সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভারতের নির্বাচন : হিন্দুত্ব না বহুত্ববাদ

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ভারতের নির্বাচন : হিন্দুত্ব না বহুত্ববাদ

এবারের ভারতের সংসদীয় নির্বাচন কোন পথে যাবে তা নিয়ে ভারতের ১৫০ কোটি মানুষ উদগ্রীবের সঙ্গে তাকিয়ে আছেন ৪ জুনের দিকে। ওইদিনই ফলাফল প্রকাশিত হবে। সাত দফা ভোট পর্বের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় দফা ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ভারতবর্ষে নয়, গোটা বিশ্বের তাবড় তাবড় গণতান্ত্রিক দেশ তাকিয়ে আছে-ভারতবর্ষে গণতন্ত্র থাকবে কি থাকবে না। স্বাধীনতার পর এই প্রথম দেশের দুই মুখ্যমন্ত্রী দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং ঝাড়খন্ডের হেমন্ত সোরেন এবং সততার প্রতীক মমতার মন্ত্রিসভার দুই সদস্য পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এ মুহূর্তে জেলবন্দি। সেই সঙ্গে মমতার দলের প্রায় ১০-১২ জন নেতা ও বিধায়ক জেলে দিন কাটাচ্ছেন। যিনি ভারতবর্ষের সংবিধানের রক্ষক সেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদার দাশ মোদি সারা ভারতবর্ষে ঘুরে ঘুরে প্রচার করছেন আমরা রামমন্দির করে দিয়েছি সুতরাং আমাদের ভোট দিন। এ কথাও বলা বেড়াচ্ছেন সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করেছি এবং মুসলমানদের তিন তালাক প্রথা রদ করেছি।

মোদিসহ মন্ত্রিসভার সদস্য এবং বিজেপি নেতারা মনে মনে পোষণ করেছেন ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৪০০ আসন অনায়াসেই পাবেন এবং সংবিধান সংশোধন করে ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করবেন। হিন্দি, হিন্দু এবং হিন্দুত্ববাদকে সারা দেশে কায়েম করবেন। কিন্তু ব্যাপারটা অত সোজা নয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- আজই দখিনা দুয়ার খোলা কিন্তু দাক্ষিণাত্যের পাঁচ রাজ্যে- বিজেপির ফল আশানুরূপ হবে না। সে ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসের মতো আঞ্চলিক দলগুলো তাদের সহায় হয়ে উঠবে। দক্ষিণের পাঁচটি রাজ্যে অ-বিজেপি সরকার। সেখানে হিন্দি ভাষা কেউ জানালেও বলেন না, ফলে বিজেপি যদি সেখানে হিন্দি ভাষা চাপাতে চান তবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো দশা হবে। জিন্নাহ যেমন পাকিস্তানে উর্দু ভাষা প্রচলন করতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছিলেন, পুরো পাকিস্তানে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল। এখানেও তার অন্যথা হবে না।

দিল্লি ও কলকাতায় আরএসএস সম্পর্কে মমতা বলেছেন, আরএসএস একটি সুশৃঙ্খল দল। দক্ষিণের কর্ণাটকে কংগ্রেস শাসন করছে। এর আগেও তারা সেখানে সরকারে ছিল। কিন্তু মোদি ও অমিত শাহ বিধায়ক কেনাবেচা করে ক্ষমতা দখল করে। পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে পুনরায় ক্ষমতা দখল করে। সেই কর্ণাটকে আরএসএস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে চাইছে। এমনকি একটি হিন্দু মেয়ে একটি মুসলিম ছেলেকে ভালোবাসত বলে তাকে পুড়িয়ে মেরেছে। নির্বাচন শুরুর আগে  থেকেই রাজ্যে রাজ্যে ছোটখাট সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এবং জঙ্গিপনা ছড়িয়ে পড়ছে। মোদি ও অমিত শাহ চারদিকে বলে বেড়াচ্ছেন এবার ৪০০ পার। ভারতবর্ষ হবে এক দেশ, এক ভাষা, এক জাতি এবং এক ভোটের দেশ। কংগ্রেস ও বিরোধী ইন্ডিয়া জোট এর প্রতিবাদে সরব হয়েছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী আরএসএসের গুলিতে প্রাণ দেন। একই রকমভাবে ইন্দিরা গান্ধী এবং রাজীব গান্ধীকেও আরএসএসের প্রত্যক্ষ মদদে খুন হতে হয় যদিও তারা তা অস্বীকার করে।

১৯২৮ সালে নাগপুরে আরএসএসের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তারা স্বৈরতন্ত্রী। মোদি ও অমিত শাহ তারই অনুগামী। এদিকে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তিনিও আরএসএসপন্থি। তিনি আবার নিজের রাজ্যে গোরখপুরে একটি শাখা সংগঠন খুলেছেন। ফলে আরএসএসের মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট। আরএসএসের দলীয় সংবিধান অনুযায়ী কেউ ৭৫ বছর পার করলে তার আর মন্ত্রিসভায় জায়গা হবে না। যে কারণে মুরলিমনোহর যোশি ও এল কে আদভানি এখন আর মন্ত্রিসভার সদস্য নন। এই নিয়মে মোদিরও ৭৫ বছর পার হতে বেশি দেরি নেই। দেখা যাক কী হয়। কিন্তু অমিত শাহরা কি যোগী আদিত্যনাথকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেবেন-এ প্রশ্ন বিজেপি ও আরএসএসের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। গুজরাট দাঙ্গার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, মোদি রাজধর্ম পালন করেননি। তবুও সেই মোদিই ভারতবর্ষে প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং রাজধর্ম যথারীতি পালন করছেন না। এটাই রাজনৈতিক মহলের অভিযোগ। মোদি ও তার সহযোগীরা যতই দাবি করুন ৪০০ আসন তারা পাবেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তা একেবারেই অসম্ভব। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রাক্তন সহযোগী সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক তরুণ গাঙ্গুলি মনে করেন জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য মোদি এসব প্রচার করে বেড়াচ্ছেন।

ভারত নামক যে বৃহত্তম গণতন্ত্র সেটা কাদের অধিকার এক দশক আগেও এই প্রশ্ন ছিল অবান্তর। কিন্তু গত এক দশকে মানুষের মনে বিজেপি এই প্রশ্নটাই তুলে ধরেছে। তাতে অবশ্য বিজেপির লাভের লাভ কিছু হয়নি। নির্বাচনের অব্যবহিত আগে সিএসডিএস লোকমত সমীক্ষা করে দেখিয়েছে কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি নয়, ভারতের ওপর সব ধর্মাবলম্বী মানুষের সমান অধিকার। এই সংখ্যা ৮০ শতাংশ। মাত্র ১২ শতাংশ রায় দিয়েছেন ভারত হিন্দুদের। ধর্মীয় বহুত্বের এই ছাপ নির্বাচনে কতখানি পড়বে সেটাই দেখার বিষয়। গত এক দশকে নিরন্তর চেষ্টা সত্ত্বেও এখনো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করেন ভারত বহুত্ববাদী দেশ। রামমন্দির স্থাপনকে ভালো কাজ মনে করলেও মন্দিরপন্থি জনতার একটি বিশাল অংশ মনে করে ভারত বহুত্ববাদী দেশ। মূলত কিছু উচ্চ বর্ণের ধনী ও বয়স্ক মানুষ মনে করেন ভারত হিন্দু রাষ্ট্র। কিন্তু তরুণ খেটে খাওয়া মানুষ যাদের সংখ্যা বেশি তারা মনে করেন ভারতে বহুত্ববাদই চালু থাক। দেখা যাচ্ছে, বিজেপি বিরোধী দলগুলো ধরেই নিয়েছে বিজেপির হিন্দুত্ববাদই কায়েম হবে। তারা চুপচাপ দর্শক হয়ে থাকবেন। কিন্তু ধর্মীয় উগ্রতা, অসহিষ্ণুতা যে এখনো এই ভারতের অধিকাংশ মানুষের পছন্দ নয়, তা এই সমীক্ষা দেখিয়ে দিয়েছে। বিভেদকামী প্রবল প্রতাপ রাজনৈতিক দলটিকে হারানোর জন্য দরকার উন্নয়নের বিকল্প রূপরেখা।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর