বুধবার, ১৫ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

উপজেলা নির্বাচনেই আবর্তিত রাজনীতি

পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ

উপজেলা নির্বাচনেই আবর্তিত রাজনীতি

৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের পর দেশের রাজনীতিতে শূন্যতা বিরাজ করছে। বিরোধী দলগুলো রাজনীতির মাঠে নিষ্প্রভ। সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি ও তার মিত্ররা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল। সারা দেশে সরকারের বিভিন্ন কৌশলী বাধাকে অতিক্রম করে বিভিন্ন জেলায় বিএনপি বৃহৎ সমাবেশ করেছে। কৌশলী বাধাকে ব্যর্থ করেছে আগের দিন থেকে সমাবেশস্থলে জড়ো হয়ে। সমাবেশের মাঠে রাত জেগে সমাবেশে ভিন্নতা এনেছে। সমাবেশেগুলোতে ছিল উৎসবের আমেজ। সারা দেশের নেতা-কর্মীরা চাঙা হয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের সমাবেশের বক্তব্যে আশাবাদী হয়েছিলেন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। কেন্দ্রীয় নেতারা সমাবেশে বক্তব্যের পাশাপাশি দফায় দফায় বৈঠক করেছেন বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিকের সঙ্গে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যত বৈঠক করেছেন তত চাঙা হয়েছে। নেতা-কর্মীদের বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে, আন্দোলন সফল হবে। দিনে আন্দোলন আর রাতে কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বক্তব্যে গভীর মনোযোগ রেখেছে। কিছু ইউটিউবার এমনভাবে কথা বলেছেন, যেন রাত পোহালেই সরকার পরিবর্তন হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে তারা ছিলেন ভীষণ আশাবাদী। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষণা হবে আর নির্বাচন করে তারা ক্ষমতায় চলে যাবেন।

সরকার সব সময় কঠোর অবস্থানে থেকেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে আমলেই নেয়নি। সারা দেশে বড় বড় সমাবেশের পর বিএনপি ঢাকায় সমাবেশ ঘোষণা করে। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপি সমাবেশ করে। পাশাপাশি জামায়াতও সমাবেশ করে। সারা দেশের নেতা-কর্মীরা জড়ো হন সমাবেশে। বিশাল লোক সমাবেশ হয়। সমাবেশের এক পর্যায়ে কয়েক স্থানে সহিংসতা শুরু হয়। কাকরাইলে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা হয়। আরেক স্থানে এক পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আগুন দেওয়া হয় পুলিশ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে। পাল্টা অ্যাকশনে যায় পুলিশ। টিয়ার শেল নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ শুরু হয়। শুরু হয় গ্রেফতার। অল্প সময়ের ভিতর সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। বিএনপি মহাসচিব সমাবেশ মঞ্চ ছাড়ার সময় হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এরকম পরিস্থিতিতে বিএনপি মহাসচিবের কর্মসূচি ঘোষণার সময় অপ্রস্তুত মনে হয়েছে। পরিস্থিতি এমন হলে বা পরবর্তী কর্মসূচি কী হবে, মনে হচ্ছিল সে বিষয়ে কোনো পূর্ব-প্রস্তুতি ছিল না। পরবর্তী কর্মসূচি আগে থেকে ঠিক করা ছিল না মনে হয়েছে। অনেককেই এ বিষয়ে আশ্চর্য হতে দেখি। অনেকে বলেন, এত বড় সমাবেশের পর বা এমন পরিস্থিতিতে তাদের পরবর্তী কর্মসূচি কী হবে সেটা বোধহয় নেতারা নিজেরাই জানতেন না। মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতারা গ্রেফতার হন। কারাগারে যেতে হয় জেলা নেতাদেরও। অনেকে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে যান।

৭ জানুয়ারি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়। বিএনপি ও তার মিত্ররা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেয়। দলীয় নেতাদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় প্রার্থিতা। জাতীয় পার্টি অনেক নাটকীয়তা শেষে নির্বাচনে অংশ নেয়। ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা হয়।

 নির্বাচনে সমঝোতার আসনের ১১টিতে জয়ী হয়। ৯টি আসনে জামানত হারায়। আসন সমঝোতার বাইরে থাকা প্রার্থীদের ভিতর চারজন বাদে অন্যরাও জামানত হারান। ১১ আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে। সংরক্ষিত দুজন মহিলা সদস্য নিয়ে সংসদে এখন জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা ১৩ জনের। সংখ্যার হিসাবে অনেকে বলেন, ‘আনলাকি থার্টিন’। কথাটির সত্যতা প্রমাণেই যেন নির্বাচনের পর দল ভাঙনের শিকার হয়। সংসদে বিল পাসের ক্ষেত্রে সংশোধনীসহ বিরোধী দল ভূমিকা পালন করে। দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে দুটি বিল পাস হয়। একটি ছিল দ্রুতবিচার আইন স্থায়ী করে বিল পাস। বিল পাসের প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের মাত্র তিনজন সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। আইন প্রণয়ন করা সংসদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দ্রুতবিচার আইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ আইনে মাত্র তিনজন বিরোধী দলের সদস্যের অংশগ্রহণ হতাশাজনক।

বর্তমানে সংসদ-সংসদের বাইরে নিরুত্তাপ বিরোধী দল। সংসদের বাইরে একমাত্র উপজেলা নির্বাচন নিয়েই রাজনৈতিক কার্যক্রম দৃশ্যমান। সরকারি দল কোন্দল নিরসন আর বিএনপি বহিষ্কারে ব্যস্ত। সরকারি দল নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখতে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের প্রার্থী না হওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। সেই নির্দেশনা কাজে আসেনি। বিভিন্ন উপজেলায় নির্দেশনা অমান্য করে অনেকে প্রার্থী হয়েছেন। ভাবা হচ্ছিল ৩০ এপ্রিলের আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় কঠোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সভায় এ বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। এখন বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে এ বিষয় বিবেচনায় আনা হবে।

অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। সঙ্গে জামায়াতও। দীর্ঘদিন নির্বাচনের বাইরে থাকা বিএনপির তৃণমূলের অনেক জনপ্রিয় নেতা প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। স্থানীয়ভাবেও তাদের ওপর চাপ ছিল। দলের কঠোর মনোভাবের কারণে প্রার্থী হতে পারেননি। অনেকে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে প্রার্থী হয়েছেন। দল তাদের বহিষ্কার অব্যাহত রেখেছে। বহিষ্কারের ধারা অব্যাহত থাকলে হয়তো তৃণমূলের কয়েক শ জনপ্রিয় নেতা বহিষ্কার হয়ে যাবেন। যাদের অনেকেই দলের ভালো সংগঠক ছিলেন। তবে দলীয় প্রার্থী না থাকলেও প্রকাশ্যে-গোপনে দলের অনেক নেতা-কর্মী বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনে যুক্ত হচ্ছেন। অনেকে সরকারদলীয় ক্ষমতাবান প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করছেন। যুক্তি দেখাচ্ছেন ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারি দলের ক্ষমতাবান প্রার্থীদের পক্ষ নিতে হচ্ছে। নির্বাচন কেন্দ্র করে তৃণমূলে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থকের সখ্য গড়ে উঠছে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবান প্রার্থীদের সঙ্গে।

দেশে এখন রাজনীতির শূন্যতা পূরণ করছে উপজেলা নির্বাচন। এ ছাড়া তেমন কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজনীতিতে স্থবিরতা চলছে। বিএনপি এবং তার মিত্রদের মনে হচ্ছে অনেকটা ক্লান্ত। ২০০৮-এর নির্বাচনের পর থেকে টানা রাজপথে থাকা নেতা-কর্মীরা ক্লান্ত হওয়াই স্বাভাবিক। এর মধ্যে রয়েছে কারাবরণ এবং মামলা পরিচালনা করা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে উজ্জীবিত ছিলেন তারা। ২৮ অক্টোবর ছিল টার্নিং পয়েন্ট। এরপর থেকেই হতাশায় পড়েছে বিরোধী রাজনীতি। আগামী দিনের সুনির্দিষ্ট কোনো আশাজাগানিয়া কর্মসূচি নেই। সফলতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় নেতারা সফলতার কোনো গল্প উপস্থিত করতে পারছেন না। নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক মহলের বিভিন্ন ভূমিকাকে আমলে নিয়ে বিরোধী শিবির উজ্জীবিত হয়েছিল। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ আওয়ামী লীগ সরকারকে অভিনন্দনে সিক্ত করে। এসব অভিনন্দন ক্লান্ত বিরোধী শিবিরকে হতাশায় নিমজ্জিত করে।

উপজেলা নির্বাচন ঘিরে তৃণমূল বিএনপির উজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। স্থানীয় অনেক জনপ্রিয় নেতা নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি শুরুও করেন। কিন্তু কেন্দ্রের কঠোর অবস্থান মেনে নিতে বাধ্য হন। পিছু হটেন নির্বাচন থেকে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক ছিল না। দলের একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। এ অবস্থায় বিএনপির জনপ্রিয় প্রার্থীরা অংশ নিলে জয়ের সম্ভাবনা ছিল। কর্মীরাও চাঙা হতেন নির্বাচন ঘিরে। বিএনপির এ সিদ্ধান্ত তৃণমূলের জন্য কতটা সঠিক ছিল অনাগত সময় বলে দিতে পারবে। তবে রাজনীতিতে শূন্যতা সরকার বা দেশের জন্য কখনো মঙ্গলজনক নয়।

রাজনীতিতে শূন্যতা তৈরি হলে আপদ বাড়ে। কয়েকদিন থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি বিষয় তুমুল আলোচিত হচ্ছে। আমলাদের সন্তানদের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিকে কেন্দ্র করে। বিগত ডিসি কনফারেন্সে এমন অদ্ভুত দাবি করা হয়েছে। আমলাদের সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় কেন হবে? বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ে উনাদের সন্তানরা পড়াশোনায় সমস্যা কোথায়? অনেকে প্রতিবাদ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলও করছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রী অবশ্য এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হবে না বলে জানিয়েছেন। গণতন্ত্র এবং মানুষের স্বার্থে রাজনীতির স্বাভাবিক স্রোতধারা প্রবহমান থাকা জরুরি।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

সর্বশেষ খবর