রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

রাজা থেকে ফকির মৃত্যু আসবেই

নঈম নিজাম

রাজা থেকে ফকির মৃত্যু আসবেই

খালি হাতে আসে মানুষ। ফিরেও যায়। শেষ বিদায়ে দুনিয়ার অর্থসম্পদের কিছুই সঙ্গে নেওয়া যায় না। সবকিছু রেখে যেতে হয়। মৃত্যুর পর কিছুই সঙ্গে যায় না। সম্পদ, আপনজন সবই থেকে যায়। অনেক কিডনি রোগীর আর্তনাদ শুনেছি। দুটি কিডনিই নষ্ট। আপনজনদের কাউকে পাওয়া যায় না একটি কিডনি দান করার। কঠিন বাস্তবতা মেনে মৃত্যুকে বরণ করেন। জীবিতকালে জেনে যান কেউই আপন নয়। অর্ধেক পৃথিবীর রাজা আলেকজান্ডারের মৃত্যুর আগে উপলব্ধি বদলে গিয়েছিল। এত যুদ্ধ, লড়াই, ধনসম্পদের কোনো মানে খুঁজে পাননি সম্রাট আলেকজান্ডার। বুকভাঙা কষ্ট নিয়ে তিনি দেখলেন কোনো কিছুর মানে নেই। মাত্র ২০ বছর বয়সে ক্ষমতা পেয়েছিলেন। সারা দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। ক্ষমতা নেওয়ার ১০ বছরের মধ্যে কাঁপিয়েছিলেন বিশ্ব। ৩০ বছর বয়সে সারা দুনিয়ায় বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। সেই শাসক বাগদাদে সামান্য জ্বরে কাবু হলেন। দুনিয়ার কোনো চিকিৎসক কিছু করতে পারলেন না। মৃত্যুর আগে বিশ্বজয়ী সম্রাট সভাসদকে বলেছিলেন কফিনের দুই পাশে তাঁর দুই হাত ঝুলিয়ে দিতে। সেই কফিন বহন করবে চিকিৎসকের দল, যারা ব্যর্থ হয়েছিলেন চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তুলতে। কফিন নিয়ে যাওয়া সড়কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে অর্থ, সোনা-মণি-মুক্তা। সবকিছু দেখে মানুষ অবাক হবে। বিস্মিত নয়নে প্রশ্ন করবে দুনিয়ার সম্রাট কেন যাওয়ার আগে এমন অদ্ভুত কান্ড করলেন? দিলেন আজব নির্দেশ?

সহচররা আলেকজান্ডারকে আশ্বস্ত করলেন তাঁর সবশেষ নির্দেশ বাস্তবায়ন হবে মৃত্যুর পর। সম্রাট তারপর তাদের প্রশ্নবোধক চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা ভাবছো কেন এমন নির্দেশ দিলাম। শোনো, দুনিয়ার বাদশাহ সামান্য জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে। কোনো চিকিৎসক তাঁকে রক্ষা করতে পারছেন না। বিশাল অর্থসম্পদের বিনিময়ে কোনো রাজা -বাদশাহকে রক্ষা করার ক্ষমতা তারা রাখেন না। ডাক এলে মৃত্যুর কাছে সবাই অসহায়। ক্ষমতা, অর্থবিত্ত সব মূল্যহীন। শেষ পরোয়ানা এলে সবাইকে চলে যেতে হবে। কারও থাকার সুযোগ নেই। চিকিৎসাবিদ্যা একটা সময় মূল্যহীন হয়ে যায়। আমার কফিন বহনের সময় মানুষ দেখবে অসহায় চিকিৎসকরা দুনিয়ার রাজা আলেকজান্ডারকে বাঁচাতে পারেননি। তারা আলেকজান্ডারের শব বহন করছেন নিজেদের কাঁধে। এতে দুনিয়ার মানুষের নতুন উপলব্ধি হবে। মানুষ নিজেদের বদলানোর চেষ্টা করবে। সম্রাটের কথায় মাথা নাড়লেন সভাসদ। আলেকজান্ডার তারপর দুই হাত কফিনের দুই পাশে ঝুলিয়ে রাখার ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন, খালি হাতে এসেছিলাম দুনিয়ায়। মায়ের পেট থেকে আসার সময় কোনো মানুষ কিছু নিয়ে আসে না। সারাটা জীবন যুদ্ধ করে একটার পর একটা রাজ্য দখল করলাম। বিশাল ধনসম্পদ উপার্জন করলাম। আমার চেয়ে বেশি সম্পদ এ দুনিয়ার কারও নেই। আজ আমার সঙ্গে কিছুই নিচ্ছি না। দুনিয়ার মানুষ দেখবে সম্রাট আরেকজান্ডারের শূন্য হাত কফিনের দুই পাশে ঝুলছে। বিদায় বেলায় হাতে কিছু নেই। দুনিয়ার সম্রাট শেষ বিদায়ের সময় হাতে কিছু রাখতে পারছেন না। সম্রাট শূন্য হাতে এসেছিলেন। যাচ্ছেনও শূন্য হাতে। কিছুই নিতে পারছেন না। এবার তিনি ব্যাখ্যা দিলেন রাস্তায় সম্পদ ছিটিয়ে রাখার বিষয়ে। বললেন, মানুষ দেখবে আমার যাওয়ার পথে অনেক সম্পদ পড়ে আছে। কোনো সম্পদই কাজে লাগছে না। অসহায় একটা অবস্থানে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছি। আমার সবকিছু দুনিয়াতেই থাকল। কবরে কিছুই নিলাম না। আলেকজান্ডারের শূন্য হাতে আসা-যাওয়া নিয়ে দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনেক আলোচনা আছে। তার পরও মানুষ কি নিজেদের বদল করতে পেরেছে? মানুষ কি নিজেদের পরিবর্তন করেছে? সবাই জানে জীবন ও মৃত্যুর কথা। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্বে জীবন-মৃত্যু নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা আছে। আবার ডারউইনের হাজার বছর আগে একজন মুসলিম বিজ্ঞানী এ নিয়ে নিজের গবেষণা তুলে ধরেছিলেন। ৭৭৬ সালে ইরাকে জন্মগ্রহণকারী এই বিজ্ঞানীর নাম আল জাহিজ। আল-হায়াওয়ান নামের প্রজননবিষয়ক গ্রন্থে তিনি অনেক কিছু তুলে ধরেছিলেন। তার পরও অনেক কিছুর ব্যাখ্যা মানুষের কাছে নেই। পৃথিবীর সব ধর্মে মৃত্যুর কথা বলা আছে। ইসলাম ধর্মে সবকিছু পরিষ্কারভাবে। সুরা নাহলের ৬১ নম্বর আয়াতে বলা আছে, ‘এরপর নির্ধারিত সময়ে যখন তাদের মৃত্যু এসে যাবে, তখন একমুহূর্তও বিলম্বিত কিংবা ত্বরান্বিত করতে পারবে না।’ অর্থাৎ আমাদের যেতেই হবে। একই বিষয়ে সুরা ইউনুসের ৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান আর তাঁর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে।’

অর্থ ও ক্ষমতা দুই দিনের। আজ রাজা, কাল ফকির হতে সময় লাগে না। প্রকৃতি সব বিষয়ে পরীক্ষা করে। আরব দেশগুলো এখন কৃত্রিম বৃষ্টি নামাচ্ছে। আমরা বৃষ্টির অভাবে অতি তাপমাত্রায় পড়েছি। সম্রাট শাহজাহান, আওরঙ্গজেবের সময় আমাদের উপমহাদেশ আর্থিকভাবে শক্তিশালী ছিল। আরবরা তখন গরিব ছিল। হজ ভালোভাবে করার অর্থ দিল্লির একাধিক সম্রাট মক্কার শাসকের কাছে পাঠাতেন। নবাব ফয়জুন্নেসা মাত্র ১৫০ বছর আগে হজ করতে গিয়ে মহিলাদের সুযোগসুবিধা পাননি। পরে তিনি মহিলাদের আলাদা অজুখানাসহ অনেক কিছু নির্মাণ করেছিলেন মক্কায়। প্রকৃতির ঘূর্ণনে এখন তাদের সম্পদ হয়েছে। এ সম্পদ হাতবদল হয় মুহূর্তে। মুকেশ আম্বানিরা দুই ভাই। দুজনই বিশ্বের সেরা ধনী। একজনের এখন অর্থবিত্তের অভাব নেই। আরেকজন অনিল আম্বানি সব হারিয়ে সাদামাটা জীবনে ফিরেছেন। অথচ কয়েক বছর আগেও তাঁর সম্পদের শেষ ছিল না। বাবার কাছ থেকে দুজনই সমান অর্থসম্পদ পেয়েছিলেন। একজন ধরে রাখতে পারেননি। আরেকজন সারা দুনিয়ায় চোখ ধাঁধানো অর্থবিত্তের মালিক। ইবনে ওমর (রা.) বলতেন, ‘তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হয়ে সকালবেলার অপেক্ষা কোরো না এবং সকালে উপনীত হয়ে সন্ধ্যাবেলার অপেক্ষা কোরো না। সুস্বাস্থ্যের দিনগুলোয় রোগব্যাধির প্রস্তুতি নাও এবং জীবদ্দশাটাকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করো।’ (বুখারি হাদিস ৬৪১৬, তিরমিজি হাদিস ২৩৩৩, ইবনে মাজাহ হাদিস ৪১১৪)। মানুষের জীবনে সম্পদ, ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যু স্বাভাবিক ও কঠিন সত্য।

মৃত্যুর ডাক এলে ফেরানো যায় না। বিখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদার গত বছর এমন সময়ে এক দিন ফোন করলেন। বললেন, বাংলাদেশে আসছি। তখন আমি আমেরিকায়। বললাম, দাদা কয়টা দিন পরে আসুন। আমি দেশে নেই। তিনি দুই দিন পর আবার ফোন করলেন। বললেন, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। কয়েকদিন থাকতে হবে। সুস্থ হয়ে ঢাকা আসব। ঢাকা ক্লাবে উঠব। বলে রেখো। আমেরিকা থেকে ফিরে জানাবে। ফোন দিও। আমেরিকা থেকে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, ঢাকা নেমে ফোন করব সমরেশদাকে। আসতে বলব। ঢাকা নেমে জানলাম সমরেশ মজুমদার আর নেই। কালবেলা, উত্তরাধিকার, কালপুরুষ, সাতকাহনের লেখক বিদায় নিয়েছেন। কিছুদিন আগে তাঁর মেয়ে দোয়েল মজুমদার ঢাকা এলেন। সঙ্গে আরেক বিখ্যাত লেখক শীর্ষেন্দুর মেয়ে দেবলীনা ও কলকাতার প্রকাশক ত্রিদিব কুমার চ্যাটার্জি। তাঁরা তিনজনই ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। দোয়েলের সঙ্গে তাঁর বাবার পুরনো স্মৃতিগুলো নিয়ে কথা হচ্ছিল। বড় মনের মানুষ ছিলেন এই বিখ্যাত সাহিত্যিক। বিশাল দেহের অধিকারী মানুষটি সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন আড্ডার আসরে। মৃত্যুর আগে একবারও বুঝতে পারেননি চলে যাচ্ছেন। শেষ মুহূর্তেও হাসপাতালের নার্স-ডাক্তারদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছেন। মন ভরে দুনিয়ার সব বিষয়ে গল্প করেছেন। একবারের জন্যও বুঝতে পারেননি, কাউকে বুঝতে দেননি তিনি চলে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদের ছিল আকাশছোঁয়া খ্যাতি। দুই বাংলায় তিনি ছিলেন সমানভাবে জনপ্রিয়। বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীর কাছে তাঁর ছিল হিমালয়সম উচ্চতা। তিনি দুই হাতে লিখতেন। শাওনের মায়ের জটিল চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুর। সবার অনুরোধে নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলেন। জানলেন ক্যান্সার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যান্সার চিকিৎসার প্রশংসা সারা দুুনিয়ায়। হুমায়ূন আহমেদ গেলেন। দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করলেন। মৃত্যুর আগে ঢাকা এলেন। নুহাশপল্লীতে ডাকলেন অনেককে। আমার সঙ্গেও ফোনে কথা হলো। অফিসের কয়েকজন সহকর্মীকে পাঠালাম হুমায়ূন আহমেদের বিশাল একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে আসতে। জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলি তিনি সেই সাক্ষাৎকারে তুলে ধরলেন। আবেগাপ্লুত ছিলেন। সাক্ষাৎকার আমাদের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে তিনি আবার ফিরে গেলেন আমেরিকা। চিকিৎসা চলছিল ভালোই। তার পরও শেষ সময়ে এই লেখকের মাঝে অস্থিরতা ছিল। টেনশন ছিল। মৃত্যুচিন্তা পেয়ে বসে তাঁকে। শেষ সময়ে একদিন শাওন গান করছিলেন। আবেগ দিয়ে খালি গলায় শাওন গাইছেন- ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়/সুরা ইয়াসিন পাঠ করিও বসিয়া কাছায়/যাইবার কালে বাঁচি যেন শয়তানের ধোঁকায়...।’ গান শুনতে শুনতে ঝরঝর করে কাঁদছিলেন হুমায়ূন। তাঁর দুই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। শিশুর মতো চোখ মুছছিলেন। হয়তো অজানা কষ্ট ভিতর থেকে ডুকরে বেরিয়ে আসছিল। আহারে মৃত্যুর আগে মানুষ কি এভাবে ভিতরে ভিতরে কষ্ট পায়?

মানুষের এক জীবনে অনেক দুঃখ থাকে। কষ্ট থাকে। মানুষ দুঃখকষ্টের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা সবার মাঝেই সীমাবদ্ধতা দিয়েছেন। কোনো মানুষই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নন। চিকিৎসাবিজ্ঞান আজ অনেকদূর এগিয়েছে। মানুষ করোনার টিকা আবিষ্কার করে নিজেদের রক্ষা করেছে। এখন চেষ্টা করছে ক্যান্সারের টিকা আবিষ্কারের। আরব আমিরাত কৃত্রিম বৃষ্টি নামাচ্ছে। তার পরও বুঝতে পারছে না কতটুকু বৃষ্টি দরকার? প্রকৃতিকে মানুষ এখনো বশে আনতে পারেনি। কোনো দিন পারবে কি না জানি না। শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুকষ্ট ছিল। আপনজনদের মৃত্যু তাঁকে বারবার আঘাত হানছিল। হারানোর বেদনা ছিল নজরুলেরও। সন্তানকে হারিয়ে নজরুল দিশাহারা হয়ে ওঠেন। বুঝতে পারেন মানুষের মৃত্যু অবধারিত। জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর গভীর সংযোগ রয়েছে। কে কীভাবে মারা যাব জানি না আমরা। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ মৃত্যুর আগে লিখেছেন, ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।’ রুদ্রর ঠিকানা কি এখন আকাশ? তাঁর প্রেয়সী চাইলে কি চিঠি লিখতে পারে? মানুষ একবার চলে গেলে আর ফেরার সুযোগ থাকে না। সবকিছু চলে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আমাদের পূর্বপুরুষরা একদা ছিলেন। এখন তাঁরা নেই। একদিন আমরা থাকব না। চলে যাব পূর্বপুরুষদের কাছে। সেদিন কেউ আটকাতে পারবে না। আমাদের কোনো কিছু থাকবে না।               

      লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর