রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

দাবদাহ ও আমাদের করণীয়

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

দাবদাহ ও আমাদের করণীয়

অতিসম্প্রতি বাংলাদেশে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল হিসেবে এবং সমুদ্রে লঘুচাপ তৈরি হওয়ার কারণে আকাশ পরিষ্কার ও মেঘাচ্ছন্ন না থাকায় গরম বাতাস সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে স্থলভাগে চলে আসে। তাপপ্রবাহের সময় ৩৮ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত যদি তাপমাত্রা থাকে সেটাকে হিট-ওয়েভ বলে। বাংলাদেশ শুধু নয়, সারা বিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে। জাপান, চায়না, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে অতিরিক্ত কলকারখানা থেকে যে কার্বন নিঃসরণ হয় এগুলোর মাধ্যমে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে এ উপকূলীয় অঞ্চল বা ব-দ্বীপ অথবা উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলো বেশি ভুক্তভোগী হয়। কেননা এসব অঞ্চল এ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়। যেমন বাংলাদেশও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত দায়ী উন্নত দেশগুলো। তারা যদি বৈশ্বিক জলবায়ু রক্ষায় ১৯৩০ মিলিয়ন ডলার এখনই খরচ না করে তাহলে তাপমাত্রা ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি যখন বেড়ে যাবে তখন অ্যান্টার্কটিকার সব বরফ গলে যাবে এবং সমুদ্রে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হবে। বর্তমানে স্থলভাগ হতে মাত্র ১০ মিটার নিচে আছে সমুদ্রের পানি। এখন যদি ব্যাপক জলোচ্ছ্বাস হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো প্রায় ৫০% স্থলভাগ পানির নিচে চলে যাবে। আমি মনে করি আমাদের দেশে এ তাপমাত্রা বৃদ্ধি কমানোর জন্য বেশকিছু করণীয় আছে। আমাদের প্রথম কাজ হলো আমরা যত বেশি পারি গাছ লাগাব। একটা গাছ চারটা এসির থেকেও বেশি কার্যকরী। অর্থাৎ প্রায় ৩০ ডিগ্রি পরিমাণ তাপমাত্রা কমাতে পারে যদি আমাদের দেশে পর্যাপ্ত বনায়ন করা সম্ভব হয়। এখন ঢাকা শহরের প্রায় ৮০ ভাগ অংশে কংক্রিট আছে।

যেখানে মাত্র ৮ ভাগ জলাশয় আছে। এ ৮০ ভাগ কংক্রিটের স্থানে বা আশপাশে যদি গাছ লাগানো যায় তাহলে পরিবেশ সবুজাভ ও উন্নত হবে, সঙ্গে পরিবেশ ঠান্ডা থাকবে ও বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি হলে আমাদের আবহাওয়া ভালো থাকবে এবং পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধিটা কমে আসবে। বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আমরা লক্ষ্য করেছি যে চুয়াডাঙ্গা, যশোর এবং অন্যান্য জেলায় তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে গেছে এবং ঢাকাতে বিগত ৪০ বছরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছে। এ তাপমাত্রা যদি আরও বাড়ে তাহলে আমরা হিটস্ট্রোকের মতো ঘটনা অনেক দেখতে পাব। বেশকিছু মানুষের ইতোমধ্যে হিটস্ট্রোকে মৃত্যু হয়েছে। হিটস্ট্রোক হলে মানুষের মৃত্যু রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও আরও অনেক ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচতে বা তাপপ্রবাহ হলে করণীয় কী?- প্রথমত আমরা ঘরে থেকে প্রয়োজন না হলে বাইরে যাব না। আমরা ছায়ায় থাকার চেষ্টা করব। বাইরে গেলে আমরা ছাতা ব্যবহার করব, ঢিলেঢালা সাদা পোশাক পরব। আমরা যখন-তখন যে কোনো জায়গায় ঠান্ডা পানি খাব না, পরিষ্কার পানি খাব। বাসি বা পুরনো খাবার খাব না, যেসব খাবার খেলে সহজে হজম হয় এমন খাবার খাব। ঝাল, তেল বা চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া বন্ধ করতে হবে এবং আমি মনে করি, যে মানুষগুলোকে বাইরে যেতেই হয়- যেমন একজন রিকশাচালক, শ্রমিক- তাদের আমরা যতটা পারি ছায়ার মধ্যে কাজ করতে বলব। শিশু এবং বয়স্কদের দিকে বেশি খেয়াল রাখব। ঘন ঘন তারা যেন পানি খায়। পানি খাওয়ার পরিমাণ যেন ৩-৪ লিটার হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। তারা ঠান্ডা পানি খাবে না এ কারণে- ঠান্ডা পানি হঠাৎ করে খেলে শরীরে ব্লাড ভেসেলগুলো সংকুচিত হয় এবং স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং এ পর্যন্ত এ ঘটনায় পাঁচজন মৃত্যুবরণ করেছে আমাদের দেশে। আমি মনে করি যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরি। হিটস্ট্রোকের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে শিশুরা। এ ছাড়াও ঝুঁকিতে আছে বয়স্করা, যাদের ওজন বেশি, ব্লাড প্রেশার ও ডায়াবেটিস আছে, প্রতিবন্ধী, শ্রমিক-শ্রমজীবী, কৃষক, নির্মাণ শ্রমিক, রিকশাচালক এবং যারা শারীরিকভাবে অন্য কোনো রোগে অসুস্থ। তারা সবাই এসব ঝুঁকির মধ্যে আরও বেশি থাকে। তাদের দিকে সতর্ক থাকতে হবে ও অতিরিক্ত যত্ন নিতে হবে এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

এ প্রচ- গরমের মধ্যে আমরা বেশি লবণ-পানির শরবত খাব, লেবুর শরবত খাব। প্রয়োজনে আমরা স্যালাইন খাব এবং ব্লাড প্রেশার পরিমাপ করব। আর আমরা যতক্ষণ পারি বিশ্রামে ও ছায়ার মধ্যে থাকব। এ ছাড়াও আমাদের আরও কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। যেমন হিটস্ট্রোক হলে কী হয়? শারীরিক অস্বস্তি বোধ হয়। শরীর থেকে ঘাম হওয়ার ফলে পানিশূন্যতা হয়, প্রচ- মাথাব্যথা হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে রাতে ঘুম আসে না। কারও কারও শরীরে মাংসপেশিতে ব্যথা হয়। কারও খাবার অরুচি থাকে, কেউ কেউ শ্বাসকষ্টে ভোগেন, কিডনি ও ফুসফুসের সমস্যা হতে পারে, প্রস্রাবের রং হলুদ হয়ে যেতে পারে এবং চামড়া খসখসে হয়ে যায় ও ক্ষত হতে পারে। কারও কারও হিটস্ট্রোকের পাশাপাশি হার্টের সমস্যা হতে পারে বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারও কারও হিটের কারণে মাসেল ক্র্যাম্প হয়, হাঁটতে গেলেও তাদের কষ্ট হয়। এ ছাড়া আমরা এ সময়ে যে করণীয় বিষয়গুলো মনে রাখব তা হলো- বেশি করে পানি খাব। সাধারণত আমরা ১.৫ থেকে ২.৫ লিটার পানি খাই। এখন প্রয়োজনে ২.৫ থেকে ৩.৫ লিটার পর্যন্ত পানি খাব। আমরা ঘরে এলে সঙ্গে সঙ্গে গোসল না করে ১৫ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে নিজের ঘরের পরিবেশ ও তাপমাত্রার সঙ্গে খাপখাইয়ে নিয়ে এরপর গোসল করব। গায়ে হালকা ভেজা কাপড় দেওয়ার ব্যবস্থা করব। পাতলা আরামদায়ক পোশাক পরিধান করব এবং আমরা যথাসম্ভব ঠান্ডা স্থানে থাকার চেষ্টা করব, ছায়ার নিচে থাকব। দরকার হলে একাধিকবার গোসল করার ব্যবস্থা করতে হবে। চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।

পানিশূন্যতা পূরণে খাবার স্যালাইন গ্রহণ করা যেতে পারে। বাইরে গেলে তখন ছাতা ব্যবহার করব। মৌসুমি ফল বা শাকসবজি বেশি করে খাব। এ মৌসুমে বিশেষ করে তরমুজ খাওয়া যেতে পারে বেশি বেশি।

বাইরে গেলে প্রয়োজনে সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে, প্রয়োজনে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা যেতে পারে। যারা অ্যাজমা রোগে আক্রান্ত, তাদের অ্যাজমার চিকিৎসার প্রস্তুতি নিতে হবে। এ বিষয়গুলো যদি আমরা মেইনটেন করতে পারি তাহলে হিটস্ট্রোক থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারব। যেমন করে আমরা হিটস্ট্রোক থেকে মুক্তি পাওয়ার আগেই প্রস্তুতি নেব, তেমনি করে যেন এ তাপপ্রবাহ কমে, তার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের যে আন্দোলন, তা চলমান রাখতে হবে- যে আন্দোলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ওয়ার্ল্ড লিডার হিসেবে নিজেকে ইতোমধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। বৈশ্বিক জলবায়ু রক্ষায় ১৯৩০ মিলিয়ন ডলার যদি দেওয়া হয়, ভবিষ্যতে আমার মনে হয় আমরা বনায়ন কর্মসূচি, সবুজায়ন কর্মসূচি করতে পারি। আর যত কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, তা যদি আমরা কমিয়ে আনতে পারি ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি তাহলে অচিরেই তাপপ্রবাহ কমে আসবে। ভবিষ্যতে আমাদের এই যে শারীরিক অসুস্থতা, তা থেকে আমরা মুক্তি পাব এবং যেসব উন্নত দেশ এর জন্য দায়ী তাদেরও বলতে হবে তারা যেন এমনভাবে তাদের কলকারখানা বা ফ্যাক্টরিগুলো চালায়, যেন অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ না হয়।

অতিরিক্ত যত বেশি কার্বন নিঃসরণ হবে, তত বেশি আমাদের দেশসহ অনুন্নত দেশগুলো অধিক ভুক্তভোগী হবে। এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সব আন্তর্জাতিক বিশ্ব এবং দেশের সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত বলে আমি মনে করি।

লেখক :  সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর