শিরোনাম
শনিবার, ১১ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

আমি জাহানারা ইমামের অপদার্থ ছেলে

ইমদাদুল হক মিলন

আমি জাহানারা ইমামের অপদার্থ ছেলে

সাহিত্যের দরজাটা আমার সামনে খুলে দিয়েছিলেন রফিক আজাদ। বাংলা একাডেমির পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’-এ আমার প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ ধারাবাহিক ছেপে রফিকভাই আমাকে বড় একটি জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি আমার সাহিত্যের গুরু। প্রিয়তম বন্ধু। আমাকে ডাকতেন ‘বেটা’ বলে। আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়িটাও হলো রফিকভাইর হাত ধরে। ’৭৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে শুনছিলাম ‘ইত্তেফাক’ ভবন থেকে ‘রোববার’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরোবে। ‘দৈনিক বাংলা’ ভবন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ, আমাদের প্রিয় মনুভাইয়ের বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা ছিল ‘সন্ধানী প্রকাশনী’। ‘সচিত্র সন্ধানী’ নামে অসামান্য একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতেন তিনি। মনে আছে আমাদের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর বিখ্যাত ও ব্যাপক আলোচিত উপন্যাস ‘খেলারাম খেলে যা’ লিখেছিলেন ‘সচিত্র সন্ধানী’র বেশ মোটাতাজা ঈদ সংখ্যায়। যখন ‘রোববার’ বেরোবার প্রস্তুতি চলছে, তখন গাজীভাইও নতুন করে আবার ‘সচিত্র সন্ধানী’ প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন। সম্পাদক আমাদের সবার প্রিয় বেলাল চৌধুরী। ‘রোববার’ পত্রিকা বেরোবে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের অর্থায়নে। প্রকাশক তাঁর স্ত্রী সাজু হোসেন। পত্রিকা প্রকাশের সার্বিক দায়িত্ব পড়েছে রাহাত খানের ওপর। রফিকভাই তখনো বাংলা একাডেমিতে আছেন। ‘উত্তরাধিকার’ সম্পাদনা করছেন। রাহাতভাই তাঁকে নিয়ে এলেন ‘রোববার’-এ। বাংলা একাডেমির কাজ শেষ করে বিকেলের দিকে তিনি আসতেন ‘ইত্তেফাক’ ভবনে। প্রিন্টার্স লাইনে তাঁর নাম ছাপা হবে না। তবে পত্রিকাটা করবেন তিনিই। সম্পাদক আবদুল হাফিজ। তিনি সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। ভালো অনুবাদ করেন। অত্যন্ত চমৎকার মানুষ।

আমি তখন পারলে চব্বিশ ঘণ্টাই রফিক আজাদের সঙ্গে। রাহাতভাইও স্নেহ করেন। জীবনে প্রথম চাকরি হলো ‘রোববার’-এ। জুনিয়র রিপোর্টার। বেতন ৪০০ টাকা। ‘রোববার’ পত্রিকা আরেকটি দরজা খুলে দিল আমার সামনে। দেশের বিখ্যাত লেখকদের সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচিত হতে লাগলাম। পত্রিকা বেরোল ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে। প্রথম সংখ্যায় আমার একটা গল্পও ছাপলেন রফিকভাই। একটি প্রেমের গল্প। গল্পটির নাম সম্ভবত ‘দিন আমাদের’, নাকি ‘মৌ’ ঠিক মনে পড়ছে না। পত্রিকার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল বছরের শুরুর দিক থেকেই। ডিক্লারেশন পেতে দেরি হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত নভেম্বরে গিয়ে বেরোল। ‘রোববার’ অফিসেই এক দুপুরের পর এসেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। দিনটির কথা পরিষ্কার মনে আছে। সাদা শাড়ি পরা মানুষটি হাসিমুখে রফিক আজাদের টেবিলের সামনে এসে বসলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি তাঁর দিকে। এই হচ্ছেন জাহানারা ইমাম? বীর মুক্তিযোদ্ধা রুমির মা? কিশোর বয়সে তাঁর অনুবাদে পড়েছিলাম লরা ইঙ্গেলস ওয়াল্ডারের ‘নদীতীরে ফুলের মেলা’। কী অসামান্য অনুবাদ। কী চমৎকার মায়াবী ভাষা। আজ সেই মানুষটি আমার সামনে? চাইলেই আমি তাঁকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি! রফিক আজাদ পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি তাঁর স্নিগ্ধ মায়াবী মুখখানি আমার দিকে তুলে ধরলেন। অপূর্ব হাসিমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তোমার নাম শুনেছি। লেখাও হয়তো পড়েছি। মনে নেই।’ তারপর থেকে মাঝে মাঝেই তিনি ‘রোববার’ অফিসে আসতেন। বিকেলের দিকে চা ডালপুরি আর শিঙ্গাড়ার সঙ্গে সাহিত্যের আড্ডা হতো। সেই আড্ডায় তিনি আসতেন। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময়ী, প্রাণবন্ত, স্মার্ট। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে আসেন। মুখে হাসিটি লেগে আছে। হাসির আড়ালে চাপা পড়ে আছে পুত্র হারানোর বুকভরা বেদনা। স্বামী হারানোর বেদনা। স্বাধীনতার জন্য তিনি তাঁর ছেলে রুমিকে বলেছিলেন ‘যা, যুদ্ধে যা। দেশ স্বাধীন কর। দেশের জন্য তোকে আমি কোরবানি করলাম।’ তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ রুমির মা। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মা। সন্তান আর স্বামী হারানোর বেদনা বুকে চেপেও সারাক্ষণ তাঁর মুখে লেগে আছে অপূর্ব এক হাসি। দেখে পুরনো দিনের গানের একটি লাইন মনে আসত আমার। ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’। রফিক আজাদ, শাহাদত চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির এবং আমার প্রিয়বন্ধু শিল্পী কাজী হাসান হাবিব ও আরও অনেকে জাহানারা ইমামকে ‘আম্মা’ ডাকেন। আমিও তাঁকে ‘আম্মা’ ডাকতে শুরু করেছিলাম।

‘রোববার’ বেরোবার কিছুদিন আগে জামালপুরে একটা সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল। রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী এরকম আরও কেউ কেউ ঢাকা থেকে অতিথি হয়ে যাবেন। আমাকে তখন কে চেনে? কে আমন্ত্রণ জানাবে? আমন্ত্রণ ছাড়াই রফিক আজাদের পিছু ধরলাম। রফিকভাই বললেন, ‘কোনো অসুবিধা নেই। চল।’ তখনো পর্যন্ত রফিকভাই আমাকে তুমি করে বলেন। আমি তাঁকে আপনি বলি। তারপর তো হয়ে গেলাম ‘তুই’, ‘বেটা’। আমিও তাঁকে ‘রফিকভাই’, ‘তুমি’ করে বলি। জামালপুরের সরকারি কৃষি খামারের বাংলোয় আমার আর রফিকভাইয়ের থাকার ব্যবস্থা। অপূর্ব জ্যোৎস্না রাত। আমরা দুজন বাংলোর বারান্দায় বসে আছি। অপূর্ব জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। বাংলোর অদূরে সূর্যমুখীর চাষ করা হয়েছে। চাঁদের আলোয় দুষ্টু মেয়ের মতো ফিকফিক করে হাসছে সূর্যমুখী। সে এক অবিস্মরণীয় রাত। রফিকভাই তাঁর কবিতার কথা বলে যাচ্ছেন। জীবনের ফেলে আসা মধুময় স্মৃতির কথা বলে যাচ্ছেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি। কোনো কোনো পরিবেশ মানুষকে অতিরিক্ত স্মৃতিমুখী করে ফেলে। সেই রাতটি ছিল তেমন। আমার তখন তেইশ বছর বয়স। জগন্নাথ কলেজে ইকোনমিকসে অনার্স পড়ি। ছেলেবেলা থেকেই জীবনের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। দুঃখ-দারিদ্র্য-হতাশা। মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্বার অসহায় মৃত্যু। দশটি সন্তান নিয়ে আমার মায়ের আরেক যুদ্ধ। এসব কথাও সেই রাতে রফিকভাইকে বলেছিলাম। রফিকভাই বারবার বলছিলেন তাঁর ‘দুঃখ কষ্ট’ কবিতাটির কথা। সেই রাতেই আমার মাথায় এসেছিল এই কবিকে নিয়ে আমি একটি উপন্যাস লিখব। ফিরে আসার পর লিখলাম সেই উপন্যাস। রফিকভাইয়ের কবিতাটির নামেই নাম। ‘দুঃখ কষ্ট’। আমার তৃতীয় উপন্যাস। মাঝখানে লিখেছি ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’।

করোটিয়া কলেজে কিছুকাল বাংলার প্রভাষক ছিলেন রফিকভাই। তাঁর ছাত্র ছিলেন আরেফিন বাদল। বাদলভাই পরে ‘তারকালোক’ গ্রুপ গড়ে তোলেন। সিনেমা পাক্ষিক ‘তারকালোক’ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৯০ সালে কিশোরদের জন্য পত্রিকা বের করলেন ‘কিশোর তারকালোক’। আমাকে করা হয়েছিল ‘কিশোর তারকালোক’-এর সম্পাদক। বাদলভাই গল্প লিখতেন। বেশ কিছু গল্পের বই আছে তাঁর। বাংলাদেশের বাছাই করা গল্পকারদের নির্বাচিত গল্পের বই সম্পাদনা করেছেন। ’৭৮-’৭৯ সালের দিকে তিনি সরকারি প্রকাশনা দফতরের উচ্চপদে কাজ করতেন। সরকারি পত্রিকা ‘প্রতিরোধ’-এর সম্পাদক ছিলেন। আমার বন্ধু শিল্পী কাজী হাসান হাবিবও ওখানে কাজ করতেন। পার্টটাইম করতেন ‘দৈনিক সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকীতে। সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করতেন আমাদের সবার প্রিয় আবুল হাসনাত। হাসনাতভাই।

‘দুঃখ কষ্ট’ উপন্যাসটি আমি বাদলভাইয়ের হাতে দিয়েছিলাম পড়ে দেখার জন্য। লেখাটা বাদলভাইয়ের খুবই পছন্দ হলো। তিনি ‘প্রতিরোধ’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় ছেপে দিলেন। ১২০০ টাকা সম্মানি দিলেন লেখার জন্য। সেই প্রথম লিখে এতগুলো টাকা হাতে পাওয়া। তার আগে বিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা পেয়েছি গল্প লেখার জন্য। ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম ‘সিনেমা’ পত্রিকাতে। পত্রিকাটি বেরোত ফজলুল হক মণিভাইয়ের ‘বাংলার বাণী’ গ্রুপ থেকে। সেই উপন্যাসের জন্য পেয়েছিলাম ৪০০ টাকা। ঈদ সংখ্যা ‘সিনেমা’য় ছাপা হয়েছিল।

‘রোববার’ পত্রিকা নিয়ে তখন রীতিমতো গবেষণা চলছে। কে কী ধরনের লেখা লিখবে? কার কী কাজ ইত্যাদি। রফিকভাই আমাকে একটা অভিনব আইডিয়া দিলেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকা শহরের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াব আমি। বিশেষ বিশেষ যা কিছু চোখে পড়বে, ওই নিয়ে এক পৃষ্ঠার একটি কলাম লিখব। কলামের নাম ‘আশেপাশে’। ’৭৯ সালে জার্মানিতে চলে যাওয়ার সময় রফিকভাইকে বলে গেলাম আমার কলামটি এখন থেকে লিখবে শাইখ সিরাজ। আজকের বিখ্যাত শাইখ সিরাজের লেখক জীবন শুরু হয়েছিল ‘রোববার’ পত্রিকার ওই ‘আশেপাশে’ কলাম থেকে।

‘রোববার’ প্রথম সংখ্যায় গল্প লিখলাম। পাশাপাশি লিখলাম জামালপুরের সাহিত্য সম্মেলন নিয়ে। সেই সম্মেলনে পরিচয় হয়েছিল শাহাজাদী আঞ্জুমান আরা মুক্তির সঙ্গে। ওদের বাড়ি শেরপুরে। সেই বাড়িতেও আমরা একদিন গিয়েছিলাম। মুক্তি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলাসাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করে। কবিতা লেখে। ওর বন্ধু হচ্ছে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কামাল চৌধুরী, আলী রিয়াজ, আলমগীর রেজা চৌধুরী। মুক্তির বড়বোন শেরপুর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। ছোটবোন তৃপ্তি চমৎকার গান করে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে আমাদের গান শুনিয়েছিল ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।’ রবীন্দ্রনাথের গান। ভারি মনোরম একটি দুপুর কেটেছিল মুক্তিদের বাড়িতে।

প্রথম সংখ্যা বেরোল। দুটো কপি নিয়ে গেলাম জাহানারা ইমামের এলিফেন্ট রোডের বাড়িতে। ভারি খুশি হলেন। পত্রিকা তিনি আগেই হাতে পেয়েছেন। আমার দুটো লেখাই পড়ে ফেলেছেন। আমার ভাষা খুব গতিময়, সহজ সরল স্বচ্ছ এসব বলে খুব প্রশংসা করলেন। এভাবে ধীরে ধীরে আম্মার ভালোবাসার ছায়া এসে পড়ছিল মাথার ওপর। কয়েক মাস পর সাহস করে একটা গল্প লিখলাম। ‘মানুষ কাঁদছে’। বঙ্গবন্ধুর কথা লিখলাম এই গল্পে। তখন তো বঙ্গবন্ধুর নামই উচ্চারণ করা যায় না। তাঁকে নিয়ে লেখা যায় না। আমি সাহস করে লিখলাম। রফিক আজাদ ছাপলেন। সেই গল্প পড়ে ‘রোববার’ পত্রিকা অফিসে ছুটে এলেন আম্মা। দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। লেখার প্রশংসা করলেন, সাহসের প্রশংসা করলেন। তিনি নিজে একজন বড় লেখক। বড় মানুষ। পুত্রের কৃতিত্বে যেমন আনন্দিত হন মা, আমার ওই লেখার জন্য তিনি যেন তেমনই আনন্দিত। পুরো অফিস মুগ্ধ হয়ে আছে। অতিরিক্ত প্রশংসায় মানুষ ম্লান হয়ে যায়। আমার অবস্থা তেমন। তবে ভিতরে ভিতরে অভিভূত। আমাকে সম্পূর্ণভাবেই দখল করে নিলেন তিনি। আমি যেন হয়ে উঠলাম তাঁর সত্যিকারের পুত্র।

‘রোববার’ ছেড়ে ১৯৭৯ সালে চলে গেলাম জার্মানিতে। ফিরে এসে ১৯৮২ সালে বিয়ে করলাম। বিয়েতে আম্মাকে দাওয়াত করা হয়নি। স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর বাড়িতেও যাওয়া হয়নি। তখন আমার অবশ্য চরম দুর্দিন চলছে। জার্মানিতে গিয়েছিলাম অনেক আশা নিয়ে। প্রচুর টাকা রোজগার করে ফিরে আসব। তা হয়নি। যে কঠোর কঠিন শ্রমিকের জীবন ছিল তা আমি মেনে নিতে পারিনি। ফিরেছিলাম শূন্য হাতে। ‘রোববার’-এ নতুন করে চাকরি হয়েছিল। সেই চাকরিও চলে গেছে লেখার কারণে। ছোট একটা বিজ্ঞাপন সংস্থা করেছি। নাম ‘দোয়েল’। আমার কয়েকজন বন্ধু হয়েছে পার্টনার। আবদুর রহমান, পাভেল রহমান, আফজাল হোসেন ও সানাউল আরেফীন। সেই প্রতিষ্ঠানও উঠে গেল। আফজাল আর আরেফীন গিয়ে বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান ‘মাত্রা’ প্রতিষ্ঠা করল। রহমান পত্রিকা প্রকাশ করতে লাগল। পত্রিকার নাম ‘প্রিয়জন’। তার আগে বোধহয় ‘আকর্ষণ’ নামে একটি পত্রিকা করেছিল। সেই পত্রিকায় আমি রেখা, অমিতাভ বচ্চন এই সমস্ত জনপ্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীর ‘কাল্পনিক সাক্ষাৎকার’ নামে এক ধরনের লেখা লিখেছিলাম। নতুন ধরনের লেখা। পাঠক পছন্দ করেছিল। হাতে দশটি টাকা নেই। এই অবস্থায় বিয়ে করে ফেললাম। বিয়ে হলো ডিসেম্বরে। পরের ফেব্রুয়ারি বইমেলায় স্ত্রীকে নিয়ে গেছি। বাংলা একাডেমি চত্বরে ঘুরছি। আম্মার সঙ্গে দেখা। স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। তিনি দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। তাকে বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেই আমার মুখের দিকে তাকালেন। গভীর মায়াবী কণ্ঠে, তাঁর সেই মধুর হাসিমাখা মুখে আমার স্ত্রীকে বললেন, ‘শোনো মা, এই মিলনটা হচ্ছে আমার এক অপদার্থ ছেলে। বিয়ে করেছে সে কথা মাকে জানায়নি। বউটা পর্যন্ত দেখায়নি। আমার বাড়িতে নিয়ে যায়নি। অপদার্থ ছেলে।’ শুনে খুবই অপরাধবোধ করছিলাম। মনটা খারাপ হলো। সত্যিই তো! কী করেছি আমি? জীবনের এতবড় ঘটনার কথা আম্মাকে জানাব না? ততদিনে আম্মা লিখে ফেলেছেন তাঁর সেই মহাগ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এরকম বই দ্বিতীয়টি লেখা হয়নি। সেই বই আমি কতবার যে পড়লাম। কতবার যে চোখের জলে ভাসলাম। সেই অনুভূতির কথা বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না।

সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ তখন ‘ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন’ নামে একটি অভিনব বিষয় চালু করেছে। প্রতি শব্দের একটি মূল্য ধরা হয়েছে। যে যত শব্দের বিজ্ঞাপন দেবে তাকে সেই পরিমাণ টাকা দিতে হবে। শাহাদত চৌধুরীর এই আইডিয়া ব্যাপক সাড়া ফেলল পাঠক মহলে। বিশ, পঞ্চাশ, একশো টাকা হলেই যে কেউ নিজেকে নিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে পারছে। বন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে পারছে। এই রকম আর কি। এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে যা হয়, অনেকটা সেই রকম। বরিশালের পাঁচবন্ধু মিলে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ নামে একটা দল হয়েছে। তাঁরা প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করল। ‘পঞ্চপাণ্ডব’ ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনদাতা মহলে পরিচিত হয়ে গেল। এই পাঁচজনের সঙ্গে পরে আমারও বন্ধুত্ব হয়। দলে ছিল সৈয়দ দুলাল, শেখ নূর, মোহাম্মদ হানিফ, ফারুক খান ও সাকী চৌধুরী। সৈয়দ দুলাল নাট্যকর্মী। বরিশালের বিখ্যাত ‘শব্দাবলী’ গ্রুপ থিয়েটারের প্রধান ব্যক্তি। এই গ্রুপ আমার দুটি মঞ্চনাটক করেছে। ‘নদী উপাখ্যান’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘লালচর’ আর ‘কালাকাল’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘কালাকাল’। ‘নদী উপাখ্যান’ পরে সরকারি অনুদানে সিনেমা হয়। পরিচালক নাদের চৌধুরী। নাম সেই ‘লালচর’। মঞ্চে ‘লালচর’ এর প্রধান অভিনেতা ছিলেন আমার আরেক বন্ধু শাহনেওয়াজ। সে ও বরিশালেরই লোক। একবার বরিশাল থেকে দুলাল আর সাকী এলো। সাকী অবশ্য ঢাকা বরিশাল মিলিয়ে থাকত। ঢাকায় ওদের বাড়ি আরমানিটোলায়। বরিশালে কী এক অনুষ্ঠান করবে ওরা। ষাটজন ছেলেমেয়েকে পুরস্কৃত করবে। ঢাকায় এসে আমাকে বলল, পুরস্কার হিসেবে তারা বই দেবে। একটি নির্দিষ্ট বই। কোন বইটি দেওয়া যায়? ততদিনে আমার বেশ কিছু বই বেরিয়েছে। চাইলেই আমার একটি বইয়ের ষাটকপি ওদের ধরিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমার মনে হলো আম্মার ‘একাত্তরের দিনগুলি’র ওপর কোনো বই নেই। এই বইটি ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। দুলালরা ষাটটা বই কিনল। কিনে একটা আবদার ধরল। বইতে আম্মার ‘শুভেচ্ছা স্বাক্ষর’ লাগবে। আমি আম্মাকে যোগাযোগ করলাম। তিনি সময় দিলেন। বইয়ের বোঝা নিয়ে এক সকালে আমরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। পথ থেকে কিনে নিয়েছিলাম টকটকে কিছু লাল গোলাপ। সেই গোলাপ যখন তাঁর হাতে দিয়েছি, দেখি গভীর আবেগে তাঁর চোখ দুটো ছলছল করছে। ফুলের সঙ্গে অনেকক্ষণ তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখলেন। আমারও তখন চোখে পানি এসে গেছে। ততদিনে আমি আর তাঁকে ‘আম্মা’ বলি না। তিনি হয়ে গেছেন আমার ‘মা’। আমার মায়ের মতো তাঁকেও ‘মা’ ডাকি। তাঁকেও ‘তুমি’ করে বলি। ষাটখানা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ তাঁর টেবিলের ওপর রাখলাম। তিনি বসে বসে অতিযত্নে ‘শুভেচ্ছা’ লিখে অটোগ্রাফ দিতে লাগলেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি হলো ১৯৯২ সালে। আম্মা হলেন সেই কমিটির প্রধান। কমিটির ১০১ সদস্যের মধ্যে আমিও একজন আছি। আম্মা তারপর ঐতিহাসিক সব পদক্ষেপ নিলেন। ধীরে ধীরে জয় করলেন স্বাধীনতার পক্ষের প্রতিটি মানুষের মন। এতটাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ কমে গেল। প্রবল এক বৃষ্টিদিনের কথা। শাপলা চত্বরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভা। বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ। আম্মা এসেছেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা শেডের তলায়। দেখি সেখানে এক বন্ধুর সঙ্গে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে প্রিন্টের হাফশার্ট। কাঁধে ঝোলা। ঠোঁটে যথারীতি পাইপ। মুগ্ধ হয়ে আম্মার বক্তৃতা শুনছেন। ১৯৮২ সাল থেকে মাড়ির ক্যান্সারে ভুগছিলেন আম্মা। বই লিখেছেন ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’। তবে এই রোগকে তিনি গ্রাহ্য করেননি। সমানে লড়াই করেছেন ক্যান্সারের সঙ্গে। ক্যান্সারের প্রথম ও দ্বিতীয় আক্রমণ সামাল দিয়েছেন। মাড়ির অপারেশন করিয়েছেন। ফলে তাঁর অপূর্ব সুন্দর মুখখানি আগের মতো ছিল না। একদিকে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই, অন্যদিকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সেখানেও তাঁর যুদ্ধ। এ সময় এক নামকরা পত্রিকায় তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো। এক পর্যায়ে তাঁর লেখালেখির কথা উঠল। তিনি বললেন, ‘আমি আর কী লিখব বলুন? সবই তো মিলন লিখে যাচ্ছে।’ কত বড় মানুষ হলে আমার মতো তুচ্ছ একজন লেখকের কথা এভাবে বলা যায়! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এলেন ঢাকায়। তিনি আম্মার সঙ্গে দেখা করবেন। আমি নিয়ে গিয়েছি। চা খেতে খেতে আড্ডা। যতটা প্রশংসা তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের করলেন, ততটা করলেন আমার লেখার। আমি এত সংকুচিত হয়ে থাকলাম। সুনীলদা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর দুই পর্বের অসামান্য উপন্যাস ‘পূর্ব-পশ্চিম’। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা এই উপন্যাসে অসামান্য দক্ষতায় লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। উপন্যাসটির দ্বিতীয় খণ্ড আম্মাকে উৎসর্গ করা। উৎসর্গপত্রে লেখা ‘বেগম জাহানারা ইমাম ও তাঁর মতো জননীদের উদ্দেশে’।

১৯৯২ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হলো ১৯৯৩ এর ফেব্রুয়ারিতে। ‘প্রবন্ধ ও গবেষণায়’ পেলেন মুনতাসীর মামুন। ‘কথাসাহিত্যে’ আমি। তার কয়েকদিন পর বইমেলায় আম্মার সঙ্গে দেখা। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর সেই স্নিগ্ধ হাসিমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘আমার দোয়া না থাকলে কি এত বড় একটা পুুরস্কার তুই পেতি?’ আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। জননী জাহানারা ইমাম, আমার মা। তাঁকে নিয়ে এসব আমার অবিস্মরণীয় স্মৃতি। আমার অমূল্য সম্পদ। তাঁর সঙ্গে আমার দুয়েকটা ছবি আছে। সেই সব ছবি কোনো ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখিনি। তাঁর মতো মহীয়সীকে কোনো ফ্রেমে আটকে রাখা যায় না। তাঁর মতো মানুষ থাকেন অন্তরের অনেকখানি জায়গাজুড়ে। আমার শুধু মনজুড়ে নেই মা, চোখজুড়েও আছেন। চোখ খোলা রেখে আমি তাঁর মুখখানি দেখতে পাই।

চোখ বন্ধ করেও দেখতে পাই তাঁর সেই মধুর হাসিমাখা মুখখানি। এরকম মুখ জননী জাহানারা ইমাম ছাড়া আর কার হতে পারে? এরকম মুখ আমার মা ছাড়া আর কার হতে পারে? আমার একটা কিশোর গল্প আছে ‘ফার্স্টবয় সেকেন্ডবয়’। সেই গল্পের মা হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছেন জাহানারা ইমামকে। দুই ছেলের নাম রেখেছেন রুমি ও জামি। শহীদ রুমিকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। জামিকে দেখেছি। আমার বয়সীই। আমার বন্ধু লেখক ইফতেখারুল ইসলামের সহপাঠী। ইফতেখারের বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হচ্ছিল ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে’। সেখানে জামির সঙ্গে পরিচয়। নাম শুনেই আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। মনে মনে বলেছি, ‘ভাই, আমার ভাই।’ জামির গায়ে জননী জাহানারা ইমামের সুবাস।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর