশ্রিত জমা গাদ দিয়ে খেতেন। কড়াইতে ভাত ঘষে মেখে তাই দিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে খেতেন। এমন করেই তাদের ত্যাগের উপমা দেখে আগের জেনারেশন ত্যাগ শিখেছে। আমার গ্রামের মা তিনি মানবপ্রেম, ত্যাগের মহিমা শিক্ষা দিয়েছেন আমাদের। এখনকার শিক্ষিত পরিপাটি মায়েরা বেশির ভাগ গৃহকর্মী ড্রাইভারকে দেখি তলানির ছিটেফোঁটা খেতে দেন। নিজেরা খাওয়ার পর তরকারি সরসটুকু বাটিতে বেড়ে ফ্রিজে মজুত করেন। আর এ খাবার যারা কুটাবাটা রান্নাবান্না করে দিল তাদের জন্য হোমিওপেথির ডোজের মতো শুকনা জীর্ণ ক্ষুদ্র তরকারি বেড়ে দেয়। আমার সামনে অনেকে এমন কার্পণ্যের লজ্জাকর বেইনসাফি বণ্টন করেছে। তা দেখে আমি দগ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করেছি। ঠাঁটবাট সর্বস্ব এরা শুদ্ধ কথা বলে, এরা শিক্ষিত বলে জোর দাবি করে। শুধু সনদধারী শিক্ষিত। কারও সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক নেই। এই ধারা স্বাধীনতার পর থেকে আধুনিকতার হাত ধরে চলতে শুরু করে এখন সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। এক ভদ্রলোক আমাকে অভিযোগ করলেন তিনি ৩০০ কিলোমিটার সারা রাত জেগে দুটি ফেরি পার হয়ে ঢাকায় বড় ভাইয়ের কোয়ার্টারে আসেন ভোরে। উনার ভাবি দরজা খুললেন না। অনেক মিনতি করলেন তিনি ক্লান্ত প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন, কিছুতেই দরজা খুললেন না। এমন জননীরা নিজের অজান্তে সন্তানদেরও আপনজন থেকে দূরত্বে রেখে তাদের স্বার্থপর করে গড়ছেন। তার সঙ্গে রাজনীতিবিমুখ জেনারেশন তৈরি হচ্ছে, বাঙালির ত্যাগের আতিথেয়তার ঐতিহ্য কোথায় যাবে। সমাজ এই স্বার্থপরতার অভিশাপ বহন করতে পারবে না, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে সমাজব্যবস্থা। হলে মেসে যারা থাকে আদের মধ্যে সহমর্মিতা সহানুভূতির উজ্জ্বল চর্চা দেখা যায়। একজনের পিতার পাঠানো টাকা আসতে দেরি হলে অন্যজন আনন্দে হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু নিজের বাড়ি যাদের আছে তারা সব রক্ষণশীল। কারও বেকায়দায় পাশে দাঁড়াতে শিক্ষা তারা পায়নি। রাজনীতি যারা করে তাদের মধ্যে শত ময়লা থাকলেও সোনার মতো চকচক করে অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মহৎ গুণ। এ কালের রাজনীতিও ধান্দানীতি দখল করে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করছে। আগে মেধাবীরা ছাত্ররাজনীতি করত। স্বভাব-চরিত্র দরদের আলাপ পরোপকার করা। অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়া পড়া তারা বীরের কাজ মনে করত। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তারা গর্জে উঠত। ছাত্রসমাজ জনতাকে সংগঠিত করে রাজপথে নামত। তারা অসহায়ের পাশে দাঁড়াতে উদগ্রীব ছিল।

ছাত্রনেতারা ছাত্রজীবন থেকে ধীরে ধীরে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতেন। এখন স্মার্টফোনে যুবসমাজ নিজেকে লুকিয়ে রাখে। এদের একমাত্র স্বপ্ন এ দেশ কখন ছাড়বে। পিতা-মাতাও প্রস্তুত থাকে সন্তানকে বিদেশে বিড়াল ফেলার মতো করে ফেলতে বুকে আশা নিয়ে ভালো থাকবে বড় রোজগার করবে। দেশে নোংরা, রাজনীতি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অবিচার বাসা বাধায় এই জেনারেশনকে দেশ ছেড়ে নিরাপদ ভবিষ্যৎ তালাশ করতে ভূতুড়ে পরিবেশ থেকে বাঁচতে বাধ্য করছে। কোনো অভিভাবক তার সন্তান রাজনীতিতে জড়াক তা কোনোভাবে চান না। মূল কারণ গোড়ায় গলদ। রাজনীতির সেই সোনালি দিন আর জবরদস্তির এই দিন। রাজনীতিকদের ভাবতে হবে কেন শান্তিপ্রিয় মানুষ আজ এই মহান পেশা ঘৃণা করে। এ অবস্থা জাতির জন্য অশনিসংকেত। সব মেধা যদি বিদেশে পাড়ি জমায় দেশ চালাবে কারা, দেশের হবেটা কী।

রাজনীতি যারা করে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ত্যাগ-তিতিক্ষা সহজাত চরিত্র। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাদের বারান্দায় মানুষ এসে খায়, সাহায্য পায়। তাতে তারা আনন্দিত হতো। ভাসানী কাগমারীর সম্মেলনে ডাক দিলেন, গামছার এক মুঠ ডাল আর এক খুচি চাল নিয়ে হাজির অনুসারীরা। পাতলা ডাল রেঁধে নৌকায় ঢালা ছিল। এখান থেকে নিয়ে খাওয়া এই হলো রাজনীতি। ভাসানীর অনেক সম্পদ ছিল, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মানুষের কল্যাণে উজাড় করেন মজলুম নেতা। সম্পদ বলতে কিছুই ছিল না। শেষ বয়সে ভক্ত-অনুসারীরা বাজার করে দিয়ে আসতেন তাই খেতেন। ২০ বছর পুরাতন এক কাঁথার নিচে ঘুমাতেন। সেই কাঁথায় ছেলেদের নাতিদের পেশাব পায়খানার গুমোট গন্ধে নাক জ্বলে উঠত। কেউ হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে গেলে বলতেন আয় আমার কাঁথার নিচে। একবার ’৭৪ সালে আ স ম রব ভোররাতে তাঁর আস্তানায় হাজির হন। তিনি বলেন, আয় কাঁথার নিচে ওই বিখ্যাত কাঁথার গন্ধে রব সাহেবের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। এই ছিল জনগণের ব্যথায় ব্যথিত নেতা।

নেতৃত্ব যারা দেন ছাত্রজীবন থেকে তারা পরোপকারী হয়ে ওঠেন। যে কোনো ঝুঁকি নিতে পারেন নিরীহ মানুষের জন্য। ভোগবিলাস তাঁদের আকর্ষণ করে না দেশপ্রেম, মানবপ্রেম তাঁদের ব্রত।

বিগত দুই যুগে শিক্ষা নিয়ে শুধু লাবরেটরি গবেষণা চলল। অথর্ব আদাড়ে মালের দলীয় যোগ্যতায় চাকরির উৎসব দেখেছি। স্কুল পাশে ভালো শতাংশ পাস না করলে এমপিও পাবে না এমন নীতিতে শিক্ষকরা নকল করতে সাহায্য করেছেন। শিক্ষামন্ত্রীও ফল ভালো দেখানো ও প্রকাশের যে তুঘলকি কারবার করেন হাস্যকর মনে হয়। নিজের সফলতা দেখাতে উদগ্রীব হয়ে জাতির সর্বনাশ করছেন। আবার ঢাকঢোল বাজিয়ে ফরমায়েশি ফলাফল ঘোষণা দিচ্ছেন। মোদ্দা কথায় জাতিকে জানান দেওয়া অনেক বেশি পাস করেছে মানে সরকারের বড় অর্জন হয়েছে। এমন ছেলেমানুষি দুনিয়ায় দেখা যায় না। শহরের কিছু স্কুল ছাড়া কোথাও ছাত্রদের লেখাপড়া নেই; হাজিরা নেই, শুধু স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে তাই নিয়ে শিক্ষার্থীরা দিন কাটায়। একটা অকর্ম জাতি হতে বেশি বাকি নেই আমাদের।

আমার এক পরিচিতজন তার ভাইপোকে আমার কাছে এনে আবদার করে পুলিশের কনস্টেবল পদে কাল ভর্তি পরীক্ষা একটু বলে দিলে যদি চাকরি হয়। বেশ উঁচু ভালো ফিগার, তাকে প্রশ্ন করলাম- আমি খাইতেছি ইংরেজি বলো। উত্তর দিতে গিয়ে চোখ উল্টে মূর্ছা যাচ্ছিল। বলল, আমি ইংরেজি পারি না, এসব পড়ায়নি। যাও সোজা বাড়ি যাও পিয়নের যোগ্যতাও তোমার নেই। এই হলো বিএ পড়ুয়া ছাত্রের দশা।

আমার এক অফিসার বন্ধু তার ছেলের চাকরির জন্য আমার পরিচিত এক কোম্পানিতে সুপারিশ করতে অনুরোধ করেন। আমি তাকে তার ছেলেকে কিছু লেখাপড়া শেখাতে বললাম। অফিসের পত্র-চালাচালি যোগাযোগের স্কিল অফিসের কিছু বিশেষ ভাষা শেখাতে। চিঠি ড্রাফট করা শেখা। বললাম আজকাল সব অফিসে অবসরপ্রাপ্ত অফিসাররা আছেন। ইন্টারভিউ হবে বাস্তবে গেলে সাদা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলবে বায়ারের কাছে লিখ নির্ধারিত তারিখে শিপমেন্ট সম্ভব হবে না গ্যাস-বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য। ব্যাংকে লিখ আমার কোম্পানির শ্রমিক আন্দোলনের কারণে উৎপাদন দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। বিশাল লোকসানে পড়েছি। রপ্তানি করতে না পারায় খেলাপি হয়েছি, আমাদের পুনরায় রি-শিডিউল করে ব্যবসা চালাতে সহযোগিতা করুন। এমন অনেক চিঠি বাক্যালাপ। আমাকে বলল ও পারবে। তখন ভাবলাম হায়রে ভ্রান্তির পিতৃ উষ্ণ স্নেহ সন্তান মানুষ করতেও ভ্রান্ত আশায় বুক বাঁধতে দুঃসাহস দেয়। সে যে স্কুল কলেজে পড়েছে তার মান আমরা বুঝি। তার ভালো করার কোনো শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ হয়নি। আমি বুঝলেও তার পিতা বুঝতে পারল না। ঠিক তাই হলো চাকরির সাক্ষাতের ফল। নিশ্চয় বড়ই করুণ।

দেশে ভালো পদের চাকরির জন্য বিদেশ থেকে হায়ার করে জনবল আনতে হচ্ছে। শুধু কেরানি পয়দার কারখানা তাও বিদ্যায় কুলায় না। বিদ্যায় সবল কষ্টসহিষ্ণু হলে তারা বিশ্বজয় করে দেখাতে পারবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে ভাবার কারও সময় নেই, শুধু ক্ষমতা জিন্দেগি ভর কী করে থাকা যাবে সেই পাঁয়তারা।

ছাত্রছাত্রীদের মনে রাজনীতির আদর্শবোধ জন্মাতে না দিয়ে আমরা একটা প্রজন্ম তৈরি করছি। আত্মকেন্দ্রিকতার নিবিড় চাষ তাদের মনের ওপর করছে মা-বাবা পরিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তারা নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছাড়া আর কিছু মগজে নিতে পারে না। শুধু কখন বিদেশ পাড়ি দেবে। কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার ছুতো ধরে আসল উদ্দেশ্য বিদেশে স্থায়ীভাবে পাকাপোক্তভাবে থাকার বন্দোবস্ত। অভিভাবকরা জানেন শিক্ষা বলতে কিছু আর বাকি নেই এখানে। যেখানে ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাস টেনের বাংলা ইংরেজি ট্রান্সলেশন করতে ফেল মারবে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর